ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

খুঁজে বের করা দরকার সেই বেঈমানদের যারা কর্মীবান্ধব শেখ হাসিনাকে একা করে দিচ্ছে!
বাণী ইয়াসমিন হাসি
বাণী ইয়াসমিন হাসি

করোনাভীতি কমেছে। ইদানিং অনেকের সাথেই দেখা হয়। কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম বড় ভাইয়ের অফিসে। সেখানে আরও কিছু প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা হল। লম্বা আড্ডা চলল। ঘুরেফিরে দেশ, রাজনীতি, করোনা, আমলাতন্ত্র নিয়ে অনেক কথা হল। বড় বড় অট্টালিকা, ফ্লাইওভার, ব্রিজ নির্মাণ হচ্ছে কিন্তু মানুষের মন থেকে শান্তি আর স্বস্তি চলে গেছে। সব জায়গায় কেমন যেন একটা মন খারাপ করা পরিবেশ। একটা গুমোট ভাব।

গত বৃহস্পতিবার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহজাহান শিশিরের কারামুক্তি দাবিতে রাজু ভাস্কর্যে একটা মানববন্ধন হয়। সেই মানববন্ধনে আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা ব্যানার প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। দাঁড়ানো মাত্রই ইউনিফর্ম পড়া একদল লোক এসে, এই সরেন সরেন ; এখানে দাঁড়ানো যাবে না। এতটাই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার ছিল এদের (আমার ছাত্রজীবনে এই ব্যবহার কারো কাছ থেকে পেলে অবশ্যই খালি মুখে কথা বলতাম না) আমার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা। ছেলেটা বলল এরা প্রক্টরের গুন্ডা বাহিনী। অবাক হয়ে বললাম, এদের ব্যবহার এত খারাপ কেন ! এদের পাশে দাঁড়ানো শাহবাগ থানার এক এসআই আমার দিকে এগিয়ে এল, বলল আপা আমি আপনাকে চিনি, আপনার সাথে একটু কথা আছে। আমি বললাম মানববন্ধন হবেই। এটা বাদে অন্য কোনও কথা থাকলে বলেন। ছেলেটা কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, আসলে আপা আপনার আবেগটা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু প্রক্টর স্যারের কড়া নির্দেশ শিশির ভাই ইস্যুতে ক্যাম্পাসে কোনও প্রোগ্রাম করা যাবে না। আপনারা প্লিজ শাহবাগে দাঁড়ান। আমরা এখানেই দাঁড়াব। এটা শাহজাহান শিশিরের ক্যাম্পাস। এখানে ওনার ঘাম শ্রম আবেগ মিশে আছে। রাজু থেকে ক্রেন দিয়েও আমাকে কেউ সরাতে পারবে না। বৃষ্টিতে ভিজে ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছেলেও নড়বে না এখান থেকে। আপনি প্রক্টরকে জানিয়ে দেন। 

পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেলাম, প্রক্টরের ওপর ওহী নাজিল হয়েছে। যারা ষড়যন্ত্র করে শেখ হাসিনার পরীক্ষিত শাহজাহান শিশিরকে জেলে পাঠিয়েছে সেই তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে দিয়ে শিশির ভাইয়ের মুক্তি আন্দোলনকে বাঁধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করেছে। আমরা যখন ক্যাম্পাসে ছিলাম আমাদের নীলদলের শিক্ষকরা আমাদের তখন আগলে রাখতেন। ছাত্রদল আর পুলিশের পিটুনিতে আমার তিনবার হাত ভেঙেছিল; হাসপাতালে প্রতিবারই আমি চোখ খুলে সবার আগে নীলদলের স্যার ম্যাডামদের দেখেছিলাম। আজ যদি সেইসব পরীক্ষিত শিক্ষকদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্বে থাকতেন তাহলে শাহজাহান শিশিরের স্ত্রীর সঙ্গে তার পোষা গুন্ডাবাহিনী তর্কে জড়াতো না। রাজপথে যে শাহজাহান শিশিরকে দেখেনি তার কাছ অবশ্য এমন ব্যবহারই প্রাপ্য। এখন চেয়ারে অধিষ্ঠিত হতে কোনও যোগ্যতা লাগে না, কমিটমেন্ট লাগে না। লাগে শুধু তেল!

