ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

"আঠারোয় পা"
শায়লা কবির
শায়লা কবির

আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আর সেজন্যই আমি আমার মেয়েকে ১৮ বছর বয়সে বিদেশে একা পাঠিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করিনি।

আমি কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা একদম পছন্দ করি না। কিন্তু আমি আমার সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দিয়েছি খুব দৃঢ় হাতে এবং মজবুতভাবে।

ওদেরকে শিখিয়েছি সৎভাবে উপার্জন করতে তাতে যদি আলু ভর্তা, ডাল ভাত খেয়ে চলতে হয় তাতেও। ওদেরকে শিখিয়েছি, আজ তুমি কাউকে ঠকালে কাল তোমাকেও ঠকতে হবে সুতরাং কাউকে কখনো কোনোদিন এক মূহুর্তের জন্যও ঠকানোর চিন্তা করবে না।

ওদেরকে শিখিয়েছি কাউকে অসম্মান করে বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলবে না এবং ব্যবহার করবে না। আজ তুমি কাউকে অসম্মান করলে তোমাকেও একদিন অসম্মানিত হতে হবে। মোটকথা তুমি মানুষের সাথে বা প্রকৃতির সাথে যা যা করবে প্রকৃতিগতভাবে তা সব ফেরৎ পাবে।

আসলে ওদের ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে আমি শক্তপোক্তভাবে লালনপালন করার চেষ্টা করেছি। সততা, মনোবল, আত্মবিশ্বাস, মানবতা, সহানুভূতিশীলতা, পরোপকার এবং দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি সম্পর্কে নিত্যদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং ঘটনাবলী থেকে উদাহরণ দিয়ে তিলে তিলে আমি ওদেরকে গড়ে তুলেছি।

যেমন খুব ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, আমি দোকান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে এনে, বাসায় এসে সব গুছাতে গিয়ে দেখি আমার পাউরুটি দরকার একটা অথচ দোকানদার দুটো পাউরুটি দিয়ে দিয়েছে, আমার সার্ফ এক্সেল লাগবে এক প্যাকেট অথচ দিয়ে দিয়েছে দুই প্যাকেট। আমি আবার দোকানে গিয়ে বাড়তি জিনিসগুলো ফেরৎ দিয়ে এসেছি। এরকম প্রতিদিনকার ছোটখাটো নানান ঘটনা আমি ওদের সাথে শেয়ার করতাম এরকম তা থেকে ওদেরকে শেখাতাম কোনটা করা উচিত এবং কোনটা করা উচিত নয়। তাই আমি অন্তত জানি এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যেহেতু আমি করি না তাই আমার সন্তানরাও কখনো খারাপ কোনো কিছু করতে পারে না এবং করবে না।

ওদেরকে আমি কোনোদিন আরাম আয়াসের মধ্যে বড় করিনি। ওদেরকে কষ্ট করে এবং হিসেব করে চলতে শিখিয়েছি। বিলাসিতার মধ্যে কখনোই আমরা গা ভাসাইনি। আমি সবসময় আমার সন্তানদেরকে বুঝিয়েছি যে জীবনে বড় হতে চাইলে পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এবং আমার ছেলেমেয়েও আমার মতো কষ্ট করে এবং হিসেব করে চলে টাকা পয়সা বাঁচিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা ছাড়া বাহুল্যতা বা বাড়তি জিনিস বর্জন করতে শিখেছে। আমরা কখনো কোনো বাড়তি জিনিস কিনে ঘর ভরিয়ে রাখিনি।

প্রবাসে যারা থাকেন তারা জানেন সেখানে গাড়ি যে কি পরিমাণ জরুরী প্রয়োজন। আমার এইটুকুন মেয়েটা গত দেড়বছরে কোথাও বেড়াতে না গিয়ে, বাজে কোনো খরচ বা বাড়তি কোনো খরচ না করে নিজের পার্ট টাইম জবের টাকা দিয়ে নিজের লিভিং কস্ট মেইনটেইন করার পরও সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে এবং ইউনিভার্সিটির ভলান্টিয়ারিং এর কাজ করে টাকা জমিয়ে গাড়ি কিনেছে তার বাবা মার কাছ থেকে এক টাকাও না নিয়ে।

মেয়ের বাবা মেয়েকে বলেছিলো, "তোমার যদি গাড়ি কেনার দরকার হয় আমি টাকা দিবো তুমি গাড়ি কিনো" কিন্তু মেয়ে বলেছিলো, "না আব্বু লাগবে না"। আমি অবাক হয়ে যাই আমার মেয়ের আত্মবিশ্বাস এবং দায়িত্ববোধ দেখে! ওকে দেখে মনে হয় সার্থক আমার শিক্ষাদীক্ষা।

