ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বিএনপি জামাত পূনর্বাসিত, আপনারা ব্যস্ত কামড়াকামড়িতে!
বাণী ইয়াসমিন হাসি
বাণী ইয়াসমিন হাসি

আমার বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকূপায়। একসময় সেখানে সর্বহারা পার্টির দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল। এখনও তার আঁচ রয়ে গেছে। বেড়ে ওঠার সময়টাতে খুউব সমরেশ পড়তাম। সেই থেকেই নকশাল বাড়ি মাথার মধ্যে গেঁথে আছে।আমি যে এখনো কাউকে খুব একটা পরোয়া করি না সেটা মনে হয় আমার মজ্জাগত। সর্বহারার হারানোর ভয় কি? নতুন করে কিই বা আর হারানোর আছে?

হলে থাকতে দেখতাম টিভির রিমোট নিয়ে খবরদারি করতো সেই মেয়েটা যার বাড়িতে হয়তো বিদ্যুৎই পৌঁছায়নি। যেকোনও ঝামেলা হলে সবার আগে গাড়ি ভাঙতে দৌঁড়ায় সেই ছেলেটা যার হয়তো সারাজীবনে একটা বাইসাইকেল কেনারও সামর্থ্য হয়নি। নিজের না পাওয়া আর অতৃপ্তি থেকেই এক ধরনের রাগ ক্ষোভ বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। আমরা অধিকাংশ মানুষই শারীরিক সমস্যার কারণে অসুস্থ হই না, অসুস্থ হই অন্যের সুখ আর সফলতা দেখে।

ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনে যে মানুষ যতটা অসফল তার ঈর্ষা ততটা বেশি। নিজের সমস্ত অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা অন্যের প্রাপ্তিতে কালিমা লেপন করে মেটাতে চায় সে/তারা। অথচ নিজের কাজটুকু যদি ঠিকমত করতো বা তার উপর অর্পিত দায়িত্বটা যদি সঠিকভাবে পালন করতো তাহলে হয়তো তাকে নিয়েও লেখা হতো কোনও মহাকাব্য। ঈর্ষার আগুনে পুড়ে প্রতিদিন কতশত মানুষ জ্বলে যায়। অন্যের সফলতা আর সুখ অনেকের সবচেয়ে বড় অসুখ !

মানুষ না বাঁচলে দেশ, জাতি, ধর্ম, রাজনীতি কিছুই থাকবে না। অতিকথন বন্ধ করেন। আমাদের পৃথিবীটা আজ ভয়াবহ সংকটের মুখে।‌ অতীতে মানুষ সব সংকট কাটিয়ে উঠে লড়াইটা চালিয়ে গেছে এবং শেষপর্যন্ত মানুষই জিতেছে। অলৌকিক বা অশরীরী কেউ নয়, মানুষের ইচ্ছেশক্তির তীব্রতাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবে, এই মহাদুর্যোগে জিতিয়ে দেবে।

আজ রুদ্র গোস্বামীর লেখাটা খুব মনে পড়ছে, ‘পরনিন্দা ছাড়াও মানুষের জীবনে আরো দু’পাঁচটা নিয়মকানুন আছে। যেমন প্রতিবাদ করা, ভালোবাসা, বিপদে কারো পাশে দাঁড়ানো।একটা ছোট্ট কথা কাউকে জিজ্ঞেস করা, কেমন আছো? এখন কথাটা হচ্ছে মানুষ হিসেবে তো সব মানুষই ভালো, কিন্তু ‘তুমি অনেক ভালো একটা মানুষ’ এই কথাটি যে তুমি শুনবে এর জন্য তুমি এই নিয়মগুলোকে যত্ন করছো তো? আর এখানে যদি তোমার চরিত্র নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে তবে এ কথাটা তুমি ভাবতেই পারো, যাদের নিজস্ব কোনও চরিত্র নেই তারাই তোমার চরিত্র নিয়ে খুব বেশি কথা বলবে।’

