ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

খুনি মোশতাকের পাপের প্রায়শ্চিত ভোগ করছে তার দেশত্যাগী সন্তানরা
সোহেল সানি
সোহেল সানি

সূর্যের ধরণীতলে বঙ্গবন্ধু হত্যার অবিশ্বাস্য ঘটনার পর প্রথম যে ব্যক্তিটির মুখোশের অন্তরাল থেকে জনসম্মুখে হাজির হয়েছিল তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। হিমালয়সম মহীরূহকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতির সিংহাসনে সমাসীন হন এই বিশ্বাসঘাতক। রাজনৈতিক জীবনের শুরু এবং শেষ দু'টোই ঘটনাবহুল। 

মোশতাক কতটা চাটুকারিতার আশ্রয় নিয়েছেন তা কয়েকটি ঘটনায় চোখ রাখলে পরিষ্কার হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীত্বকালেই বাবা-মাকে হারান। মোশতাক তখনো মন্ত্রী। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় কবর দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর মা-বাবাকে। বঙ্গবন্ধুর বাবা মৌলভী লুৎফর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন মোশতাক। মোশতাক নিজে কবরে নেমে পড়েন লাশ শায়িত করতে। মোশতাক বঙ্গবন্ধুর মা সায়রা খাতুনের মৃত্যুতে তো মাটিতেই গড়াগড়ি করে কান্নায় চোখমুখ ভাসিয়ে ফেলেন। সংবাদপত্রের পাতায় তা খবর হয়ে যায়। 

১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই শেখ কামালের বিয়েতেও বিশিষ্ট ভূমিকায় ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। শেখ কামালের উকিল বাপের আসন অলংকৃত করেন তিনি। মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে একটা সোনার বটগাছ উপহার দিয়ে বলেছিলেন, 'মুজিব তুমি সত্যিকার অর্থেই বাংলার বটবৃক্ষ, আমরা হলাম ডালপালা মাত্র।'

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বাসায় রান্না করা হাঁসের মাংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান মোশতাক। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথপোকথনকালে শেখ রাসেলের আগমন ঘটে। মোশতাক শিশু রাসেলকে আদর করে মাথায় চুমো খান। এরপর নিজের টুপিটা খুলে রাসেলের মাথায় পরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মোশতাক বললেন, 'দেখো ওকে কেমন মানিয়েছে।'

সন্ধ্যার পরপরই মোশতাক তার আগামসীহ লেনের বাড়িতে চলে যান। সেই মোশতাক রাতটা দিনে গড়াতেই কী কাণ্ডটা না ঘটালেন। শুধু কী কাণ্ড? না, সেতো বিশ্বাসঘাতকতামূলক এক মহাকাণ্ড- মহা হত্যাযজ্ঞ।

পূর্বপরিকল্পনা মতো রাষ্ট্রপতি হলেন মোশতাক। নিহত বঙ্গবন্ধুর লাশটা সিঁড়িতে পড়ে আছে তখনো। বাড়িশুদ্ধ লাশ আর লাশ। সেই শুক্রবারই খুনিবেষ্টিত হয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুম্মার নামায আদায় করলেন। তারপর খুনীদের হাতে মিষ্টিমুখ করলেন, সমবেত মুসল্লিদেরও মিষ্টিমুখ করালেন। মুসল্লিরা বিস্মিত ভীতসন্ত্রস্ত মনে দেখলো বঙ্গবন্ধুরই বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাক রাষ্ট্রপতি। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর রাসেলের মাথার ওপর চাপানো তার গাঢ় ছাই রঙের কিস্তি টুপিটাকে জাতীয় টুপি হিসাবে ঘোষণা করে দিলেন। 

তিনি বললেন, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের এ টুপি পরিধান করতে হবে। সব মন্ত্রিরা সম্মতি দিলেন। যারা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভারই সদস্য ছিলেন। সেই প্রস্তাব পাস করা হলো এই বলে যে, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় ফুল, জাতীয় ফল, জাতীয় পাখির মতো একটা জাতীয় টুপিও থাকা দরকার।

মোশতাক অতিশয় ভাগ্যবান ছিলেন। জীবনে বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করেও পার পেয়ে যান বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতেও মোশতাকের প্রতি পরম ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতির প্রথম দিকের ভূমিকা ভুলে গিয়ে মোশতাককে বন্ধু ভেবে বুকে স্থান দিয়েছিলেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে কারারুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি খন্দকার মোশতাক আহমেদও যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। কিন্তু ওই বছরের ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষে 'গভর্নর হাউজ' ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। কর্মসূচি চলাকালীন গ্রেফতার হন দলের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং পরে শেখ মুজিব।  ভয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে দল ত্যাগ করেন অন্যতম সহ-সভাপতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, আলী আমজাদ খান ও সহ-যুগ্ম সম্পাদক এ কে রফিকুল হোসেন। যুগ্ম সম্পাদক মোশতাক রাজনীতির পাট চুকিয়ে আইন ব্যবসায় শামিল হন সিনিয়র সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খানের সঙ্গে। ৫০ সালে কারামুক্ত শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিস খুলে বসেন নবাবপুরে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে শেখ মুজিব দলীয় কার্যক্রম শুরু করলেও মোশতাকের হদিস ছিল না। ফলে ‘৫৩ সালের প্রথম কাউন্সিলে নির্বাচিত কমিটিতে তার ঠাঁই হয়নি। 

‘৫৪ সালের মার্চের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নলাভে ব্যর্থ হন মোশতাক। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ অনুকম্পায় তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে বিজয়ী করে আনা হয়। আওয়ামী লীগও তাকে ফিরিয়ে নেয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে এলেও গভর্নর শেরেবাংলার দলে গা ভাসান এবং চীফ হুইপ হন। ৫৫ সালে দল অসাম্প্রদায়িক নীতিগ্রহণ করে নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দ কর্তন করলে মোশতাক আব্দুস সালাম খানের সঙ্গে হাত মেলান এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দল টিকিয়ে রাখেন। তারা বহিষ্কারও হন। পরে মোশতাক আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।  ১৯৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের চক্রান্তের দায়ে অভিযুক্ত হন। হারান মন্ত্রীত্ব। আর সেই মধুর প্রতিশোধ নেন ৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে। রাষ্ট্রপতির ভাষণে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের 'দেশের সূর্য সৈনিক' হিসাবে অভিহিত করেন।

আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার কার্য শুরু করে। কিন্তু তার মাত্র ক'দিন আগে ৯৬ সালের ৫ মার্চ মোশতাক মারা যান। মৃত্যুর পর পুলিশ পাহারায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে মোশতাকের নামাজে জানাজা হওয়ার কথা থাকলেও বিক্ষোভের মুখে তা সম্ভব হয়নি। কুমিল্লার দাউদকান্দির দশপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে মোশতাককে দাফন করা হয়।

পারিবারিক কবরেস্থানে সবার রয়েছে নামফলক। কিন্তু শুধু নেই মোশতাকের কবরে। ইতিহাসের জঘন্য এ বিশ্বাসঘাতকের একমাত্র পুত্র ইশতিয়াক আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে। দুই কন্যা শিরিন সুলতানা ও ডাঃ নাজনীন সুলতানা যুক্তরাজ্যে। দেড় দশকের ধরে তারা আসছেন না দেশে।  জনরোষ ও আতঙ্কের ভয়ে। সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মোশতাকের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

বিডি-প্রতিদিন/সিফাত আব্দুল্লাহ



এই পাতার আরো খবর