আমরা শুধু আমার মেয়ের ইউনিভার্সিটির টিউশন ফি'র টাকাটা পাঠাই। আর মেয়ের লিভিং কস্ট পার্ট টাইম জব করে মেয়ে নিজেই বহন করে।

আমার 'মেয়ের' জীবন। ওর ভালো হলে যেমন আমার ভালো লাগবে, আমি সুখীবোধ করবো, গর্বিত হবো। তেমনি ওর খারাপ হলে আমার খারাপ লাগবে, আমার অশান্তি লাগবে, টেনশন হবে। কিন্তু আমার প্রশান্তি লাগে এটা ভেবে যে আমি জানি আমার মেয়ে কখনো খারাপ কিছু করবে না এবং এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস কারন আমি আমার মেয়েকে চিনি।

সন্তান জন্মের পর থেকে তো তাকে আপনার পছন্দমতো খাইয়েছেন, আপনার পছন্দমতো ড্রেস পড়িয়েছেন কিন্তু সন্তানরা বড় হওয়ার পর তাদেরকে যে কিছু ব্যাপারে স্বাধীনতা দিতে হয় বা দেওয়া উচিত এটা কি বাবা মায়েরা কখনো ভেবে দেখেছেন?

ওরা কি খাবে বা না খাবে সেই স্বাধীনতা, ওরা কি কাপড় চোপড় পরবে বা না পরবে সেই স্বাধীনতা, ওরা কাউকে ভালোবাসবে বা না বাসবে সেই স্বাধীনতা, এরকম আরো এমন কিছু বিষয় আছে যা আপনি বাধা দিতে চাইলেও ওরা ওদের পছন্দ মতো ইচ্ছে হলে করবেই, এমনকি জোর করে বা লুকিয়ে হলেও করবে। কারণ বড় হওয়ার পর ওরাও একেকজন আলাদা ব্যক্তি হয়ে ওঠে। ওদের স্বতন্ত্র একটি ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে যা অনেকটা ওদের নিজস্ব পছন্দ এবং অপছন্দ দ্বারা প্রভাবিত। তখন আপনার ঠিক পছন্দ নয় এমন কিছু করতে দেখলে তার জন্য বেশি বাধা দিতে গেলে বা বেশি কড়াকড়ি শাসন করতে গেলে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই জোর করে বাধা না দিয়ে ওদের সাথে খোলামেলা কথা বলার মতো সম্পর্ক এবং পরিবেশ বজায় রাখুন যাতে ওরা আপনাকে সব বলতে পারে বা শেয়ার করতে পারে। ওরা যেন আপনার কাছ থেকে কোনো কিছু গোপন করতে না চায়। আপনার সন্তান আপনার কাছে কোনো কিছু গোপন করলেতো আপনারই লস। সুতরাং ওদের জেনারেশন অনুযায়ী বা ওদের বয়সের চাহিদা অনুযায়ী কিছু স্বাধীনতাতো আপনাকে দিতেই হবে। তবে আপনাকে অবশ্যই সবসময় ওদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে টাচে থাকতে হবে যাতে আপনি ওদের সব গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে পারেন।

কিছু একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে স্বাধীনতা কে না চায়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো মানুষই তা চাইবে। তাই সন্তানকে ১৮ বছর বয়সের পর প্রাপ্তবয়স্ক ভাবতে শুরু করুন। ভেবে দেখুন, আপনার মতো তারও নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ও অধিকার আছে। আপনার সন্তান চিরকালই আপনার কাছে ছোট কিন্তু তাই বলে ভুলে যাওয়া চলবে না যে ১৮ বছর বয়সের পর সেও আপনারই মতো একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তাকে একজন এ্যাডাল্ট বা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকারটুকু অন্তত তাকে দিন। প্রয়োজনে আপনার সন্তানকে আপনি সঠিক পরামর্শ দিয়ে বা সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে সবসময় সব সিচুয়েশনে তার পাশে থাকুন। তাকে ভরসা দিন যে আপনি আছেন তার পাশে বিনা দ্বিধায় যেকোনো মূহুর্তের যেকোনো প্রয়োজনের জন্য। তাহলে হয়তো আপনার এবং আপনার সন্তানের জীবনে আফসোস বা রিগ্রেট করার মতো কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকবে না। ইনশাআল্লাহ।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর