ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

চীন করোনা মহামারির মধ্যেই বাজাল যুদ্ধের দামামা
অনলাইন ডেস্ক

সমাজতন্ত্রের মুখোশে অধার্মিক চীন জন্ম দিয়েছে নয়া সাম্রাজ্যবাদের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি চীনই দায়ি করোনা মহামারির মধ্যেও যুদ্ধের দামামা বাজানোর জন্য। পাকিস্তানকে বগলদাবা করার পর এখন চীনের লক্ষ্য আরও বহু দেশে আধিপত্য বিস্তার। লাদাখে চীনের আসল স্বরূপ ফুটে উঠেছে। মানবসভ্যতার বিরোধী চীন নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সীমান্তে বারবার উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। বিনা প্ররোচনায় লাদাখে ২০ জন ভারতীয় সেনাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

আসলে চীন গোটা দুনিয়ায় বিস্তার করতে চায় নিজেদের সাম্রাজ্য। তাদের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচি আসলে নয়া সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপ।  কোভিড-১৯ জন্য বেশ বিপাকে চীন।  এই পরিস্থিতিতে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে চীন দুনিয়ার দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরাতে চাইছে।  ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছকে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে বিভিন্ন দেশে। অন্যদিকে ভারত এখনও পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর আমলে গৃহীত পঞ্চশীল নীতিতেই অটল। তাই চীনের লালফৌজের হাতে ২০ জন ভারতীয় সেনার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বদলীয় বৈঠকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, 'ভারত সাংস্কৃতিকভাবে একটি শান্তিকামী দেশ। ভারতের আদর্শ মন্ত্র হল- লোকা : সমাস্ত : সুখিনো ভবন্তু। আমরা প্রত্যেক যুগে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে মিলেমিশে কাজ করছি।' 

১৯৫৪ সাল থেকেই  ভারতের জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি পঞ্চশীলের সারমর্মই হলো,  অন্য দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা। অনাক্রমণ নীতি আগলে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে পারস্পরিক সাম্য ও সহযোগিতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও কথা বলে সমস্যার সমাধান করে আসছে। কিন্তু চীন ঠিক উল্টোপথে হাঁটছে চিরকাল। তিব্বত ও হংকং তার বড় প্রমাণ। চীনের বর্বরোচিত দখলদারিতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

লাদাখ সীমান্তে একতরফাভাবে  দ্বিপাক্ষিক চুক্তি লঙ্ঘন করেছে চীনের লালফৌজ। ১৯৯৩ সালে উভয় দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) টপকে কেউ  অন্য পারে যাবে না। ১৯৯৬ সালে ঠিক হয়, সেনারা মুখোমুখি হলে আলোচনায় বসবেন। ২০০৫-এর সিদ্ধান্ত, কোনও পক্ষই গুলি চালাবে না। ২০১৩-য় ঠিক হয়,  অন্য পক্ষের টহলদার সেনাকে অনুসরণ করা হবে না। কিন্তু কোনও শর্তই মানেনি চীনের লালফৌজ। বরং সীমান্তে ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। 

আসলে করোনা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ কমাতেই চীন বাজিয়েছে যুদ্ধের দামামা।  মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিশ্চিত, চীনের উহানে পরীক্ষাগার থেকেই ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবিতে সোচ্চার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনও। সবার দৃষ্টি ঘোরাতেই সীমান্ত নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে চীন সরকার। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তবের সাফকথা, ‘চীনের  এই হামলা পূর্ব নির্ধারিত ও পরিকল্পিত। দু’পক্ষের সেনার মৃত্যুর জন্য দায়ী চীন।’ তার এই বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে আন্তর্জাতিকস্তরেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও  ফ্রান্স, জার্মান, জাপান, মলদ্বীপ প্রকাশ্যে চীনা আক্রমণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে চাপ বাড়াচ্ছে বেজিংয়ের উপর। পূর্ব এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিষয়ক মার্কিন বিদেশ দফতরের অতিরিক্ত সচিব ডেভিড স্টিলওয়েল বলেছেন, ‘হংকং ও ভারতের উপর চীনা পদক্ষেপ সমর্থনযোগ্য নয়।’ 

অতিরিক্ত সচিব স্টিলওয়েল পম্পেওর বলেন, ‘আগেও সীমান্তে চীনা আগ্রাসন ধরা পড়েছে। ২০১৫ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং-এর ভারত সফরের পর সীমান্তে চীনের আগ্রাসন অতীতের তুলনায় আরও বেড়েছে।’  

