ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

ভালোবাসার শক্তির সাথে কেউ জিততে পারে না
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী:
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

পৃথিবীতে এমন কিছু  জিনিস আছে যা মানুষ চাইলেও কেড়ে নিতে পারে না। সেগুলো দামি কোনো জিনিস নয় বরং অতি সাধারণ কিছু জিনিস। তবে আপাতদৃষ্টিতে সেগুলোকে  সাধারণ বলে মনে হলেও তা মহামূল্যবান। কারণ সেই জিনিসগুলো টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ক্ষমতা ও শক্তি দিয়ে চাইলেও সেগুলো পাওয়া যায় না। বরং তিলে তিলে তা অর্জন  করতে হয়। ফুলের গন্ধ আমাদের মোহিত করে, আনন্দিত করে, পুলকিত করে। 

রং বেরঙের ফুল আমরা দেখতে পেলেও ফুলের অসাধারণ গন্ধকে আমরা দেখতে পাই না। ফুলের সৌন্দর্য দিয়ে ফুলকে পুরোপুরি বিচার করা যায় না। বরং ফুলের গন্ধ দিয়ে ফুলের প্রকৃত সত্তা খুঁজে পাওয়া যায়। যে ফুলের গন্ধ নেই সে ফুল ঘরের সৌন্দর্য বাড়ালেও তা মূল্যহীন। কারণ যে ফুলের গন্ধ নেই সে ফুল বেঁচে থাকে না। বরং মরে যায়। ফুলের মতোই মানুষ। চেহারাটা মানুষের মতো হলেই মানুষকে মানুষ বলা যায় না। বরং মানুষ ক্রমশ মানুষ হয়ে উঠে তার ভিতরের সত্তার বিকাশের মাধ্যমে। মানবিক মূল্যবোধ ও জীবনবোধের বীজ বুনে তা থেকে উৎসারিত গুণাবলীর মাধ্যমে। একটা শব্দ ভালোবাসা। কি বিস্ময়কর তার মানবিক শক্তি। যে শক্তির কাছে সব শক্তিই পরাজিত  হয়। ভালোবাসা যেখানে মাথা তুলে দাঁড়ায় সেখান থেকে  সব অন্ধকার পালিয়ে যায়।

সব মানুষ এই শক্তিকে ধারণ করতে পারে না। তবে যারা পারে তারাই মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। মানবিক সভ্যতার ইতিহাসের গোড়াপত্তন তাদের মাধ্যমেই ঘটে। ভালোবাসা হল পৃথিবীর একমাত্র শক্তি, যা শত্রুকেও বন্ধু বানাতে পারে এই দর্শনে বিশ্বাস করতেন মার্টিন লুথার কিং। এই মানুষটা আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে ভালোবাসা ও অহিংসা দিয়ে অধিকার আদায় করতে হয়। 

একটা ঘটনা ঘটেছিলো  আমেরিকার মাইগোমারি শহরে ১৯৫৫ সালের পহেলা ডিসেম্বর। এই শহরের সিটি লাইসেন্সে বাস চলেছে। সে বাসটির সামনের আসনে বসেছেন ১২ জন শ্বেতাঙ্গ, পেছনের আসনে বসেছেন  ২৪ জন নিগ্রো। একটি আসনও খালি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যেই বাসের সামনের দিকে বসবার অধিকার ছিল না নিগ্রোদের। সব বাসই সংরক্ষিত থাকে শেতাঙ্গদের জন্য।

শ্বেতাঙ্গরা বসবার পর যদি কোনো আসন খালি থাকে তবেই সেখানে কৃষ্ণাঙ্গরা বসতে পারবে। বাস এক জায়গায় দাঁড়াতেই তিনজন শ্বেতাঙ্গ গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীদের আসন দেবার আদেশ দিলেন। দু’জন কৃষ্ঞাঙ্গ উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু নিজের আসন ছেড়ে নড়ল না রোজা পার্কস নামের একটি  নিগ্রো মেয়ে। রোজা খুব ভদ্র ভাষায়  জানালো, আমি আসন ছাড়ব না।

