ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আমরা ভুলে যাই কাফনে কোনো পকেট থাকে না!
এফ এম শাহীন
এফ এম শাহীন

জন্মের পরে মানুষে মানুষে ধর্মে, বর্ণে, জাতিতে, ধনী-গরিব, বংশে পার্থক্য থাকলেও মৃত্যুর পরে পরিচয় একটাই মৃত লাশ। বিদায় বেলায় যে পোশাক পরে তার শেষ যাত্রার সমাপ্তি ঘটে সেই কাফনে কোনো পকেট থাকে না। অনেকে ক্ষমতার চেয়ারে বসে কত রকমভাবে অঢেল সম্পত্তির মালিক হন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ভাগ্যকে লুট করে পাচার করে  ভিনদেশে। কিন্তু কোনো কিছুই নিয়ে যাওয়ার যে নিয়ম নেই। 

প্রকৃতির নির্ধারিত নিয়মে মানুষ এসেছে একা, যেতে হবেও একা। সুন্দর এ পৃথিবীর মায়াময় জগৎ আকড়ে ধরে আরও কিছুদিন মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার কি প্রাণপণ চেষ্টাই না করি। 

কিন্তু নিঃশ্বাসের মায়া যে বড্ড শক্ত আর মায়াময়! মানুষ তার জীবন সংগ্রামের সকল অর্জন রেখে যেতে হয় সময়ের কাছে। মোহ আর মায়া অতিক্রম করে হেটে যেতে হয় নিশ্চিন্তপুরের আদিম ঠিকানায়। একটা সময় পর যেখানে সবাই যায় কিংবা যেতে হয়। কেউ কেউ আবার ছুটে যায় আমাদের প্রত্যাশার বাইরে।  

প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ অতিক্রম করে নব সভ্যতায় প্রবেশ করা কিছু মানুষ তাদের লোভ আর মোহের কাছে পরাস্থ হয় নিমজ্জিত হয় অমানবিকতা আর দানবীয় কর্মযজ্ঞে। চিরবিদায়ের পর কেউ তার কর্মে বেঁচে থাকে মানুষে মানুষে বহুদিন যুগের পর যুগ আর কেউ তার নামের উপর ছড়ায় শুধুই দুর্গন্ধ এবং হয়ে ওঠে এক অভিশপ্ত আত্মায়।  

বিগত তিনমাসে শত সহস্র বছরের গতিময় মানব জীবনকে থামিয়ে দিলো করোনা নামক একটি ভাইরাস! ভাবতে পারেন কোনো বোমারু বিমান নয়, কোনো শক্তিশালী অস্ত্র, বিশ্বের নামকরা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীও নয়। নয় কোনো নাপাম বোমা, মলোটভ ককটেল কিংবা আণবিক বোমা। অজানা অচেনা একটি ভাইরাস কেড়ে নিচ্ছে লাখ লাখ মানব প্রাণ। আক্রান্ত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। সংক্রমণের আতঙ্কে জীবনকে বন্দী করে রেখেছে কোটি কোটি প্রাণ। 

আমরা চায়না, ইটালি, স্পেন কিংবা আমেরিকা থেকে কোনো প্রকার শিক্ষা তো নেইনি বরং যারা এই মহামারী নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন তাদের মুখ বন্ধ করার পায়তারা করা হয়েছে বারবার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে সরকারকে বিব্রত করতে এমন আলোচনা। কাউকে আবার দেখে নেয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। 

গতকাল একটি কলাম পড়ে সত্যি ভীষণ অবাক হয়েছি। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক প্রিয় কলামিস্ট শ্রদ্ধেয় নঈম নিজাম ভাইয়ের লেখার শিরোনাম, " মৃত্যুর দুয়ারে নতুন শপথ - পরিণতির কথা ভাবি না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবই।"

তিনি লেখার শুরুতে লিখেছেন, লেখালেখিটাই করছি। আর তো কিছু করছি না। করোনাকালে অনেক আপনজন সতর্ক করলেন। বললেন, আপনারা কয়েকজন বেশি স্পষ্ট কথা বলছেন, লিখছেন ব্যাংক লুটেরা আর স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়াদের বিরুদ্ধে। এভাবে বলতে নেই। এভাবে লিখতে নেই। ব্যাংকিং খাত ও স্বাস্থ্য খাতের লুটেরারা অনেক বেশি শক্তিশালী। ওরা গভীর জলে চলে। চারদিকে বিশাল নেটওয়ার্ক। হয়রানি করার চেষ্টা করবে অনেকভাবে। পরিকল্পনাও নিচ্ছে।

জবাবে বললাম, সমুদ্রে রেখেছি পা, শিশিরে কি ভয়। জানি লুটেরারা ভয়ঙ্কর। তারা বিভিন্নভাবে হয়রানি করবেই। মামলা খেয়েছি ৪০টির বেশি। জামিন নিয়েছি ঢাকা ও বাইরের জেলায় গিয়ে। আরও অনেক ধরনের হুমকি আর হয়রানি মোকাবিলা করেই আজকের অবস্থানে। এখন হয়তো নতুনভাবে নতুন কায়দায় কিছু করার চেষ্টা করতে পারে। করুক। ক্ষমতাসীন দলটির জন্য দুঃসময়ে আমাদের কিছুটা হলেও ভূমিকা ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লুটেরাদের জন্য দেশটি স্বাধীন করেননি। ' 