অথচ ভারত চিরকালই অন্যান্য প্রতিবেশীদের মতো  চীনের সঙ্গেও বন্ধুত্ব চেয়ে এসেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের স্থায়ী সদস্য পদের পক্ষেও কাজ করেছিল দিল্লি। ১৯৫০ চামদোর যুদ্ধে চীনের তিব্বত দখলের পরও ভারত পঞ্চশীল নীতিকেই আগলে ধরে। চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই নিজেও নেহরুর পঞ্চশীল নীতির প্রশংসা করেছিলেন। সেটা ছিলো ছলনা। চীন বরাবরই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব পোষণ করেছে। তাই ১৯৬০ সালে নেহেরু সীমান্ত বিরোধ মেটাতে ঝৌ এনলাইয়ের সঙ্গে আলোচনা বসলেও ভারতের কূটনৈতিক দৌরাত্ম ব্যর্থ হয়। ভারতে চীনা আক্রণের সূত্রপাত হয় ১৯৬২ সালে। ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা এবং চো লা এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর অনুপ্রবেশকারী লাল ফৌজকে বিতাড়িত করেছিল ভারতীয় সেনারা। ১৯৭৫ সালে অরুণাচল প্রদেশের টুলুং লা এলাকায় আসাম রাইফেলস এর টহল বাহিনীর চার জওয়ানকে খুন করেছিল চীনা সেনারা।  তবু ভারত চিরকাল সীমান্তে শান্তিই চেয়েছে।  

আসলে মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো চীন সব সময়ই ভৌগলিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে মরিয়া। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চীনের ভূমিকা সবারই জানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন  পাকিস্তানকে ‘উপহার’ হিসেবে পাঠিয়েছিল ২৫৫টি ট্যাংক, এক স্কোয়াড্রন ইল-২৮ বিমান ও ২০০ সামরিক প্রশিক্ষক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অবশ্য ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করেছে চীন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ফের বণিকের ছদ্মবেশে বাংলাদেশের শাসনদণ্ড দখল করতে চাইছে না তো চীন? ইতিমধ্যেই কিন্তু পাকিস্তানে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে তারা অনেকটাই সফল। এখন চাইছে তাদের মুদ্রা ইহান চালু হলেই কেল্লাফতে। পাকিস্তান পুরোপুরি তাদের কব্জায় চলে আসবে। তাই বিরোধিতাও শুরু হয়েছে ইসলামাবাদে। 

রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সখ্যতা সবার জানা। আসলে মিয়ানমারের সমুদ্র ঘাঁটি আর বাংলাদেশের বাজার দখল করতে চায়  চীন। কোনও আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বে বিশ্বাসী নয় কমিউনিস্ট দেশটি। চাইছে মহাজনি কারবার। ঋণের ফাঁদে আটকাতে চায় বাংলাদেশকে। দখল করতে চায় বাজার। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারেরও বেশি। সম্প্রতি, বাংলাদেশকে চীনের পক্ষ থেকে মোট ৮ হাজার ২৬৫টি পণ্যকে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়। ১ জুলাই থেকে নতুন সুবিধা কার্যকর হবে। এটা মুদ্রার দৃশ্যত একটি দিক, অন্য দিকটি ভয়ঙ্কর। নিজেদের আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখতে ঋণের বোঝায় বাঁধতে চাইছে বাংলাদেশকে। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রটাও নিজেদের দখলে আগেই নামিয়েছে। ধর্মচর্চার বিরোধী এই চীন থেকেই আসে বাংলাদেশের  ৮০ শতাংশ সমরাস্ত্র। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বও বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ চীন সমাজতান্ত্রিক মুখোশে বাড়াতে চাইছে নিজেদের সাম্রাজ্য।

গণতান্ত্রিক ভারতের লক্ষ্য শুধু নিজেদের অখণ্ডতা বজায় রাখা। প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতিতে বিন্দুমাত্র টোল খায়নি। বিপদে-আপদে প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়িয়েছে চিরকাল। হংকং বা তিব্বতের মতো কোনও দখলদারি ভারতের নেই। সুশৃঙ্খল ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রতিবেশীর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়লেও ঔপনিবেশিকতায় বিশ্বাসী নয়। কিন্তু চীনের লালফৌজ ভারতের অনাক্রমণ নীতিকে দুর্বলতা মনে করে বারবার প্ররোচিত করছে। চীনের ওই মনোভাবই সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য ভবিষ্যতে বিপেদর কারণ হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় অশান্তি পাকিয়ে সেই অশান্তির আগুনে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে মরিয়া চীন। তাই তাদের বণিকের ছদ্মবেশে ভালোমানুষির মুখোশ থেকে বাংলাদেশেরও সতর্ক থাকা জরুরি। মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশে ভারত সার্বিক সহযোগিতা করলেও সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল চীন। এখনও তাদের পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক



এই পাতার আরো খবর