ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

জিজ্ঞাসাবাদে মাননীয় নেত্রীকে অভিযুক্ত করার ষড়যন্ত্র
ড. মোঃ আওলাদ হোসেন
ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

জিজ্ঞাসাবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে আমার ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়ার পর শুরু হয় রাজনৈতিক প্রশ্ন। বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, মাননীয় নেত্রীকে অভিযুক্ত করার ষড়যন্ত্র। প্রশ্নকারীদের মন মতো সাজানো উত্তর না দেওয়ায় শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। প্রথমেই দেওয়া হলো বৈদ্যুতিক শক। তারপর ছাদের ফ্যানহুকের সাথে ঝুলানো হলো। সমস্ত শরীরের ভার দুই হাতের কব্জির উপর পরলো। মনে হচ্ছিল হাতের কব্জিগুলো ছিড়ে যাবে। হাতের কব্জির উপরের অংশ ঠাণ্ডা হতে লাগলো, হাতে কোন ‘বোধ বা Sense` পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করে চারিদিক থেকে একাধিক লোক কোমড় থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত নির্মমভাবে এলোপাতাড়ি পেটানো শুরু করেছিল। রুমে ফিরে চোখ খোলার পর দেখলাম, মারাত্মক জখম করেছিল। কোমড় থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত সর্বত্রই ফেটে ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল।

নির্মম নির্যাতনে জ্ঞান হারালে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা সেবা দ্বারা জ্ঞান ফিরিয়ে পুনরায় নির্যাতন করা হতো। নির্যাতন শেষে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নামক একটি রুমে রাখা হলো। শেষদিন পর্যন্ত এখানেই ছিলাম। এখানে সেবাদানকারী লোকগুলো খুবই ভালো ব্যবহার করেছিল। বিছানায় চাদরসহ তোষক, বালিশ এবং গায়ে দেওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো কম্বল প্রদান করে। নিয়মিত ঔষধ সরবরাহ করা হয়েছিল। খাবারে তরকারির মান অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। 

টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হলে খুবই ভয় হতো। কারণ হাঁটতে খুবই কষ্ট হতো। হাঁটু ভেঙে বসে টয়লেট করতে পারতাম না। দাঁড়ানো অবস্থায় কোন রকম বাঁকা হয়ে টয়লেট করতে হতো। একদিন টয়লেট থেকে ফিরে আসার সময় হঠাৎ শুনতে পেলাম, ক্ষীণ আওয়াজে ফ্যাস ফ্যাস স্বরে কে একজন আমাকে ডাকছে, ‘আওলাদ ভাই, আওলাদ ভাই, আমি রাজ্জাক’। আমি হতচকিত হরিণের মতো চারিদিকে তাকালাম, কোথা থেকে কে ডাকতে পারে? হঠাৎ চোখে পরলো আমার ডান পাশের রুমের ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার দু'দিন পূর্বে রাজ্জাক ও জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজ্জাক আমার খুবই ঘনিষ্ঠ একজন সাবেক ছাত্রনেতা, ডাকসুর সাবেক সদস্য। পরবর্তিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৭ নং সেলে সুখে-দুঃখে এক সাথে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছি। 

বেশ কয়েকমাস নিয়মিত চিকিৎসার পর নির্যাতনের ক্ষত নিরাময় হয়েছে বটে তবে এখনও নির্যাতনের রেশ শেষ হয়নি। শীতের প্রকোপে পায়ের হাড়ের ভিতর ব্যাথা অনুভব করি। 

দুইদিন রাতে ক্রসফায়ার করা হবে বলে অজু করিয়ে হুজুরকে দিয়ে কালেমা পাঠ করানো হয়েছিল। মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা কি, ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবং ক্রসফায়ার করার জন্য বাহিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। 

তন্মধ্যে একদিন সন্ধ্যারাতে চোখে কাপড় বেঁধে, হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বের হলো। কিছুদুর চলার পর হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। আমার চোখের কাপড় ও হ্যান্ডকাফ খুলে দিল। চোখ খোলা রেখে মাথার চুল পরিপাটি করে একটি খোলা মাঠ পায়ে হেটে অতিক্রম একটি মার্কেটের দোতলায় নিয়ে গিয়েছিল। মার্কেটে বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ড দেখে মনে হলো কাফরুলের কোন একটি মার্কেট। আমাকে গাড়ি থেকে নামানোর সময় বলা হয়েছিল, ‘চালাকির চেষ্টা করলে বা পালানোর চেষ্টা করলে পাখির মত গুলি করে মারা হবে’।