বড় বড় চেয়ারে বসলে বিশালত্ব আসে না। ক্ষমতার মসনদ চিরস্থায়ী নয়। এই দেশে ৫০ বছরে কত লোক মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন, কয়জনের নাম কে মনে রেখেছে? প্রেসিডেন্ট ভবনে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কত দাপুটে আসছেন গেছেন, তাদের কথা কারো স্মরণেও নেই। ইতিহাস ভীষণ নিষ্ঠুর। ক্ষমতা আসলে দুই দিনের।

হালের মুমিন এবং পাপিয়া দু’জনের ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজলেই দেখা যাবে এই দল বা সংগঠনে তাদের কোনও অবদান নেই। তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ বা লড়াই সংগ্রাম কিছুই নেই। বরং তারা বিশেষ কোনও নেতার ব্যক্তিগত ফুট ফরমায়েশ সার্ভ করেছে। সম্পূর্ণ অনৈতিক উপায়ে ত্যাগী এবং যোগ্যদের বঞ্চিত করে এদেরকে সংগঠনে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। যাদের হাত ধরে এদের এমন নগ্ন উত্থান তাদের দায় কি কোনও অংশে কম?

একটা সময়ে হল কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার মত কর্মী খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর এখন লাখে লাখে ছাত্রলীগ! শেখ হাসিনার গ্রেফতারের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথম মিছিল করা ছেলেগুলো কে কোথায় আছে? যতদূর জানি এমপি-মন্ত্রী তো দূরের কথা একটা চেয়ার পর্যন্ত জোটেনি কারো ভাগ্যে। যেসব বাঘা বাঘা আইনজীবী তখন শেখ হাসিনার মামলা লড়েনি তারা এখন সবচেয়ে বড় ফাইটার। অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাব-জেলের সামনে শুধু টিভি ক্যামেরায় চেহারা দেখিয়ে অনেকেই রাতারাতি বড় ত্যাগীতে পরিণত হয়েছিলে। সবটা কাছ থেকে, একদম ভেতর থেকে দেখেছি। সে সময় রাস্তায় ছিল হাতেগোনা কিছু মানুষ। সেই মানুষগুলোর বিশেষ কোনও চাওয়া নেই। তাদের একটাই চাওয়া একটু সম্মান, একটু মূল্যায়ন। কিন্তু হায় কিছুই জোটে না তাদের কপালে!

দলীয় নেতাকর্মীরা একে অন্যের কাপড় খোলার নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে। ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি। খুউব সুপরিকল্পিতভাবে সবগুলো উইং-কে দুর্বল বা ধ্বংস করা হচ্ছে। কালিমালেপন করা হচ্ছে। শুরুটা ছাত্রলীগ দিয়ে তারপর যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মূল দলের সম্মেলনে বিতর্কিতদের প্রমোশন অথবা পূনর্বাসন, যুবমহিলা লীগ। এরপর কে বা কোন উইং? কাঁদা ছোড়াছুড়ি না করে একটু ভাবুন। কিসের মোহে ছুটছেন? কাকে ধরতে দৌড়াচ্ছেন? নাকি কেউ আড়াল থেকে আপনাদের একজনের পেছনে অন্যকে লেলিয়ে দিচ্ছে? ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হচ্ছেন। একে অন্যকে হারাতে গিয়ে দিনশেষে সবাই মিলে হারছেন!

দীর্ঘদিন ধরে খুব সূক্ষভাবে শেখ হাসিনার পাশ থেকে পরীক্ষিতদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে জায়গা করে নিয়েছে বেঈমান লোভী আর সুবিধাবাদী কিছু মানুষ। এতবড় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সেখানে কয়টা সাবেক ছাত্রলীগ আছে? বড় বড় চেয়ারগুলো যারা দখল করে বসে আছে দল এবং দলীয় প্রধানের জন্য তাদের কনট্রিবিউশন কি?

