ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আসিয়া বিবি থেকে শাগুফতা
পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননা আইনের বলি হবে আর কতোজন?
হাসান ইবনে হামিদ
প্রতীকী ছবি

২০১৩ সালের এক বিকেল, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গজরা শহরের স্থানীয় ইমামের ফোনে ইসলাম ধর্মের নবী সম্পর্কে অপমানজনক শব্দ সম্বলিত একটি বার্তা আসে। ইমামের ফোনে এই বক্তব্য আসার সাথে সাথেই তা নিয়ে চর্চা শুরু হয় পুরো শহরে। কেননা এটা ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননা আর পাকিস্তানে ব্লাসফেমির অভিযোগ খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। 

এই আইনের অধীনে কোনও ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করার জন্য কখনও কখনও শুধু অভিযোগই যথেষ্ট হয়। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চাপে আদালত অভিযোগের সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়ে দেয়। এমনকি, এই অভিযোগে অভিযুক্ত আসামির পক্ষে কেউ মামলা লড়তে চাইলে তাকেও হত্যা করা হয়। 

তাই কে বা কারা এই বার্তা দিয়েছে তা দ্রুতই খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেয়া হয়। অবশেষে দেখা যায়, যে সিম নাম্বার থেকে এই মেসেজ এসেছে তা সেই শহরেই থাকা শাগুফতা কাউসার নামে একজনের নামে রেজিস্টার্ড। শাগুফতা কাউসার একটি খ্রিস্টান মিশনারিজ স্কুলে ক্লিনারের চাকুরি করতেন। তার স্বামী শাফকাত ইমানুয়েল প্যারালাইজড অবস্থায় আছেন, এই দম্পতির চার সন্তান। তাই পুরো পরিবারের দায়িত্ব একাই সামলাতেন শাগুফতা কাউসার। 

শাগুফতা এতো বোকা ছিলেন না যে এমন মেসেজ লিখে কোন ইমামের ফোনে সেই মেসেজ দিয়ে নিজের পরিবার মৃত্যু ডেকে আনবেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা, উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী শাগুফতা, তার স্বামী ও সন্তানদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালায়। দ্রুততার সাথে পুলিশ শাগুফতা ও তার অসুস্থ প্যারালাইজড স্বামীকে গ্রেফতার করে। শাগুফতা শাফকাত দম্পতির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আসার সাথে সাথেই তারা পুলিশকে বিস্তারিত খুলে বলে। 

যে ইমাম অভিযোগ আনে তাকেও জানায় যে, তারা পড়ালেখা জানেন না তাই ইংরেজি মেসেজ তারা কীভাবে লিখবেন? এমনকি, শাগুফতার ন্যাশনাল আইডি কার্ড চুরি হয়ে গিয়েছিলো এবং তাকে ফাঁসানোর জন্য কেউ এটা করেছে বলেও পুলিশের কাছে তাদের জবানবন্দি দেয়। কিন্তু পুলিশ কোনও কথা শুনতেই রাজি ছিল না, ভয়াবহ টর্চার করে প্যারালাইজড শাফকাতের পা ভেঙ্গে দেয়।  পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল পাকিস্তানের আদালতে তাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়, বর্তমানে তা হাইকোর্টে বিচারাধীন। বিগত ছয় বছর যাবত শাগুফতা-শাফকাত দম্পতি জেলে আছেন। কিন্তু এই ছয় বছরে শাগুফতা-শাফকাত কেউ কারও দেখা পাননি। ২৫০ কিলোমিটার দূরে তাদের অবস্থান। শাফকাত ফয়সালাবাদ ডিস্ট্রিক্ট জেলে আর শাগুফতা মুলতান জেলে আছেন, যেখানে আসিয়া বিবি ছিলেন। 

'ব্লাসফেমি' বা ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে আইন রয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশেই, অনেক দেশে কাগজে-কলমে আইন থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগের উদাহরণ বিরল। কোনও বিশেষ ধর্মের বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে 'ব্লাসফেমি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কোনও কোনও দেশে 'অ্যাপোস্ট্যাসি'কেও দণ্ডনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 'অ্যাপোস্ট্যাসি'র মাধ্যমে বিশেষ কোনো ধর্মকে অস্বীকার করা বা স্বধর্মত্যাগ বোঝানো হয়।

পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের অধীনে যারা ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে তাদেরকে মৃত্যুদন্ড সহ কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। ধর্ম সম্পর্কিত অপরাধের আইন ১৮৬০ সালে ভারতের বৃটিশ শাসকদের দ্বারা প্রথমবার বর্ণিত হয়। পরে ১৯২৭ সালে এটিকে আরো বিস্তৃত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান এই আইনগুলোকে গ্রহণ করে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে সেনাশাসক জিয়াউল হকের সময় এই আইনে আরো বেশ কয়েকটি ধারা সংযুক্ত করা হয়। 

জেনারেল জিয়াউল হক পুরনো আইনটিকে 'ইসলামিকরণ' করে পাকিস্তানের সুন্নি মুসলিম ও আহমাদিয়া সম্প্রদায়কে আইনিভাবে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে আহমাদিয়াদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এবং এর পর থেকে ব্লাসফেমি আইনের মাধ্যমে আহমাদিয়া গোষ্ঠীর উপর চলে অবর্ণণীয় নিপীড়ন। 

এছাড়া আইন সংযুক্ত নতুন ধারায় ইসলামের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে অবৈধ করা হয়, 'ইচ্ছাকৃতভাবে' কোরআন অপবিত্র করলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড শাস্তির বিধান আনা হয় এবং পরে নবী মুহম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধানের বিষয়গুলো সংযুক্ত করা হয়। ব্লাসফেমির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রায় ৪০ জনকে প্রাথমিকভাবে  এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে পাকিস্তানে। 

ব্লাসফেমির অভিযোগে পাকিস্তানের খ্রিস্টান নারী আসিয়া বিবি প্রায় দশ বছর কারাভোগ করার পর ৭ নভেম্বর ২০১৮ সালে মুক্তি পেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। আসিয়ার মামলাটি নিয়ে পাকিস্তান গভীর বিভক্তি তৈরি হয়েছিল। একদিকে ব্লাসফেমি আইনের পক্ষে শক্ত জনসমর্থন অন্যদিকে বিশ্ব গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের অব্যাহত চাপ। 

পাকিস্তানের বিপুল জনসমর্থনকে উপেক্ষা করে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আসিয়া বিবির দণ্ডাদেশ পরিবর্তিত হয়। আসিয়া বিবিকে কারাগার থেকে ছাড়া হলে তা পাকিস্তানে ব্যাপক সংঘাত তৈরি করে এবং আসিয়া বিবি বাধ্য হন দেশত্যাগ করতে। সেখানেও তাকে দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায়। আসিয়াকে হত্যা করার আহ্বান জানিয়ে এক ভিডিও পোস্ট করে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা। এখনও নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আসিয়া। 

এরপরেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাকিস্তানের এই আইনের সার্বিক বিষয় উঠে আসে। এক আসিয়া বিবির মামলাতেই পাকিস্তানের উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, সেখানকার সমাজ ও প্রশাসনের মূল চরিত্র ফুটে উঠে। 

২০০৯ সালের জুন মাসে লাহোরের কাছে শেখুপুরা এলাকায় ফল পাড়তে গিয়ে অন্য নারীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে চার সন্তানের জননী আসিয়া নবী (সাঃ)-কে নিয়ে কটুক্তি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে আসিয়াকে তার বাড়িতে মারধরও করা হয়। মারধরের এক পর্যায়ে আসিয়া ব্লাসফেমির স্বীকারোক্তি দিয়েছে বলে প্রতিবেশীরা অভিযোগ করে। আসিয়াকে পুলিশ গ্রেফতার করে।  

প্রতিবেশীদের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে ২০১০ সালে আদালতের এক রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। গত ১০ বছর ধরে তাকে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে দিন কাটাতে হয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছেন আসিয়া। অর্থাৎ প্রতিবেশীদের সাথে ঝগড়া থেকেই ক্রোধের বশে আসিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়। তার মানে সমাজে এই ধারণা পোক্ত আছে যে, কারো প্রতি জেদ বা ক্ষোভ প্রশমন করতে চাইলে ব্লাসফেমি আইনে মামলা দাও বাকিটা রাষ্ট্র ও উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী করবে।   পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে কথা বলাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। আসিয়া বিবির মামলার দিকে তাকালে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। ২০০৯ সালে পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসিয়া বিবিকে দেখতে যান৷ কারাকক্ষ থেকে বের হয়ে পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনকে ‘কালো আইন' বলে আখ্যা দেন। ২০১১ সালে এই বক্তব্যের জন্যই তাকে প্রাণ দিতে হ। একই কারণে প্রাণ হারান সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও। 

