ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

দেশীয় পর্যটনের বিকাশ ঘটানোর সুবর্ণ সুযোগ
মোঃ কামরুল ইসলাম

আমরা শুদ্ধাচারের কথা বলি কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি সারাবিশ্বকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে শুদ্ধাচার কি তা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকের দুর্বলতাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তুলে এনেছে। পরনির্ভরশীলতাকে দূরে ঠেলে আত্ননির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯। বিশ্ব বাণিজ্যের ২/১টি খাত ছাড়া সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো বার্ষিকী পরিকল্পনাই কাজে আসেনি। স্বল্পমেয়াদী দীর্ঘমেয়াদী কিংবা অতিদীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনাই কোভিড এর কাছে টিকে উঠতে পারেনি।

উন্নত বিশ্ব কিংবা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ অথবা আফ্রিকার অনুন্নত দেশসমূহ কেউ কোভিড-১৯ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। পরম পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, ভারত কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশ করোনাভাইরাসের কাছে পর্যদুস্ত। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসা। অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে সারবিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থা।

কোভিড-১৯ এর কারণে বিমান চলাচল ও পর্যটন খাত চরমভাবে বিপর্যস্ত। যেসব দেশের আয়ের প্রধান খাতই পর্যটন, সেখানে অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় হওয়ার শঙ্কায়ও পড়েছে। সারাবিশ্বের আকাশপথ অনেকটা লকডাউন ছিলো। ধীরে ধীরে সেই আকাশ পথে চলাচল শুরু হয়েছে। বিভিন্ন শর্তারোপের মাঝেই এয়ারলাইন্সগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি মাথায় নিয়ে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে ব্যবসার ভিন্নতার মাঝেই আয়ের উৎস খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করছে। সারাবিশ্বে পর্যটনখাত একটি অন্যতম শক্তিশালী শিল্পখাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো। বাংলাদেশে ইনবাউন্ড আউটবাউন্ড ট্যুরিজমকে কেন্দ্র করে শতশত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলো, যেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিলো। করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। গত এক দশকে বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বাংলাদেশে পর্যটক শ্রেণি গড়ে উঠে। যারা সুযোগ পেলেই দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের বিভিন্ন আকর্ষণীয় গন্তব্যে ভ্রমণ করার অভ্যাস গড়ে তুলে। ভ্রমণ করার পরিকল্পনার সাথে আয়ের সক্ষমতাও একটা বড় ব্যাপার।

বিভিন্ন এয়ারলাইন্স এর প্রতিযোগিতামূলক ভাড়ার কারণে, সহজলভ্য ট্যুরিস্ট ভিসা প্রাপ্তিও একটা বড় বিষয়। একটা সময় বাংলাদেশে পর্যটন বলতেই আমরা বুঝতাম কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত অথবা সিলেটের চা-বাগান কিংবা সুন্দরবন। সেটাও আবার শীতকাল কেন্দ্রিক। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও শুধুমাত্র শীতকালে সপ্তাহে দু’টি কিংবা তিনটি ফ্লাইট পরিচালিত হতো ঢাকা থেকে কক্সবাজার। হাতে গোনা কিছু ভালো মানের হোটেল (বেশিরভাগই পর্যটন কর্পোরেশন পরিচালিত) ছিলো। প্রাইভেট এয়ারলাইন্স এর যাত্রা শুরুর পর থেকেই কক্সবাজারে সারা বছর ফ্লাইট পরিচালনা করতে থাকে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠতে থাকে আন্তর্জাতিক মানের চার/পাঁচ তারকা হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। ফলে দেশীয় পর্যটকদের পাল্লা দিয়ে বিদেশি পর্যটক বাড়তে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

