ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আদালতের মাধ্যমে কারাগারে নিক্ষেপ ও ১০ মাস ৭ দিন কারাবাস
ড. মোঃ আওলাদ হোসেন
ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

ক্যান্টনমেন্ট থানার কয়েদখানায় বসে আমরা কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছিলাম, আমাদেরকে বিভিন্ন প্রকার সাজানো/মিথ্যা অভিযোগের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হবে। বিকেলে আমাদের সকলকে ভাগ ভাগ করে বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাসে করে কড়া পুলিশ প্রহরায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলো।

আদালত লোকে লোকারণ্য, তিলধারণের ঠাই নেই। পঞ্চাশজনেরও বেশি সংখ্যক আসামি, প্রত্যেকের সাথে আপনজন, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে এক বিরাট সমাবেশ। সিঁড়ি বেয়ে আমাদের উপরে তুলতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছেন। দু'জন দু'জন করে জোড়ায় জোড়ায় হাতকড়া পরানো থাকলেও লোকের ভিড়ে আসামি হারিয়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। আমি ও মাহমুদুল হাসান বাবুল ভাইকে একটি  হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে। মানুষের ভিড়ে আমরা দু'জন পিছনে পরে গিয়েছি। আমরা দু'জন সামনে এগুতে চাইলে কর্তব্যরত পুলিশের সদস্যরা আমাদের দু'জনকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ির এক ধাপ নিচে নামিয়ে দিয়ে রাগন্বিতস্বরে বললেন, ‘দেখেন না আসামিদের নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা পরে আসেন’। আমি হাত উপরে তুলে হ্যান্ডকাফ দেখিয়ে বললাম, ‘আমরাওতো আসামি’। বিষয়টি ভেবে প্রায়ই একা একা হাসি। আসামি পুলিশকে বলছে, ‘আমিতো আসামি’, এবং তা প্রমাণ করতে হাতে বাঁধা হ্যান্ডকাফ দেখিয়েছে।

জনাব সালমান এফ রহমান, কাজী জাফরউল্লাহ, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, আ হ ম মোস্তফা কামাল (লোটাস কামাল), মোহাম্মদ নাসিম, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, পংকজ দেবনাথ, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু, গুলশানের কমিশনার আবদুলকাইয়ুম, আমার সাথে গ্রেফতার হওয়া মাহমুদুল হাসান বাবুল, ডাকসুর সাবেক সদস্য স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রাজ্জাকসহ আমাদের সকলকে একসাথে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলো।

আদালতের কাঠগড়াটি কাঠ দিয়ে নয়, লোহা দিয়ে তৈরি। চিড়িয়াখানার বাঘ-সিংহ এর খাঁচার মত। আমরা সকলেই ঐ খাঁচার ভিতরে বিচারকের দিক মুখ করে দাঁড়িয়ে। একে একে সকলেই আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বক্তব্য দিলাম।

কে শুনে কার কথা। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। ‘উপরের নির্দেশে’ যেমনি ৫০ জনেরও বেশি বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করেছে, ঠিক তেমনিভাবে ‘উপরের নির্দেশেই’ ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ডিটেইনসন সহ আমদের সকলকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। গাজীপুরের কাশিমপুর ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দীর্ঘ ১০ মাস ৭ দিন বিনা বিচারে বন্দি থাকতে হয়েছিল।

অনেকেই বলতে পারেন স্মৃতিকথা বা আত্নকথা কেন লিখছি? আমার কারাবাস ও নির্যাতন রাজনৈতিক কারণে, মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দেওয়ানোর জন্য। আমি গর্ববোধ করি আমাকে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে রক্তাক্ত করেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন মিথ্যা কথা বলাতে পারেনি। 

৩১ জানুয়ারি ২০০৭ আমাকে উঠিয়ে নেওয়া হলো, অথচ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ আমাকে অফিসিয়ালি গ্রেফতার করা হলো। এমনও হতে পারতো আমাকে ‌অফিসিয়ালি গ্রেফতার দেখানো হলো না, আমি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতাম। এই কয়দিন আমার জীবনে কি ঘটেছিল তা শুধু আমিই জানি। তবে পরবর্তীতে মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকা থেকে ফেরার পূর্বে একজন গুরুত্বপূর্ণ ও পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি উনার বাসভবনে ডেকে নিয়ে বলেছেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থার প্রাপ্ত তথ্যানুসারে You are most loyal to hon`ble leader Sheikh Hasina and most committed activist of Bangladesh Awami League. এমনকি আপনার শরীরের নিম্মাংশে Brutally torture করা হয়েছে, অ‌থচ আপনি ভেঙ্গে পরেননি, আপনাকে দিয়ে মাননীয় নেত্রী সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য বলাতে পারেনি’। 

একযুগ আগের কালো রাতে চোখ বেঁধে সেই নির্মম নির্যাতন-এর কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে। যদি সেদিন সত্যি সত্যি ‘ক্রসফায়ার‘ করা হতো, পিতৃহারা আমার ছোট ছোট দু’টি মেয়ে রাইয়া ও রামিসা’র খোঁজও কেউ নিতেন না। আমার বিধবা স্ত্রী এতিম মেয়ে দু’টি নিয়ে সারাটা জীবন দুঃখের সাগরে ভাসতো। আমার বৃদ্ধা মা সন্তানের জন্য চোখের পানি ফেলতে ফেলতে হয়তোবা অন্ধ হয়ে যেত। 

২০০১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে জাপানের সোনালী জীবন ফেলে সংগঠনের কাজে মাননীয় নেত্রীর সাথে সারা দেশ ঘুরেছি, ঘর-সংসারের দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিজের সম্পূর্ণ মেধা-মনন দিয়ে সংগঠন গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেছি। 

আজ খুব কষ্ট হয়, চারিদিকে হাইব্রিড আর আদর্শহীন সুবিধাবাদীদের জয়জয়কার। হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীরা দলের নাম ভাঙিয়ে অবৈধ টাকার পাহাড় বানিয়ে, এবং ঐ অবৈধ টাকার অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষের কাছে সংগঠন ও সরকারের ইমেজ নষ্ট করছে, সরকারের সকল অর্জন ধুলিসাৎ করে দিচ্ছে। 

বিএনপি-জামায়াত এর সন্ত্রাসীরা, পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মারার মামলাসহ বিভিন্ন মামলার আসামিরা আত্মগোপন করার উদ্দেশ্যে বিশেষ (?) ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ এর বিভিন্ন পর্যায়ের পদ-পদবী বাগিয়ে নিচ্ছে।

তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ এর প্রকৃত নেতাকর্মীদের প্রতি আহবান, আসুন ঐক্যবদ্ধ হই, হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করি, আগামী দিনে সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠনে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিহত করি। সংগঠন শক্তিশালী করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারাদেশে চলমান উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: ড. মোঃ আওলাদ হোসেন ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী।

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ



এই পাতার আরো খবর