ব্লাসফেমি আইনের সমালোচনা করে আসিয়া বিবির পক্ষে কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। গভর্নরের হত্যাকারী ছিল তারই দেহরক্ষী মুমতাজ কাদির। সুষ্ঠ বিচার শেষে মুমতাজ কাদরিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। লাখ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী এবং নিরক্ষর সহানুভূতিপ্রবণ জনতা এই ঘাতককে সমর্থন করেছিল। তাকে শহীইদের মর্যাদা দিয়ে ‘জান্নাতের দরজা প্রশস্ত' বলেও মন্তব্য করে অনেকে।

২০১৫ সালে যখন হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়, পুরো পাকিস্তানে ছিল শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা। এক সপ্তাহ ধরে উগ্রবাদীরা রাজধানী ও অন্যান্য নগর স্তব্ধ করে দিয়ে রাজপথ কাঁপিয়েছে৷ এ ধরণের আইনের অপব্যবহার যতটা উদ্বেগজনক পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ততটাই উদ্বেগজনক হল সমাজের ভেতরে তাঁর প্রভাব। 

ভয়াবহ তথ্য হলো এই যে ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৩৫ জন অভিযুক্ত হওয়ার পরপরই খুন হয়েছেন। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানের সমাজে এই আইন কেবল যে সমর্থনপুষ্ট তাই নয়, এর যে কোনো ধরণের বিরোধিতা করলে তাকেও বড় ধরণের মাশুল গুনতে হয়। আসিয়া বিবির মামলা ছাড়াও ১৯৯৭ সালে লাহোরে আরিফ ইকবাল হোসেন ভাট্টি নামের একজন বিচারক ব্লাসফেমির অভিযোগ থেকে দু'জনকে খালাস দেওয়ার পর তার অফিস কক্ষে নিহত হন।

পাকিস্তানে প্রচলিত ব্লাসফেমি আইনে যে মানবাধিকার বিরোধী, এমন কি মানবিকতা বিরোধী সেটা বিভিন্ন গবেষণায় স্পষ্ট। উদাহরণ দিলেই তা বোঝা যায়। শাগুফতা কাউসার ও শাফকাত দম্পতির ঘটনা এখানে নতুন কিছু নয়। ২০১২ সালে রিমশা মশিহ নামের এক মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ তার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির মামলাই এনেছিলো।

৩৩ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জুনাইদ হাফিজকে ২০১৩ সালের মার্চে গ্রেফতার করা হয় ব্লাসফেমি আইনে। বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডের আসামি হিসেবে জেলে আছেন। ২০০৩ সালে আনোয়ার মাসিহকে আটক করা হয় এই একই অভিযোগে, ছয় বছর তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। কিন্ত আনোয়ার ড্রাগ আসক্ত এবং মানসিকভাবে অসুস্থ। 

১৯৯৬ সালে জয়বুননেসাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্ত গ্রেফতারের পরই একটি মেডিক্যাল বোর্ড বলেছিল যে সে মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না জয়বুন নেসা। ২০১১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ সামিউল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে এক পরীক্ষার খাতায় সে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করেছে। এখনও সামিউল্লাহর বিচার হয়নি।  দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে আসা কয়েকটি মামলায়ও উঠে এসেছে যে অন্যান্য আইনে অভিযুক্তদের শাস্তি বিধানের জন্য যে ধরণের উঁচু মাত্রার সাক্ষ্য প্রমাণ চাওয়া হয়, এই আইনের ক্ষেত্রে তা হয়না । পাকিস্তানের এই আইনটি যে পাকিস্তানের প্রচলিত অন্য আইনের সাথেও অসংগতিপূর্ণ সেটাও বহুভাবে প্রমানিত।

শাগুফতা-শাফকাত দম্পতির মামলা বর্তমানে ফাইনাল হেয়ারিং এর জন্য লাহোর হাইকোর্টে রয়েছে। খুব শীঘ্রই এই মামলার রায় আসবে, করোনা পরিস্থিতির কারণে রায়ের দিনক্ষণ কিছুটা পেছানো হয়েছে। শাগুফতার আইনজীবী সাইফুল মালিক একইসাথে আসিয়া বিবির মামলাও লড়েছিলেন।  তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন, এই মামলাটি আসিয়া বিবির মামলার চাইতেও হালকা অর্থাৎ এই মামলার উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। যে সিম কার্ড তার নামে রেজিস্টার্ড তা তিনি ব্যবহার করতেন না এমনকি যে ইংরজি ভাষায় মেসেজ গিয়েছে তা অভিযুক্তদের পক্ষে লেখা সম্ভব নয় কারণ তারা অশিক্ষিত ছিলো। 

