ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

মিথ্যেটা সত্যের পোশাক পরেছে, প্রতিদিন মার খাচ্ছে সত্য
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

যেটাকে আমরা সত্য ভাবছি সেটা কি আসলেই সত্য? নাকি সত্যের পেছনে সত্য আছে, তার পেছনে আরও সত্য আছে।  সত্যের গভীরতাটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে কেউ কি আমরা জানি।  আমরা চোখ দিয়ে সত্যকে যাচাই করি, মন দিয়ে করি না।  চোখ যে অনেক সময় ধোঁকা দিয়ে থাকে সেটা আমরা অনেক সময় ভেবে দেখি না।  গুণী লোকদের প্রায় বলতে শুনছি এখন তো সত্য নেই, মিথ্যার দাপটে সত্য খুব চাপে আছে।  সত্যের নাকি নিঃশ্বাস বন্ধ হবার মতো অবস্থা। কিংবা মিথ্যার ভয়ে সত্য এমনভাবে লুকিয়েছে যে সত্যকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি একটা অবস্থা, হয়তো সব সময় এমন ধারণা মানুষই করেছে।  আগেও সত্যকে নিয়ে সন্দেহ অবিশ্বাস ছিল, এখনো আছে।  বদলেছে শুধু সময়, স্থান, কাল পাত্র।  

একটা বিখ্যাত চিত্রকর্মের ভাবার্থ মনে পড়লো।  যেখানে বলা হচ্ছে যেটাকে আমরা সত্য বলে চোখে দেখছি সেটা নাকি সত্য নয়, সত্যের মুখোশ পড়া মিথ্যে।  এ প্রসঙ্গে ফরাসি একজন চিত্রকর জিনলেওন জেরোমের ১৮৮৬ সালে আঁকা বিখ্যাত একটি ছবি he truth is coming out of the well -এর বিষয়বস্তুকে টেনে আনা যায়। উনিশ শতকের একটি লোককথাকে ভিত্তি করে ছবিটি আঁকা হয়েছিল। গল্পটা ছিল এ রকম : একবার সত্য ও মিথ্যা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করল কিছু বিষয় মীমাংসার তাগিদে। হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে গেল একটা কুয়োর পাশে। মিথ্যা বলল, দেখ, কী পরিষ্কার পানি। চল গোসল করি। বলাবাহুল্য, সত্য বিশ্বাস করেনি মিথ্যার কথা। নিজে পরখ করে দেখল। যখন দেখল কুয়োর জল সত্যিই পরিষ্কার তখন মিথ্যার প্রস্তাবে রাজি হলো। দুজনে পোশাক ছেড়ে নেমে পড়ল কুয়োয়। গোসলের মাঝপথে মিথ্যা কুয়ো থেকে উঠে এসে সত্যের পোশাক পরে পালিয়ে গেল। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিথ্যাকে ফিরতে না দেখে সত্য উঠে এলো কুয়ো থেকে। না, মিথ্যা তো কোথাও নেই, পোশাকও নেই। রাগে অন্ধ হয়ে সত্য বের হলো মিথ্যাকে খুঁজতে কিন্তু নগ্ন সত্যকে দেখে ছি ছি করল সভ্য মানুষ। এমনকি তেড়েও এলো অনেকে। সত্য অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের বোঝাতে না পেরে রাগে-দুঃখে অপমানে ফের কুয়োয় নেমে গেল। তারপর থেকে সত্যকে আর কখনো কেউ দেখেনি। যাকে দেখেছে কিংবা দেখছে সে সত্যের পোশাক পরা মিথ্যা।

সত্য এখন খুব সস্তা দরে হাট বাজারে  বিক্রি হয়।  হয়তো ভাবতে পারেন এটা কি কখনো সম্ভব।  যেটাই মনে হবে অসম্ভব সেটাই এখন সম্ভব।  টাকা দিয়ে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানানো এখন আর কল্পনা নয় বরং এটাই বাস্তবতা।  এভাবে টাকার কাছে সত্য হারছে।  প্রতিদিন হারছে।  হার না মানা মন নেই, কারণ মানুষগুলোই যে মিথ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।  হারতে হারতে সত্য  কি তবে নির্বাসিত হয়েছে।  কে জানে? সময় হয়তো এর উত্তরটা খুঁজে দেবে।  মিথ্যের কাছে মানুষ বিক্রি হচ্ছে।  প্রতিদিন এমন বিক্রি হওয়া ক্রীতদাসের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।  বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনি কি সত্যকে ধারণ করে আছেন নাকি সত্যের মুখোশ পরে মিথ্যের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছেন।  ভয় পাবেন না।  মানুষকে বলার দরকার নেই।  আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করুন।  উত্তরটা হয়তো পেয়েও যেতে পারেন।  মিথ্যের কদর যত বাড়ছে সত্যের মূল্য তত কমছে।  ভাবা যায়।  ভাবতেও লোম খাড়া হয়ে উঠে।  তবুও সেটাই ভাবতে হচ্ছে।  

