ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

জীবনের মুখগুলি
কবি বেলাল চৌধুরী
কবি বেলাল চৌধুরী

আমাদের সাহিত্যাঙ্গণে তাঁর চেয়ে বর্ণাঢ্য জীবন বোধ করি খুব কমজনই যাপন করতে পেরেছেন। এর তুলনীয় হতে পারে সৈয়দ শামসুল হকের বর্ণাঢ্য জীবন। যৌবনের প্রদোষকালে তিনি ঘর ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন পশ্চিমে। তবে পশ্চিম বলতে আমরা যা বুঝি, তিনি সে পশ্চিমে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন পশ্চিম বাংলায়, বাংলা সাহিত্যের রত্নভাণ্ডার যেখানে। সৈয়দ হকও পশ্চিমে গিয়েছিলেন, সেটাও ভারতবর্ষের সীমানার ভেতরেই।

কলকাতা তখন অনেকটা দূরের পথই ছিল। ঢাকার সাথে আজ যে যোগাযোগ কলকাতার সেসময়ে এর সিকিভাগও ছিল না। তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন জাহাজে চড়ে, খালাসি হয়ে। বাঙালি ঐ একই কায়দায় লন্ডন ও নিউইয়র্ক পৌঁছেছে। তিনি পৌঁছেছিলেন প্রতিবেশী রাজ্যে- এক ভাষা ও সংস্কৃতির হয়েও যারা ছিল দূরের। দুই বাংলার সংযোগহীনতার সেইসব দিনে কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন সংযোগ। কলকাতা তাকে ঘরের ছেলের মতোই গ্রহণ করেছিল। আজন্ম বাউল স্বভাবের এ কবি দিনরাত কাটিয়েছেন পশ্চিমের সব রাঘববোয়ালদের সাথে, যারা ছিল তার বন্ধু। সেখানকার লেখককুলে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত, অনেকে ভাবতেন তিনি পশ্চিম বাংলারই লোক। তাঁর বন্ধু তালিকাটি ঈর্ষাজনক। কে নেই সেখানে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কমল কুমার মজুমদার, অরুণ ভাদুরী, দেবেশ রায় এবং আরো অনেকে। তুমুল আড্ডায় কেটেছে সেসব দিন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বহুপৃষ্ঠায় লিখিত সেসব দিনরাত্রির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে তাঁর নাম। কলকাতায় বর্ণময় সময় কাটানোর সময় তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত 'কৃত্তিবাস' পত্রিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং কিছুকাল এর সম্পাদনা করেন।

তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশের সূত্র ধরে। সেটা সত্তর দশকের শেষভাগ। কলকাতা থেকে ফিরে তিনি 'সচিত্র সন্ধানী' পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তখন বিপুল জনপ্রিয় সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা'র পাশাপাশি ইত্তেফাক থেকে সাপ্তাহিক 'রোববার' ও গাজী গ্রুপ থেকে 'সচিত্র সন্ধানী' প্রকাশ হতো। এখনকার মতো এত পত্রিকা তখন ছিল না। আশার ব্যাপার ছিল, তিনটি সাপ্তাহিকই সাহিত্য ছাপতো। আমি কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ি। সেটা ১৯৭৭ সাল। কবিতা তখন কদমফুলের মতো মাথার বৃক্ষে ফুটতো। তিনটি কবিতা ডাকে (তখন ডাকের যুগ ছিল) পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সচিত্র সন্ধানীর ঠিকানায়। কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন রাজ্জাক স্যার, তিনি জানতেন আমি কবিতা লিখি। স্যার বললেন, 'কামরুল সচিত্র সন্ধানীতে একটি কবিতা দেখলাম, তোমার নামে নাম। তোমার নাকি?' শুনে আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠেছে, আমি জানি ওটা আমারই। কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে পত্রিকা অফিসে ছুটে যাই। বেলাল ভাইকে সেই প্রথম দেখি। আমাকে দেখে বললেন, 'আরে, তুমি দেখি বাচ্চা ছেলে। কিন্তু তোমার কবিতা তো ম্যাচিউর।' আরও বললেন, 'এখানে একটু আগে আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন, তিনিও তোমার কবিতাটির প্রশংসা করেছেন।' আমাকে আহ্লাদিত করে আরও জানালেন, আমার আরও একটি কবিতা তিনি ঈদ সংখ্যার জন্য নির্বাচিত করেছেন। কবিতা লেখার সেই প্রভাতলগ্নে এ ছিল অভাবিতপূর্ব। আমি যে কবিতা লেখা ছাড়তে পারিনি তার মস্ত কারণ এ ঘটনা। আজন্ম তাঁর কাছে ঋণী আমি। সে ঋণের কিছুই শোধ হলো না। কেবল ১৯৯২ সালে প্রকাশিত আমার দ্বিতীয় কাব্য 'প্রান্তসীমা অনন্তদূর' তাকে উৎসর্গ করেছিলাম।

পড়াশোনার জন্য বেশ কিছু বছর আমি ভারতে কাটিয়েছিলাম। সেসময়ে বেলাল ভাই ও বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গণের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ফিরে এসে তাঁর খোঁজ করি। তখন তিনি 'ভারত বিচিত্রা'র সম্পাদক। ধানমণ্ডির ৩ নম্বর সড়কে ভারতীয় দূতাবাসের অনেকগুলো ভবনের একটিতে 'ভারত বিচিত্রা'র সম্পাদকীয় অফিস ছিল। এক দুপুরে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে বেলাল ভাই বললেন, ' আরে তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে? তোমাকে আমি বহুদিন ধরে খুঁজছি।' কী স্নেহশীল মানুষ ছিলেন ভেবে এখন আমার চোখ জলে ভরে উঠছে। 'ভারত বিচিত্রা'র পাতায় তিনি অনেক তরুণের প্রথম কবিতাটি ছেপেছেন। এদেশের সাহিত্যাঙ্গণে বিপুল সংখ্যক কবি-লেখকের আত্মপ্রকাশের জনক বলা যায় নিরন্তর স্নেহশীল কবি বেলাল চৌধুরীকে।

তিনি যত কবিসভায় যোগ দিয়েছেন, যত কাব্য আড্ডায় সময় কাটিয়েছেন, তত কবিতা লেখেননি। কবিতা লেখায় আশ্চর্য সংযমী এ কবি দারুণ গদ্য লিখতেন। তাঁর স্মৃতিকথামূলক লেখাগুলো ষাট ও সত্তর দশকের বাংলা কাব্যভুবনের বিশ্বস্ত দলিল। অমায়িক, আমুদে ও উদারস্বভাবের কবি বেলাল চৌধুরী তাঁর স্নেহ ও প্রশ্রয় দিয়ে অগুণিত কবি ও মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। সেখানে তিনি চিরকাল থাকবেন। তাঁর মৃত্যু নেই! বিডি-প্রতিদিন/শফিক

 



এই পাতার আরো খবর