তাছাড়া ২০১৪ সালের রায়ে আদালত কক্ষে সরাসরি বিচারকদের ভয় দেখানো হয়েছিল। কোরআনের রেফারেন্স টেনে শাগুফতা-শাফকাত দম্পতিকে মৃত্যুদণ্ড দিতে বলা হয়েছিলো আর যদি তা না করা হয় তবে ব্লাসফেমি পক্ষের আইনজীবী বলেছিলেন, 'শাগুফতা-শাফকাত দম্পতিকে মৃত্যুদণ্ড না দেয়া হলে মুমতাজ কাদিরের মতো গাজী হতেও তারা প্রস্তুত'। 

তার মানে ব্লাসফেমি আইনের বিপক্ষে বলা পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরকে মুমতাজ কাদির যেভাবে হত্যা করেছিলো সেভাবে তারা বিচারককে হত্যা করতে প্রস্তুত যদি রায়ে মৃত্যুদণ্ড না আসে। তাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তা চেয়েছেন শাগুফতা কাউসারের আইনজীবী সাইফুল মালিক। রায়ে যেনো তাদের অব্যাহতি দেয়া হয় সেজন্য সবারই উচিত শাগুফতা-শাফকাতের পক্ষে কলম ধরা এবং পাকিস্তানের এই বর্বর আইনের বিরুদ্ধে কথা বলা। 

ভিন্ন মত ও ধর্মাবলম্বীদের নিষ্পেষণমূলক এই ব্লাসফেমি আইন পাকিস্তানে একদিনে তৈরি হয়নি। রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা, আহমাদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা, উগ্রপন্থীদের প্রতি রাষ্ট্র এবং সমাজের পৃষ্ঠপোষকতার পথ ধরেই তা বিকশিত হয়েছে। 

শাফকাত-শাগুফতার মত নাগরিকরা যখন অধিকার বঞ্চিত হয়, তখন তা কেবল আইনি বিষয় থাকেনা। তা হয়ে ওঠে নাগরিকের অধিকারের প্রশ্ন। পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা থেকে কেবল এই শিক্ষাই যথেষ্ট নয় যে ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে, এটাও বোঝা দরকার যে, আইনের চোখে সকলের সমতা নিশ্চিত না করে গণতন্ত্রের আশা কল্পনা মাত্র। এটাও বোঝা দরকার যে, দল বা গোষ্ঠির প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যত তৈরি করে। 

আসিয়া বিবি ইস্যুতে পাকিস্তানে ব্লাসফেমি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হলেও তা থেকে কোনো রকম আশু পরিবর্তন আশা করার কারণ নেই। অতীতের মতো আবারও রাজনীতিবিদরা তাদের জন্য অনুমেয় সহজ পথটিই বেছে নেবেন। তাছাড়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজেই ব্লাসফেমি আইনের কট্টর সমর্থক। সুতরাং ব্লাসফেমি আইন নিয়ে খুব বেশি রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন আশা করা যায়না। তবে বিনা অপরাধে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যেনো কারো সময় বাধা না পরে সেই আশা থাকবে আমাদের। 

পাকিস্তানের উচ্চ আদালত শাগুফাত-শাফকাত দম্পতিকে মুক্তি দিক, মানবতার পক্ষে আসুক এই রায়। বর্বর কালো আইন ব্লাসফেমি থেকে রেহায় পাক শাগুফতা কাউসার ও শাফকাত ইমানুয়েল। আমরা সবাই যদি দাবি তুলি, তবে নিশ্চয়ই মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচানো সম্ভব শাগুফতা-শাফকাত দম্পতিকে। হয়তোবা এমন একদিন আসবে, আমাদের সবার দাবির মুখে পাকিস্তান রাষ্ট্র এই বর্বর আইন তুলে নিয়ে বর্তমান পৃথিবীর সভ্য আইনে ফিরে আসবে। ব্লাসফেমি নামক কালো আইনের অস্তিত্ব থাকবে না পৃথিবীর বুকে।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। 

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ তাফসির



এই পাতার আরো খবর