খোলা মাঠের মধ্যখানে কিছু লোক গোল করে দাঁড়িয়ে আছে, এর মধ্য দিয়ে আমাকে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। গোলাকার আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মনে পরে যায় পত্রিকায় প্রকাশিত তথাকথিত ‘ক্রসফায়ার’ এর ছবি। মনে মনে ভাবছি হয়তো, এই গোল চক্কর অতিক্রম করার সময় আমারও ঐ একই দশা হবে। মনে মনে দোয়া-দরুদ পাঠ করে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে গোল চক্করে প্রবেশ করলাম। বুক ধড়ফড় করছে। এই বুঝি মৃত্যু দূত হাজির হবে। কিন্তু না, এইযাত্রায় বেঁচে গেলাম। গোল চক্কর অতিক্রম করে সামান্য এগুতেই দোতলা মার্কেট। দোতলায় একটি কাপড়ের দোকানে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। সেখানে ঘুরে ঘুরে কাপড় দেখে ক্যাশ কাউন্টারে যেতে হবে। আমি ভয়ে ভয়ে ধীর গতিতে দোতলায় উঠে নির্দেশ মোতাবেক ঘুরে ঘুরে কাপড় দেখছি। তারপর যথারীতি ক্যাশ কাউন্টারে গেলাম। ক্যাশ কাউন্টার থেকে একজন বললেন, ‘আপনার কাজ শেষ, আপনি চলে যান’। এর মাঝে লক্ষ্য করলাম খানিকটা দূর থেকে একজন লোক আমাকে ভিডিওবন্দী করছে। মনে আরেক আতঙ্ক দানা বেঁধে উঠলো। তবে কি, ওরা আমাকে ফেরার পথে ঐ গোল চক্কর অতিক্রম করার সময় মারবে? পরে নিউজ করবে, মার্কেটে ডাকাতি করতে গিয়ে গোলাগুলিতে মারা গেছে। এই সন্দেহ হওয়ার কারণ, ওরা আমাকে মার্কেটে নিয়ে এসেছে। কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে নাই। কেউ জানে না, কে বা কারা আমাকে এনেছে, কোথায় এনেছে। এমনি মনের অবস্থা নিয়ে দোতলা থেকে নামতে নামতে আবারো দোয়া-কলেমা পড়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। চোখের সামনে ভেসে উঠল ছোট ছোট দুটি মেয়ে নিয়ে স্ত্রী, বৃদ্ধ মা ও অন্যান্য প্রিয় মুখের ছবি। আমার মাতৃতুল্য নেত্রী জানতেও পারবেন না, তাঁর স্নেহের ডঃ আওলাদ কোথায় কিভাবে হারিয়ে গেল।

ভাবতে ভাবতে কখন গোল চক্কর অতিক্রম করেছি টেরই পাইনি। যথারীতি সেই গাড়িতে উঠে বসলাম। মনে হলো নতুন জীবন ফিরে পেলাম। গাড়িতে উঠতেই একটি লোক আমার পাশে এসে বসলেন, ঝড়ের বেগে আমার চোখ বেঁধে ফেললেন, হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলেন। সামনের সিটে বসা কে একজন বললেন, ‘কি হলো’? আমার পাশে বসা লোকটা উত্তর দিলেন, ‘সুযোগ দিলাম, আবারো চেষ্টা করি, দেখি রাজি হয় কিনা’। ফিরে এলাম সেই পুরানো জায়গা JIC (Joint Interogation Cell)-এ।

অন্য আরেকদিন গভীর রাতে খালি পায়ে, চোখ বেঁধে, হাতকড়াসহ কোথাও কোন খোলা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। পায়ের নিচে ঠাণ্ডা ভিজা বালি, ঠাণ্ডা বাতাস, চোখ বাঁধা, চারিদিকে নীরব নিস্তব্ধ। আমাকে শেষবারের মত রাজী করাতে চেষ্টা করছে। আমার মনে নানা ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবলাম, আমি মুসলমান, আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। মরি-বাঁচি মাথানত করবো না। 

আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, ‘শেখ হাসিনা নির্দোষ, নিষ্পাপ’। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে, আমার মায়ের দোয়ায়, আমার এলাকার অসংখ্য নেতাকর্মীর নফল রোজা ও দোয়ার বরকতে, আমি আজও বেঁচে আছি। আমি গর্ব করে বলি, অমানুষিক  নির্যাতন ও মৃত্যুর মুখোমুখি করেও আমাকে দিয়ে মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোন মিথ্যা তথ্য দেওয়াতে পারেনি, কোন মিথ্যা মামলায় বাদী বা সাক্ষী করাতে পারেনি। আমি গর্বিত আমি শেখ হাসিনার কর্মী, আমি মুজিব সৈনিক।

পরবর্তী বিবরণ আগামীকাল...

লেখক: ড. মোঃ আওলাদ হোসেন ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী।

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ



এই পাতার আরো খবর