ধরুন একটা অফিসে সবাই অসৎ।  একজন মাত্র মানুষ রয়েছেন যিনি সৎ থাকতে চান।  অসৎ লোকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চান।  তিনি কি পারবেন।  সত্যের মুখোশ পরা সব অসৎরা একজোট হয়ে নিজেদের প্রমাণ করবেন সত্যবাদী।  আর সত্যবাদী লোকটা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে হয়ে যাবেন মিথ্যাবাদী।  অনেক সময় সংখ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে মিথ্যে বানিয়ে দেই।  কিন্তু সেটা আসলেই কতটা সত্য তা কখনো খতিয়ে দেখার মতো বিবেচনা শক্তি নিজেদের মধ্যে গড়ে নিতে পারি না। হুমায়ুন আজাদ একটা নিখাদ সত্য কথা বলেছেন, ‘এখানে অসৎরা জনপ্রিয়, সৎ মানুষেরা আক্রান্ত"।  এর সাথে তিনি আরও বলেছেন, সত্য একবার বলতে হয়; সত্য বারবার বললে মিথ্যার মতো শোনায়। মিথ্যা বারবার বলতে হয়; মিথ্যা বারবার বললে সত্য বলে মনে হয়। 

২০০১ সালে সাইকোলজিক্যাল রিভিউয়ে একটি গবেষণাপত্র নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জোনাথন হাইড বলেছেন, মানুষ যখন নৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন মানুষের মধ্যে আবেগের প্রভাবটাই বেশি কাজ করে।  মানুষ কোনো একটি  সিদ্ধান্ত নেবার পর অনেক ধরণের যুক্তি দেখাতে পারে। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত যুক্তির ভিত্তিতে হয় না। সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় চোখের পলকে, আর তাতে মুখ্য উপাদান হিসেবে কাজ করে ব্যক্তিগত আবেগ বা চেতনা। আবেগ ভালো তবে অতি আবেগ সব সময় ভালো নয়।  কারণ অতি আবেগ সত্যকে দমন করে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে।  কারণ সেখানে সবার স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থটাই বেশি কাজ করে।  অনেক সময় একপেশে ‘সত্য’ বলার বা দেখানোর কৌশল অবলম্বন করেছে মানুষ।  মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের এই কৌশলের নাম দিয়েছেন ‘পল্টারিং’।  মানুষ যখন একটা ভালো কাজ দিয়ে খারাপ কাজটিকে ন্যায়সঙ্গত করার চেষ্টা করে সেটাও ‘পল্টারিং’।  

যেমন দুর্নীতির টাকা দিয়ে কেউ যদি মানুষের চিকিৎসার জন্য একটা হাসপাতাল তৈরি করে দেয়, তবে তার টাকাকে কি সাদা বা সততার টাকা বলা যাবে ? কখনই না।  একটু ভেবে দেখলেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন।  মানুষের মিথ্যেকে কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে নিজেকে নীতিমান আর সৎ বানানোর এই কৌশল নতুন নয়, অনেক পুরাতন।  হয়তো আপনার আমার আশপাশের মুখোশ পরা চেনা মুখগুলোর মধ্যে এমন অনেক মানুষ ঘাপটি মেরে বসে আছে।  চারিদিকে তাদের জয় জয়কার হচ্ছে।  কিন্তু পুরোটাই একটা ধোঁকা।  অনেকে বলে থাকেন সব কিছুই নাকি এখন মিথ্যের শক্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠছে।  সত্য প্রতিদিন মার খাচ্ছে, দগ্ধ হচ্ছে, নগ্ন হচ্ছে।  চোখের জলে থমকে দাঁড়াচ্ছে, পথ হারাচ্ছে।  মিথ্যের এতটা শক্তির তাণ্ডবেও আমি এই মিথ্যার সত্যটাকে বিশ্বাস করতে চাই না।  কারণ সততার শক্তি যদি ভিতর থেকেই প্রাণশক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে তবে মিথ্যেরা কখনো টিকে থাকতে পারবে না।  আর তা যদি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে  তবে মিথ্যেরা পরাভূত হবেই হবে।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ লেখা কবিতাটির মতো বলে উঠুক সবার মন : আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ ক'রে দিতে।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক



এই পাতার আরো খবর