গত সাত বছরে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটনকে উৎসাহিত করেছে। সারা দেশে গড়ে উঠেছে অনেক উন্নতমানের হোটেল মোটেল কিংবা রিসোর্ট। মানুষ একটু সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে। আজ কোভিড-১৯ এর কারণে এভিয়েশন, ট্যুরিজম এর সাথে হোটেল ব্যবসায়ও চরম ধস নেমেছে। এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী কিংবা কর্মী সকলেই একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর বিস্তার জ্যামিতিক হারে না বাড়লেও গাণিতিক হারে এখনো বাংলাদেশে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সরকার বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিয়ে এভিয়েশন, ট্যুরিজম ও হোটেল ইন্ডাস্ট্রিজকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে কিংবা এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের ভবিষ্যতকে নিরাপদ রাখতে ১ জুন থেকে ধারাবহিকভাবে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে। প্রথম দিকের তুলনায় বর্তমানে যাত্রী সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, বহির্বিশ্ব থেকে যাত্রী আসা বন্ধ বলা চলে, পর্যটক শূন্যতা, বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে ওয়ার্ক স্টেশন ছেড়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোথাও চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে। সবাই ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অভ্যন্ত হয়ে গেছে। নানাবিধ কারণে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সরকারি কিছু বিধি নিষেধ। এত কিছুর পরও ফ্লাইট শুরু হওযার পর ধীরে ধীরে যাত্রী সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে কক্সবাজার রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পাওয়ার পর্যটকদের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। ১৭ আগস্ট থেকে সরকারী স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিয়ে সকল হোটেল মোটেল রিসোর্টসহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভূমি দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশই নিজেদের নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে কোভিড-১৯ কালীন সময়ে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করছে। ট্যুরিস্ট ভিসা পুরোপুরিভাবেই বন্ধ রেখেছে দূতাবাসগুলি। এ অবস্থা চলতি বছরের বাকী সময় থেকে আগামী বছরও স্থায়ী হতে পারে। সব কিছুই নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের উপর। সেই সঙ্গে ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে সরকার কাজ করছে। বিভিন্ন প্রনোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে সরকার ব্যবসা বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে অনবরত। আত্ননির্ভরশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে। দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এ খাতকে শক্তিশালী করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। বর্তমানে তৈরী হওয়া পর্যটক শ্রেণিকে দেশীয় পর্যটনে উদ্বুদ্ধ করতে সারাদেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠা পর্যটনকেন্দ্র গুলোকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে।  বিশেষ করে কক্সবাজারের পাশাপাশি সেন্টমার্টিন, হিমছড়ি, ইনানী বিচসহ সব দর্শনীয় স্থানসমূহ। সিলেটের চা বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, তামাবিল, মাধবকুন্ডের জলপ্রপাত, পাহাড়, ঝর্ণা সব মিলিয়ে নানা বৈচিত্র্যের সম্ভার রয়েছে সীমান্তঘেঁষা বিস্তীর্ন সবুজ লীলাভূমি। ঐতিহ্যময় বাংলার সৌন্দর্য সুন্দরবন, বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, রামসাগরসহ সারা দেশের আকর্ষণীয় সব পর্যটনকেন্দ্রগুলিকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। পর্যটকদের সামনেও দেশকে চেনার-জানার একটি সুযোগ চলে এসেছে করোনা মহামারির কারণে।

বিগত একদশক ধরেই বাংলাদেশের একশ্রেণির পর্যটক যারা প্রতিবছর ভারত, নেপাল, ভূটান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, জাপানসহ মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইউরোপ-আমেরিকায় পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যায়। এ বছর দেশের বাইরে ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বিভিন্ন দেশের নিয়মনীতি কারণে। আবার অনেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করবে না বিদেশ ভ্রমণে। করোনাভাইরাস দেশীয় পর্যটকদের অভ্যন্তরীণ ট্যুরিজমের প্রতি আকৃষ্ট করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনাভাইরাস পর্যটন শিল্পের জন্য একটা ব্রেকথ্রু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর সেটার জন্য দেশীয় পর্যটন শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিণত করতে হবে।    পজিটিভ বাংলাদেশ গঠনে ২০২১ সাল হোক দেশীয় পর্যটন শিল্পের জন্য স্মরণীয় বছর।  

লেখক: মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স লিমিটেড

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা 



এই পাতার আরো খবর