একদম ঠিক বলেছেন নঈম নিজাম ভাই। জাতির পিতার আজীবন লড়াই আর ৩০ লাখ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না। অর্থপাচারকারী, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক, শেয়ারবাজার লুটেরাদের জন্য এদেশ আমাদের পূর্বপুরুষ স্বাধীন করেননি। আজ আপনারা আমরা কথা বলার কারণে অনেক লুটেরাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে এবং আগামীতে আরো হবে। এসময় মুখ বন্ধ করলে হবে না, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এ লড়াই অব্যাহত থাকুক। 

এই করোনাকালে যারা লুটপাটে সক্রিয় তাদের বিরুদ্ধে বলা-লেখা আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে। আমরা তরুণ প্রজন্ম আছি আপনার সাথে। শহীদের রক্তে ভেজা দেশে একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এর কাছে ১৮ কোটি মানুষ জিম্মি থাকতে পারে না। 

আজ আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে আমলাদের হাতে। সেই সুযোগে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বও তারা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি আজ সবার চোখ খুলে দিয়েছে। কয়েকদিন আগে দেখেছি যুব মহিলা লীগ নেত্রী পতিতা গ্যাং পাপিয়াদের মাধ্যমে কিভাবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও শতশত কোটি টাকার কাজ নিয়ন্ত্রণ করা হত। তবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরি যে আইনটি রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাভ করে তা কোনোক্রমেই দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য ইতিবাচক নয়। 

আইনটিতে দুর্নীতির অপরাধে অভিযুক্ত কোনো কর্মচারীকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অনুমোদনের বিধানটি দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন না করে। বরং দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে আরও সাহসী করে তুলবে এবং দুর্নীতির প্রসার ঘটাবে। এছাড়া প্রস্তাবিত আইনে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অনুমোদনের বিধান সংযোজন করা হলে তা দুদকের কর্মক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে দেবে বলে সাধারণের ধারণা।

কোনো একজন সরকারি কর্মচারীর পক্ষে এককভাবে দুর্নীতি করা প্রায় অসম্ভব। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির সঙ্গে অধিকাংশ সময়ই প্রতিষ্ঠানের একাধিক স্তরের কর্মচারীরা জড়িত থাকে। কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যদি প্রতিষ্ঠানের উপরের স্তর জড়িত থাকে, সেক্ষেত্রে গ্রেফতারের অনুমতি পাওয়া কি খুব সহজ হবে! সংবাদ মাধ্যমে জানা যায় প্রস্তাবিত আইনে গ্রেফতারের অনুমোদনের ক্ষমতা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ওপরও অর্পণ করা হয়েছে। ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতি হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে গ্রেফতারের অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি কি আদৌ সহজ হবে ?

তাই এই করোনা মহামারীকালে লুটপাট ও দুর্নীতি রুখে দেশকে বাঁচাতে হলে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির সুযোগ দিতে যে আইন করা হয়েছে তা বাতিল করে সময়োপযোগী আইন করতে হবে। অপরাধী সে যেই হোক তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সকল শ্রেণিপেশার মানুষকে সোচ্চার থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লৌহ মানব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। 

তবে দূর্ভাগা জাতি হিসেবে আমরা কেন ভুলে যাই যে, সাদা কাফনের কোনো পকেট থাকে না। তুমি যত বড় ক্ষমতাধর আমলা বা রাজনীতিবিদ হওনা কেন কোনো কিছুই নেয়া সম্ভব নয়। ডাক আসলে যেতে হবে খালি হাতে। কর্মফলে মনে রাখবে এ বসুন্ধরা।

আর কর্মফলে অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি থাকলে তোমার নামের উপর ছড়িয়ে পড়বে শুধুই দুর্গন্ধ, যা কোনো সুগন্ধী দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। আবার ভুলে যাই করোনাভাইরাস কোনো জজ-ব্যারিস্টার, এমপি-মন্ত্রী ,আমলা-কামলা চেনে না। চেনে না কোনো সেনাবাহিনী, র‌্যাব-পুলিশ। একবার মহামারীতে রুপ নিলে পালিয়েও বাঁচতে পারবেন না কোনো মহারথী। 

আজ অজানা নয় এই অচেনা ক্ষুদ্র ভাইরাসের আঘাতে পৃথিবীতে হুংকার দেয়া শক্তিধর দেশও উদাসীনতা ও অবহেলায় নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি। মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। যদিও আমরা দীর্ঘ তিন মাস সময় পেয়েও কাজে লাগাতে পারিনি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্য খাতের লাগামহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে আরও নাজুক অবস্থায় আমাদের দেশ। সাধারণ মানুষের যে কোনো রোগের চিকিৎসা ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ করেছে দীর্ঘ সময়ের অব্যবস্থাপনা। 

অথচ আমরা দেখেছি বিজ্ঞানের আর্শীবাদে পৃথিবী চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। সৃষ্টির নেশায় মত্ত থেকে মানুষ এক এক সময় আবিষ্কার করেছে এক এক ধরনের জিনিস। হাজার বছরের সাধনায় স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিয়েছে এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব দাবি করা মানুষ। সেই সফল মানুষ একটি ভাইরাসের কাছে পরাস্থ পর্যদুস্ত। চিরবিদায়ের সময় যে মমতা বা ভালোবাসা পেত নিজ পরিবার ও স্বজনের কাছ থেকে তাও জুটছে না তার কপালে। এক স্পর্শহীন নির্মম বিদায়ে ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন নিশ্চিন্তপুরের আদি ঠিকানায়।

লেখক : সম্পাদক, ডেইলি জাগরণ ডট কম সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ‘৭১

বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম



এই পাতার আরো খবর