ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

রুদ্ধ এ সময়ে রুদ্র তোমায় স্মরি
মোহন রায়হান

'শুভ জন্মদিন।  দীর্ঘায়ু হও। সুস্থ থেকো। ভালো থেকো বন্ধু।' সমান বয়সী, সহপাঠী বন্ধু কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ 'র আজ ৬৪তম জন্মদিন।  বেঁচে থাকলে এভাবেই হয়তো বন্ধুকে জন্মদিনের শুভকামনা জানাতাম। কিন্তু হায় দুর্ভাগ্য! বহু বছর আগেই প্রিয় রুদ্র আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। রুদ্র আমার কেমন বন্ধু ছিল? কেমন সম্পর্ক ছিল ওর সাথে? কী কী করেছি একসাথে? কতটা মিল অমিল ছিল? কবি হিসেবে মানুষ হিসেবে রুদ্র কেমন ছিল? সেসব অন্যখানে অন্যত্র বলেছি। লিখেছি। আরও লিখব। আরও বলব।

আজ শুধু বলতে চাই- জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই  পুরনো শকুন।” কিংবা-দাঁড়াও নিজেকে প্রশ্ন করো -কোন পক্ষে যাবে?" অথবা- কৃষক তোমাদের পক্ষে যাবে না/ শ্রমিক তোমাদের পক্ষে যাবে না/ছাত্র তোমাদের পক্ষে যাবে না/সুন্দর তোমাদের পক্ষে যাবে না/ স্বপ্ন তোমাদের পক্ষে যাবে না।" এই লাইনগুলো বলেছিল যে, সেই কবির আজ বেঁচে থাকা খুব জরুরি ছিল। বাংলাদেশের সব কবি, লেখক আমরা যখন  ব্যর্থ, পরাজিত, ন্যুব্জ জনগণের পাশে দাঁড়াতে,  স্বার্থ আর সুবিধার  পদলেহী, ভীরু, কাপুরুষ,  হিজড়া, দালাল, ভণ্ড আর প্রতারকের খাতায় নাম লিখিয়ে  পদ-পদবী, পুরস্কার, অর্থ-বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি লোভাতুর হয়ে পড়েছি তখন রুদ্রের মতন নির্লোভ, সাহসী, প্রতিবাদী, দ্রোহী, দেশপ্রেমিক, গণমানুষের কবি অর্থাৎ প্রকৃত কবির সরব উপস্থিতি ভীষণ  ভীষণ প্রয়োজন ছিল। যে হয়তো স্পর্ধা নিয়ে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতো- রাষ্ট্রের কলিজা আজ খুবলে খাচ্ছে নতুন শকুন। সেই হয়তো বলতে পারতো-তারা আমাদের জিভ কেটে নিতে চায় /তারা আমাদের চোখ উপড়ে ফেলতে চায়/আমাদের সন্তানদেরও তারা চায় গোলাম বানাতে।"

বন্ধু, তোমাকে আজ সত্যি খুব মনে পড়ছে, ভীষণ অভাব অনুভব করছি তোমার। সাহস করে সত্য বলার একজন কবিও নেই বাংলাদেশে আজ। তুমি না থাকায় আমিও সেই কাপুরষদের মতনই বাঘের লেজ গুটিয়ে বিড়াল বনে গেছি! আমার "সাহসী মানুষ" উপাধিতে যে কেউ এখন থুথু দিতে পারে। তুমি থাকলে তা হতো না আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বন্ধু একা কি কিছু করা যায়? আমার পাশে তোমার মতন একজনও রুখে দাঁড়ানো কবি নেই আজ। সবাই চামচা, দালাল আর মোসাহেব।  সবাই পোতানো.. নিবীর্য... নপুংসক... উত্থান রহিত।