পরশু রাতে খাওয়ার টেবিলে সাবেক এক ডাকসাইটের ছাত্রনেতার সাথে কথা হচ্ছিল। উনি খুব মন খারাপ করে বললেন, দল আর সরকারের দিকে তাকাও। তাহলেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে। গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় বড় নেতার সাথে লম্বা আড্ডা দিলাম। দল আর সরকার আলাদা করার যে প্রেসক্রিপশন সেটা মূলত আমলাতন্ত্রের রাজত্ব কায়েমের জন্য খুব সুক্ষ্মভাবে করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আমি আমার একটা লেখায় প্রশ্ন করেছিলাম, এই সরকারে প্রধানমন্ত্রী বাদে আর কোন মন্ত্রী আছেন যিনি আমলাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন? কোনও উত্তর পাইনি আমি। লোকমুখে প্রচলিত আছে, অনেক মন্ত্রী সচিবদের স্যার ডাকেন এবং সচিব রুমে ঢুকলে নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান। তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, মতিয়া চৌধুরী উনাদের সামনে আমলারা কিন্তু কেঁচো হয়ে থাকতেন। পাড়া মহল্লা থেকে ধরে এনে মন্ত্রী না বানিয়ে কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের মধ্য থেকে মন্ত্রীপরিষদ সাজালে আমলারা এভাবে জিম্মি করতে পারতো না।

পরিকল্পিতভাবে জনপ্রতিনিধিদের চোর বানানো হচ্ছে অথচ প্রশাসনের সর্বত্রই পুকুর নয় সাগরচুরি চলছে। এগুলো নিয়ে কোথাও কোন আওয়াজ নেই। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ প্রতিটা সহযোগী ও অংগ সংগঠনকে একে একে বিতর্কিত করা হয়েছে। যেটা দলীয় ফোরামে আলোচনার কথা সেটারও মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে। আমজনতার কাছে কি বার্তা গেল? আওয়ামী লীগ এই ক্ষতি কত বছরে পোষাতে পারবে বা আদৌও পারবে কিনা সেটা আমার জানা নেই।

কাক কাকের মাংস না খেলেও এক আওয়ামী কর্মী আরেক আওয়ামী কর্মীর ক্ষতি করতে এক সেকেন্ডও ভাবে না। নিজেদের অনৈক্যের সুযোগ নেয় তৃতীয়পক্ষ। আর কিছু মানুষ মতের মিল না হলেই অন্যকে জামাত-শিবির ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। কেউ কেউ তো প্লেন ভাড়া করে হলেও অন্যের বদনাম করে আসে। আমরা চিরকালই পরশ্রীকাতর। শরীর খারাপের কারণে নয় বরং অন্যের সুখ দেখলেই বেশি অসুস্থ হয় একশ্রেণির মানুষ। বড় বড় স্থাপনার ভিড়ে মানবিক বোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন একটা মেকি সমাজে বাস করছি আমরা। সেখানে কোনও মায়া নেই, প্রাণ নেই, কমিটমেন্ট নেই, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই। আছে শুধু অসুস্থ প্রতিযোগিতা!

অন্ধকার যত গভীর ভোর তত নিকটে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সেই আরাধ্য ভোরটা নিশ্চয়ই আসবে। দিনশেষে মানুষ চায় একটু সম্মান, একটু স্বস্তি। এই জায়গাগুলো দিন দিন কেমন যেন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। মানুষের ভরসার জায়গাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুধু পেটের ক্ষুধায় নয় মনের ক্ষুধায়ও মানুষ মরে।

বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি আমার অগাধ ভরসা। উনাকে খুব বেশিদিন ভুল বুঝিয়ে রাখা যাবে না। দেশের মানুষ আর দলের নেতাকর্মীকে উনি তো বঙ্গবন্ধুর চোখ দিয়েই দেখেন। এত মমতা যার বুকে; দলের দুর্দিনের কর্মীদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিশ্চয় তাকেও রক্তাক্ত করবে? বিরোধীদল এবং এক এগারোর কর্মীরা কেউ ভালো নেই। হাইব্রিড আর অনুপ্রবেশকারীদের কনুইয়ের গুতোয় তারা দিন দিন তাদের প্রিয় আপার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আবার যদি কোনও সংকট আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে কঠিন মূল্য দিতে হবে। দলের পরীক্ষিত কর্মীর চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসের মূল্য কড়া দামে মেটাতে হবে। সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই খুঁজে বের করা দরকার সেইসব বেঈমানদেরকে যারা কর্মীবান্ধব শেখ হাসিনাকে দিন দিন একা করে দিচ্ছে!

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

বিডি প্রতিদিন/কালাম



এই পাতার আরো খবর