ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

তুমি হেরে তোমার মূল্যটা মানুষকে বুঝিয়ে দাও
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

মানুষ খুব বিস্ময়কর। তার থেকে বড় বিস্ময়কর হলো মানুষকে বোঝা। মানুষ কেবল জিততেই চায়, হারতে চায় না। কে-কিভাবে-কখন-কাকে পা ধরে টেনে নামিয়ে নিজে উপরে উঠবে- এ নিয়ে মানুষের চিন্তার শেষ নেই। জিততে হলে যে হারতে হয় মানুষ তা বুঝতে পারে না। এক একটা পরাজয়ের পিছনে এক একটা জয় লুকিয়ে থাকে। মানুষের মধ্যে সে চেতনাবোধ হারিয়ে যায়। মানুষ এতটাই জেতার নেশায় বুদ হয়ে থাকে যে তার ভিতরের সম্ভাবনাময় শক্তিগুলো ক্রমশ লোপ পেতে থাকে। পরাজয় মানুষকে আপন-পর চেনাতে শেখায়। পরাজয় মানুষকে বন্ধু-শত্রু চিনিয়ে দেয়। অদৃশ্য কুশীলবদের পর্দার পিছন থেকে টেনে বের করে সামনে নিয়ে আসে। পরাজয় থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। সে শিক্ষা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায় ও পরবর্তী পরিকল্পনা এবং কৌশল নিতে সহায়তা করে। এক একটা পরাজয় এক একটা নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। সে অভিজ্ঞতা মানুষের শক্তি হয়। মানুষের মধ্যে এক অলৌকিক শক্তি তৈরি করে। মানুষের খেলার পিছনের খেলা, তারও পিছনের খেলার হাতগুলো দেখতে পায়। মুখোশের ভিতরের মুখটা তখন কঠিন সত্য হয়ে বেরিয়ে আসে। সে মুখ মানুষের মুখ নয়। কোন এক বিশ্বাসঘাতক বুনো বিড়ালের মুখ হয়। 

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছেন, সফলতার গল্প পড়ো না, কারণ তা থেকে তুমি শুধু গল্পটাই পাবে। ব্যর্থতার গল্প পড়ো, তাহলে সফল হওয়ার কিছু উপায় পাবে। এই মহামূল্যবান বাণীটি কতজন উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখে- তা কে জানে। হয়তো সবাই, কিন্তু অভিনয়টাই যে এখন মানুষের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। রঙ্গমঞ্চে এভাবে প্রতিদিন মানুষের আত্মার মৃত্যু ঘটছে। আর দেহটা সে মৃত্যুর ভার গ্রহণ করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ছে হয়তোবা। মানুষ যখন পরাজিত হয় তখন সুসময়ের মানুষেরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এভাবে পরাজয় মানুষের মধ্যে একাকীত্বের অভিজ্ঞতা তৈরি করে | এই একাকীত্ব মানুষের দৃষ্টির গভীরতা বাড়ায়। এই সময়টাতে মানুষ অকৃতজ্ঞ মানুষদের চিনতে পারে। মানুষ সব সময় জয় আর সফলতার পূজারী হয়। কিন্তু সে জয় আর সফলতা কতটা সার্থক সেটা কখনো বিবেচনায় আনে না। এর  ফলে ব্যক্তির চেয়ে জয় মানুষের কাছে বেশি প্রাধান্য পায়। এভাবে জয়ে আসক্ত মানুষেরা নিজেদের ব্যক্তিত্বের বিনাশ ঘটায়। কখনো নিজেরা শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এটাকে মানুষের প্যারাসাইট বা পরজীবী চরিত্র বলা যেতে পারে। জীবনানন্দের অদ্ভুত আঁধার এক কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেলো। 

তিনি বলেছেন,  অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয় মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

কবিতাটি সে মানুষদের চেনাচ্ছে যারা নিজেদের স্বার্থে পরাজয়কে মানতে না পেরে জয়ের অনিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছে। হয়তো তারা এটাকে জয় ভাবছে, কিন্তু মিছেমিছি এই জয় তাদের কপালে প্রতিদিন পরাজয়ের কলঙ্ক এঁকে দিচ্ছে। জয়ের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে সুবিধাবাদী পরাজিত মানুষেরা। যাদের কোনো নিজেদের বিচার বিবেচনার শক্তি নেই। তবুও এতো সব আঁধারের মাঝে আশার বাণী কান পেতে শুনতে হয়। নিজের মুখের ভিতরের মুখ দেখতে হয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার  দিওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী উপন্যাসে বলেছেন, ‘মানুষ পরাজিত হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। মানুষকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না।’ মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। মানুষকে পরাজিত করার চেষ্টা  হয়তো চলে। ছদ্মবেশে কিংবা প্রকাশ্যে। যারা এই চেষ্টাটা চালায় তারা জয়কে ভয় পায়। নিজেরা পরাজিত হয়, সেটা বুঝতে না পেরে অন্যের পরাজয়ের উৎসবে মেতে উঠে। জয় ঠেকাতে মানুষকে খুন করে যারা জয়ের আনন্দে মেতে উঠে তারা নিজেরা পরাজিত হয়। কখনো নিজের কাছে, কখনো বিবেকের  কাছে, কখনো সময় আর প্রকৃতির কাছে। একটা প্রবাদবাক্য আছে ‘মিথ্যা তখনই জিতে যায় যখন সত্যি বলা লোক গুলো চুপ থাকে।’ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মানুষ সত্যকে বুকে চেপে নিরপেক্ষতা ও সুবিধাবাদিতার আশ্রয় নেয় বলে অনেক সময় মিথ্যার জয়টা মানুষ দেখে কিন্তু পরাজিত সত্য জানে যা মানুষ জয় দেখছে তা একধরণের দীর্ঘমেয়াদের পরাজয়। 

সত্য কখনো ঘুমিয়ে থাকেনা। মিথ্যার জয়ে সত্য সাময়িক লজ্জিত হয়, অভিমান করে কিন্তু ভেঙে পড়েনা। একটা কথা সময় মনে রাখা দরকার তা হলো অনেক পরাজয়ে ত্যাগ থাকে আবার অনেক জয়ে স্বার্থ থাকে। তবে ত্যাগ কখনো স্বার্থের চেয়ে বড় হতে পারেনা। প্রতিটা জয় কতটা অর্থ থেকে প্রভাবমুক্ত তাও ভেবে দেখা দরকার। অবৈধ অর্থ আর সম্পদের কাছে জয় যখন পরাজিত হয় তখন তিলে তিলে গড়ে উঠা স্বপ্নের মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু মানুষের মৃত্যু নয়- এ মৃত্যু সভ্যতার, এ মৃত্যু একবিন্দু আবেগের। তারপরও মাঝ রাস্তায় এসে চিৎকার করে একজন নিখুঁত মানুষ এসে চিৎকার করে বলে উঠুক, জয় হোক মানুষের,  .পরাজয় ঘটুক অমানুষদের। ঘুরে দাঁড়াক মানুষ। ঘুরে দাঁড়াক সময়। আর বলে উঠুক আবেগের মন, শেকড়ের ছন্দপতন, সব সময় জিততে যেওনা, মাঝে মঝে হারতে হয়। তুমি হারলে মানুষ বুঝবে তুমি তাদের জন্য কত মূল্যবান ছিলে। তুমি নিজে হেরে অন্যকে জিতিয়ে দাও। এই পরাজয়ে গ্লানি নেই, মহাত্যাগ, মহত্ব ও মর্মবাণী আছে। মনে রেখো সব পরাজয়, পরাজয় নয়।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক



এই পাতার আরো খবর