মনে পড়ে আমরা একসঙ্গে কতকিছু করেছি। কোনো কিছুই পরোয়া করিনি। মার্শাল ল আমরাই প্রথম ভেঙেছি। বাড়ি বাড়ি থেকে রথি মহারথীদের ডেকে ডেকে এনে আমরাই সাংস্কৃতিক জোট আর কবিতা পরিষদ বানিয়েছিলাম। তুমি থাকলে বুক চিতিয়ে বলতে পারতাম, আমরা দুজনই সেদিন প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলাম। আমাদের জীবন বাজি রেখে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান দুটি এখন কতিপয় মৌ-লোভীদের মধু-চাকে পরিণত। কত চামচিকারা প্রতিষ্ঠান দুটি ব্যবহার করে সিংহে পরিণত হয়েছে। তাদের হুংকারে থরথর প্রকম্পমান দিক্বিদিক! যাদের কেউ চিনত না জানত না, যাদের কবি, লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে আমরাই চিনতাম না, আমাদের পিছনে ঘুরঘুর করত। সাংস্কৃতিক জোট কিংবা কবিতা পরিষদের সদস্যপদের জন্য পারলে পায়ে পড়ত! আমাদেরই ব্যবহার করে তারা আজ জাতির শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানসমূহের হর্তাকর্তা! কোটি কোটি টাকার মালিক তারা। এক বোতল মদ আর এক হাজার টাকা রাইটার্স ক্লাবে দিয়ে মিনতি করত, আমার জন্মদিনটা পালন করে দিন!"

এমন লোক এখন ক্ষমতার পদলেহন করে এমন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষব্যক্তি যার আরও কাণ্ড শুনলে লজ্জায় বিবেকবান মানুষের মাথা হেঁট হয়ে যাবে! সেলুকাস কি বিচিত্র এদেশ!

বন্ধু তুমি নেই, থাকলে নিশ্চিত এসবের প্রতিবাদ হতো। তুমি রাস্তায় নামতে। কারণ তোমার কোনো পিছুটান ছিল না।  তোমার বন্ধুরা সবাই জীবন জীবিকার ধান্ধায় হারিয়ে গেছে। আপস করেছে লোভ লালসার  সঙ্গে। তুমি রুদ্র, রুদ্রই ছিলে সবক্ষেত্রে। বৈষয়িক হতে পারনি কখনো তাই অনেক দুঃখ আর কষ্ট আর অবহেলা বুকে নিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলে! বন্ধুরা প্রায় সবাই যে যার ক্ষেত্রে সফল বলতে হবে অন্তত যারা যখন যেমন তখন তেমন, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জোর কদম হাঁটা দিতে পেরেছে। কিন্তু আমরা পারিনি বলে সর্বত্রই অচ্ছুৎ। তুমি ছিলে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। আপাদমস্তক কবি। এখনও বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবিতা আবৃত্তি হয় তোমার। তরুণদের মাঝে তুমি এখনও সমান জনপ্রিয়। প্রেম, বিরহ, দ্রোহের তোমার কত যে পংক্তি ডিজিটাল জেনারেশন পোস্ট দেয় ফেসবুকে! আর তুমি বাংলাভাষার একমাত্র কবি যে মাত্র একটি গানের জন্য অমরতা লাভ করবে যতদিন বাংলা আর বাঙালি থাকবে পৃথিবীতে।

তোমার ৬৪তম জন্মদিনে তোমার এই নগন্য বন্ধু তোমাকে সত্যি অসম্ভব মিস করছে। এই ধর্ষকামী, খুনি, অমানবিক, জঘন্য,  নীতি-নৈতিকতাহীন, শ্বাসরুদ্ধ, জল্লাদ সময়ে তোমার অনুপস্থিতি তাকে বড়ই নিঃসঙ্গ নিরুপায় বিষবিদ্ধ যন্ত্রণাকাতর অসহায় প্রাণীতে পরিণত করেছে! বড় কষ্টে আছি বন্ধু!

লেখক: কবি

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর