ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

করোনায় আক্রান্ত তরুণ-মধ্যবয়সীদের মৃত্যু স্ট্রোক-হার্ট অ্যাটাকে!
সেরীন ফেরদৌস
সেরীন ফেরদৌস

করোনাভাইরাসে বয়স্করাই বেশি ভোগেন-শুরু থেকেই এমন কথা শোনা গেলেও নানা দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও কিছু তরুণ বয়সী মানুষ মারা গেছেন যারা কভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন!

সাধারণভাবে করোনাভাইরাসের উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শ্বাসকষ্ট। অথচ যে তরুণেরা মারা যাচ্ছেন তাদের অনেকেরই করোনা উপসর্গগুলো তেমন তীব্র হয়ে দেখা দেয়নি অর্থাৎ এদের অনেকেরই তেমন কোনো শ্বাসকষ্টই হয়নি, কাশি-গলাব্যথা হয়নি, অক্সিজেনের দরকার পড়েনি অথচ মানুষটা করোনা-পজিটিভ নিয়ে মারা গেছেন! কেন? সম্প্রতি এই প্রশ্নটিরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা!

তরুণ ও মধ্য-বয়সীদেরর মৃত্যুহার চায়নাতে প্রায় ২০%, ইতালিতে প্রায় ৩০%, আমেরিকাতেও প্রায় একই রকম। “সায়েন্টিফিক আমেরিকান” জার্নাল প্রকাশ করে যে, চায়না গত মার্চে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪১৬ জন করোনা-রোগীর উপর গবেষণা করে দেখেছে এদের শতকরা ১৯% ভাগ মারা গেছেন হার্টের সমস্যা নিয়ে। আমেরিকার অভিজ্ঞতাও এরকমই! তাই এ নিয়ে বড় আকারের কিছু গবেষেণা আমেরিকাতে শুরু হয়েছে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও কানেকটিকাটের কার্ডিওলজিস্টরা হোয়াটস-অ্যাড গ্রুপের মাধ্যমে (প্রায় ১৫০জনের বেশি সদস্য) তথ্য আদান-প্রদান শুরু করেছে।

দেখা গেছে, কভিড-১৯ আক্রান্ত তরুণ ও মধ্যবয়সী মানুষগুলো কোভিডের সিম্পটমের কারণে যতটা না মারা যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে স্ট্রোক (ব্রেইনের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে) করে অথবা হার্ট অ্যাটাকড (হৃদপিন্ডের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে) হয়ে। গড়ে তাদের বয়স ৩০ থেকে ৫০ এর ভেতরে। কোভিড হবার আগেই তাদের হৃদপিন্ড এবং রক্তনালীগুলো নানারকম “কার্ডিও-ভাসকুলার” রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে দেখা যায়। মৃতের সংখ্যায় এই অংশটি নগণ্য হলেও গুরুত্বে নগণ্য নয়। প্রতিটি মৃত্যুই একেকটি ক্ষতি! যেভাবে করোনা তরুণদের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে,তা চিকিৎসকদেরকে ভাবাচ্ছে। কারণ, প্রথমদিকে ভাবা হতো যে, করোনা শুধুমাত্র ফুসফুসেরই ক্ষতি করে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, এটি প্রায় বড় সব অর্গানকেই আক্রমণ করছে, বিশেষ করে হার্ট ও ব্রেইন! চিকিৎসকরা বলছেন, যদি আমরা জানতে পারি যে, ভাইরাসটি হার্ট বা রক্তনালীকে কিভাবে আক্রমণ করছে, তাহলে হয়তো আরও কিছু জীবন বাঁচাতে পারবো।

করোনা-আক্রান্ত এবং হঠাৎ স্ট্রোক করা রোগীদের উপসর্গগুলো হচ্ছে কথা আটকে যাওয়া, তোতলানো, কনফিউশন, কাউকে চিনতে না-পারা, মুখের একদিক/ একহাত ঝুলে পরা ইত্যাদি। রোগীকে হাসতে বললে দেখা যাবে একপাশের ঠোঁট কাজ করছে, অন্যপাশ ঝুলে পরেছে। এবং হার্ট অ্যাটাক সিম্পটমগুলোর মধ্যে বুকে ব্যাথা, প্রবল অস্বস্তি/ ঘাম, দম ফুরানো, পেটে গ্যাস ভাব, বুক ধড়ফড়, চোয়াল ব্যথা, মাথা ঝিমঝিম ইত্যাদি। সবার সবগুলো হবে না, কিছু কিছু হবে।

এপ্রিলের শেষের দিকে আমেরিকার ম্যানহাটানের মাউন্ট সিনাই বেথ ইসরায়েল হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট থমাস অক্সলি জরুরি বিভাগে এ রকম একজন কোভিড পজিটিভ তরুণের স্ট্রোক অপারেশনের সময় আরও একটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেন।

ব্রেইনের যেখানে রক্ত জমাট বেঁধেছে সেই অংশটি পরিষ্কার করামাত্র তার আশেপাশের রক্তনালীগুলোতে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালী ব্লক করে দিচ্ছে! অক্সলির ভাষায়, “এটি একটি আশ্চর্য ঘটনা। সাধারণ স্ট্রোক রোগীর এ রকম  হয় না!”

এখন সাধারণত যাদের স্ট্রোক হয়ে থাকে, তাদের নানা কারণেই সেটা হতে পারে। কারো হার্টে সমস্যা থাকলে, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি থাকলে, দীর্ঘদিন ব্লাড প্রেশার/ ডায়াবেটিস থাকলে, এমনকি মাদকসেবন করলেও স্ট্রোক হবার আশঙ্কা থাকে। ব্রেইনের খুব ছোট্ট রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধলে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না, এবং সেটা আপনাআপনি সেরে যায়। কিন্তু বড় কোনো নালীতে হলে সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে না-পারলে তা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়! একই কথা হৃদপিন্ডের বেলায়ও। তার মানে এইসব তরুণ প্রাণ বাঁচাতে হলে দরকার যোগ্য চিকিৎসক ও দরকারি যন্ত্রপাতি সম্বলিত হাসপাতাল বা ক্লিনিক!

গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা-আক্রান্ত তরুণ ও মধ্যবয়সীদের ব্রেইনের ছোটগুলো নয়, প্রধান রক্তবাহী নালীগুলো অকেজো হয়ে পড়ছে। গবেষকরা ধারণা করছেন, করোনা জীবাণুটি রক্তে গিয়ে রক্তের বিশেষ ধরনের পরিবর্তন করার কারণেই স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঘটনাগুলো ঘটছে। রক্তনালীর গায়ে তৈরি হওয়া ব্লাডক্লটগুলোই ফুসফুসের রক্তনালীতে আটকে গিয়ে মৃত্যুর কারণ ঘটাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে জীবাণুটি সরাসরি নয়, আমাদের ইমিউন সিস্টেমেরই পাল্টা আক্রমণের শিকার হচ্ছি আমরাই! তবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো বিস্তারিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। 

আমেরিকার বাল্টিমোরের জন হপকিন্স হাসপাতালের ডা. রবার্ট স্টিভেন্স বলেন, এমনকি তিরিশের কোটায় পা-রাখা কোভিডরোগী এভাবে মারা যাচ্ছে, যা আমাদের জন্য বিস্ময় ও বেদনা তৈরি করছে!

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও কানাডায় কর্মরত নার্স।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন



এই পাতার আরো খবর