একটা দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ টানা ১১ বছর ক্ষমতায়।দীর্ঘ লড়াইয়ের সময়টা কতজনের মাসের পর মাস ঘরে ফেরা হয়নি। বাবার সাথে ঈদের নামাজটা পর্যন্ত পড়া হয় নি।জীবিত মায়ের মুখটা দেখা হয় নি। জেলের অন্ধকারে কেটে গেছে বছর মাস।পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। এতো গেলো মাঠের খবর। এবার আছি প্রশাসনে - সামান্যতম আওয়ামীগন্ধ আছে বা ছাত্রলীগ এমন কেউ কি বিএনপি জামায়াতের আমলে ভালো কোন পোস্টিং পেয়েছে ? মানসিক নির্যাতন আর হয়রানির কথা না হয় বাদই দিলাম ! শেখ হাসিনার আমলে সবাই সুশীল, কেন রে বাবা? শেখ হাসিনা কি বাতাসে ভর করে ক্ষমতায় এসেছেন? লাখো কর্মীর ঘাম রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়েই আজকের আওয়ামী লীগ। 

কত বিএনপি জামাত বড় বড় চেয়ার দখল করে বসে আছে। এ ব্যাপারে কোনও টু শব্দটা নেই আপনাদের মুখে ! ‌অথচ ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ডের কেউ ভালো করলে, বড় কোনও চেয়ার পেতে গেলে আপনারা দলবেধে তার পেছনে লেগে যান। আপনারা এমন কেন বলেন তো ? কোনদিন দেখেছেন কোন বিএনপি জামাত আরেক বিএনপি জামাতের পেছনে লেগেছে ? আর কিছু মানুষ তো কথায় কথায় মানুষকে বিএনপি জামাত ট্যাগ দেয়। ব্যাপারখানা এমন তাদের সার্টিফিকেট নিয়েই দেশে থাকতে হবে ! এরা নিজের লোকদের সাথে পারে, বিএনপি জামাতের সাথে না।

একটা নিউজ পোর্টাল চালানোর সুবাদে খুব কাছ থেকে দেখেছি, আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী ও ‌অংগ সংগঠনের বিরূদ্ধে যত নিউজ হয় তার অধিকাংশই একে অন্যের বিরূদ্ধে করায় ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে। আমার অনেক পরিচিত জনেরা বিএনপি ও তার সহযোগী ও অংগ সংগঠনের দায়িত্বশীল পদে আছেন। বামদল গুলো এবং জাতীয় পার্টিতেও বেশ পরিচিত লোকজন আছে। তাদের কাছ থেকে কখনো অনুরোধ পাইনি নিজ সংগঠনের অন্য নেতার বিরূদ্ধে। অথচ হরহামেশাই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগের ভাইবোনদের কাছ থেকে অনুরোধ আসে, জোরালো তদবির আসে একে অন্যের বিরূদ্ধে নিউজ করানোর জন্য!

কখনো কখনো নিজের চেয়েও অন্যের জীবন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমন সময় আসে যখন মানুষ স্বার্থপর হতে পারে না। কথায় কথায় বিএনপি জামায়াত ট্যাগ দেওয়ার এই নোংরা কালচারটা এই করোনাকালেও বন্ধ হলো না। গতকাল একটা আইসিইউ বেডের জন্য হেন কেউ নাই যাকে নক করিনি। কোথাও ফাঁকা পাইনি। তবে এক বেসরকারি হাসপাতাল মালিক কথা দিয়েছেন, উনার ওখানে একটা ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট আছেন। উনি এক্সপেয়ার করলে ওইটা আমার পেশেন্টকে দেবেন। একবার কল্পনা করেন ব্যাপারটা। একজনের মৃত্যূর দামে আরেকজনের জীবন কেনার চেষ্টা! দয়া করে কামড়াকামড়ি বন্ধ করেন।কান্না এবং রক্তের রঙ সবই এক। মৃতের পরিচয় শুধুই লাশ।

প্রায় একযুগ ক্ষমতার চেয়ারে বসে নানাভাবে পূনর্বাসন করেছেন দেশবিরোধী অপশক্তিকে। আর নিজেরা নিজেদের ক্ষতি করতে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে মরিয়া হয়ে উঠেছেন নানামুখী অপপ্রচারে সহযোদ্ধাদের ঘায়েল করতে। মেতে উঠেছেন রুচিহীন কর্মকাণ্ডে আর সুযোগের কামড়াকামড়িতে।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

বিডি প্রতিদিন/কালাম



এই পাতার আরো খবর