নিগ্রোদের এ ধরণের আচরণকে আইনের লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করা হতো। রোজাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল এবং তার দশ ডলার জরিমানা হল।  কিন্তু এই  বর্ণ বৈষম্যমূলক  ঘটনার প্রতিবাদ করলেন মার্টিন লুথার কিং। সে প্রতিবাদের ডাকে উত্তাল হলো মানুষ। এক অভিনব আন্দোলনের ডাক দিলেন তিনি। বিচিত্র সেই আন্দোলন। যে আন্দোলনে প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ ছিলো না, ভালোবাসা মিশ্রিত প্রতিবাদ ছিল, না পাওয়ার  আবেগ ছিল। কোনো ঘৃণা, বিদ্বেষ, আক্রোশ ছিলো না। সহিংসতার পরিবর্তে বর্ণ বৈষম্যের শিকার  মানুষদের নীরব ভালোবাসার বিপ্লব ছিল। এই অভূতপূর্ব অহিংস আন্দোলনে সিদ্ধান্ত হলো  কোনো নিগ্রো আর সরকারী বাসে চড়বে না।

তারপর ঘটল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। মন্টগোমারির কোন নিগ্রো আর বাসে চড়লেন না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে গেলো। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ  পায়ে হেটে, কেউ ঘোড়ার গাড়িতে উঠে, কেউবা আবার  সাইকেলে করে  যাতায়াত করতে লাগলো ।

রোজার কণ্ঠের  অহিংস প্রতিবাদের সেই অবিস্মরণীয় সুর লক্ষ  লক্ষ মানুষের প্রতিবাদের ভাষায় পরিণত করলেন মার্টিন লুথার কিং। মহাত্না গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের দর্শনকে  বুকে ধারণ করলেন তিনি। বর্ণ বৈষম্যের হিংস্র থাবা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে গিয়ে ঘাতকের আঘাতে প্রাণ হারালেন তিনি। মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে প্রাণ দেওয়া যায় এমন কালজয়ী দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করলেন তিনি। ভালোবাসা এমন এক শক্তি যা কখনো রক্ত নেয় না, বরং রক্ত দিতে জানে। মানুষটা বলতেন যদি উড়তে না পার, তবে দৌড়াও; যদি দৌড়াতে না পার, তবে হাঁটো; হাঁটতে না পারলে হামাগুড়ি দাও। 

যে অবস্থাতেই থাকো, সামনে চলা বন্ধ করবে না। জীবনের কোনো এক মহাপ্রলয়ে সব থেমে গিয়েছিলো ষ্টিফেন হকিংসের। দুরারোগ্য মটর নিউরন ব্যাধিতে আক্রান্ত  ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়া একটা মানুষ। একটা হুইল চেয়ার যার ঠিকানা। বিজ্ঞানকে ভালোবাসতেন তিনি। বিজ্ঞানের জ্ঞানের বিকাশের মাধ্যমে মানুষকে ভালোবাসতেন তিনি। সে ভালোবাসার শক্তি তার চিন্তা শক্তিকে কেড়ে নিতে পারেনি। এমন একটা কঠিন ও দুঃসহ অবস্থায়ও তিনি বিগ ব্যাং থিউরির উদ্ভাবন করেছেন। মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্যের পিছনে ছুটেছেন। রোগে আক্রান্ত হবার পর চিকিৎসকরা বলেছিলেন তিনি বড় জোর দুই থেকে তিন বছর বাঁচবেন। কিন্তু বেঁচে ছিলেন আরও ৫৫ বছর। গবেষণার মাধ্যমে মানুষের প্রতি ভালোবাসার অমিত শক্তি তাকে মৃত্যুর সাথে লড়তে শিখিয়েছে। নতুন জীবন দিয়েছে। পৃথিবীর স্বার্থপর মানুষ মানুষের সব কিছু কেড়ে নিলেও ভালোবাসার মতো ইতিবাচকশক্তিগুলো কখনো কেড়ে পারে না।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল



এই পাতার আরো খবর