ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

সব অন্ধকার দর্শন ছেড়ে সাধারণ মানুষটা দার্শনিক হয়ে উঠুক
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন "নিজেকে জানো"। আমিও তেমনটাই মনে করি তবে একটু ভিন্নভাবে। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় নিজেকে জানতে গেলে মানুষকে জানতে হয়। সেটা হতে পারে নিজের ভিতরে যে মানুষটা বাস করে সেটা কিংবা বাইরের মানুষেরা। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দর্শনটাকে তাই একটু মোডিফাই করে বলা যায় নিজেকে জানো, তবে সে জানাটা আরও গভীর জীবনবোধ থেকে নিতে হলে অন্যকেও জানো। কেননা সময়ের উল্টোগতিতে মানুষ মানুষকে কাঁচের আয়নায় দেখছে, জীবনবোধের আয়নায় দেখছে না ।

আমি মানুষের দিকে খুব নিবিড়ভাবে তাকাই। সেটা তার বাইরের মুখ ভেদ করে ভিতরের মুখে চলে যায়। সেখান থেকে তার একটা ফটোগ্রাফি তৈরী করি। একটা বায়োগ্রাফিও বানাই। প্রায় সবক্ষেত্রেই বাইরের মানুষটা ভিতরের মানুষটা থেকে আলাদা হয়।  একজন মানুষ কিন্তু দুটো ফটোগ্রাফি, দুটো সত্তা। তখন সে মানুষটার সাপেক্ষে আমি আমার নিজের একটা ফটোগ্রাফি তৈরি করি। সেখান থেকে বোঝার চেষ্টা করি সে মানুষটার বাইরের মুখ ও ভিতরের মুখের ফটোগ্রাফির সাথে আমার ফটোগ্রাফির কতটা মিল, কতটা অমিল রয়েছে। এটা বোঝাটা খুব দরকার, তা না হলে আমি আমাকে চিনতে ও জানতে পারবো না।

আবার যে মানুষদের আমি প্রতিদিন দেখছি তাদের ফটোগ্রাফির পোস্টমোর্টেমটাও আমি করতে পারবো না। সেটা না পারলে আমার নিজের পোস্টমোর্টেমটা করাও  সম্ভব হবে না। কারণ এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিস একটি অন্যটির সাপেক্ষে গড়ে উঠে ও তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা নিজের জায়গাটা বোঝার ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করে। কথাগুলো খুব কঠিন ও দুর্বোধ্য মনে হতে পারে তবে ফেলে দেবার মতো নয়। যেমন মাটির সাপেক্ষে গাছের ভিত্তি গড়ে উঠে। আবার বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, বিভিন্ন উপাদান ও পানির সাপেক্ষে মাটির ভিত্তি তৈরী হয়।

সুসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি' কবিতার একটি অংশে বলেছেন, 'আমি মানুষের পায়ের  কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি, তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।' এখানেও একটা দর্শনগত ধারণা তৈরি হয়েছে নিজেকে জানার ক্ষেত্রে। একটা মানুষ আরেকটা মানুষের ভিতরে তখনই ঢুকতে পারে যখন সে মানুষটা নিজেকে অনেক ছোট করে ভাবতে শিখে । যেটা প্রথাগত শিক্ষা থেকে অর্জিত হয় না বরং সেটা মানুষের জীবনবোধের গভীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অর্জিত হয়। একটা মানুষ অন্যের সাপেক্ষে নিজেকে চেনার ক্ষেত্রে  যতটা ছোটত্বের বোঝা মাথায় নিতে পারে ততটাই বড়ত্বের অনুভূতিশক্তি তার জীবনবোধের অচেনা দিকগুলোকে উন্মোচিত করে।

মানুষ তখন নিজেকে চিনতে চিনতে নিজের শেকড়টা খুঁজে পায়। যদিও সেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকাটা মানুষের জন্য খুব কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা ভাবি, পরীক্ষা মানে প্রতিযোগিতা। পরীক্ষাকে আমরা কখনো সহযোগিতা হিসেবে ভাবি না।এখানটাতেই আমাদের নিজেকে জানার ক্ষেত্রে ভুল একটা তত্ত্ব তৈরী হয়। নিজেকে জানতে হলে নিজের পরীক্ষাটা যত না গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্যের পরীক্ষাকে নিজের ভিতরে ধারণ করা। গতানুগতিক বইপত্রের পরীক্ষা মানুষের জ্ঞান বাড়াতে পারলেও জীবনবোধের দর্শন ও মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করতে পারে না। মানুষের তৈরী পরীক্ষার চেয়ে জীবনবোধের পরীক্ষা অনেক কঠিন। সেই কঠিন জীবনবোধ মানুষের সাপেক্ষে মানুষের মধ্যে স্থানান্তরিত হলে পরীক্ষাগুলো সহজ সহযোগিতায় পরিণত হয়। জীবনবোধের পরীক্ষার রূপান্তরও ঘটতে পারে। তবে সে রূপান্তর মানুষের সাপেক্ষে মানুষের মধ্যে যতটা না ঘটে ততটাই বেশি ঘটে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।। যে মানুষটা টাকা দিয়ে নিজেকে চিনে সে মানুষটা শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের টাকায় দু'মুঠো ভাতের মূল্য বুঝতে পারে না। যে মানুষটা মায়ের আদরে বড় হয়ে একদিন বৃদ্ধা মাকে বোঝা ভেবে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসে সে মানুষটা জানে না তাকেও একদিন সেখানে যেতে হবে হয়তোবা।

যে মানুষটা পেশিশক্তি দিয়ে চিন্তাশক্তিকে দমন করতে চায় সে মানুষটা জানে না সে কতটা অসহায়। যে মানুষটা দালানের পর দালান বানিয়ে পৃথিবীকে স্বর্গ বানাতে চায় সে মানুষটা জানে না তার দেহটা একদিন মাটি হয়ে মাটিতে মিশে যাবে। যে মানুষটা পাপের পর পাপ করেও বুক উঁচিয়ে পথ চলে সে মানুষটা জানে না প্রকৃতি কতটা নির্মম হতে পারে। এমন অনেক নেতিবাচকতার সাপেক্ষে ইতিবাচকতার তুলনামূলক অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সেটা থেকে বের হয়ে এসে মানুষ নিজেকে কতটা জানতে পারে সেটা হয়তো সময় বলবে। ইতিহাস বলবে। তবে মানুষ নিজেকে জানুক নিজের মতো করে। কখনো নিজের ভিতরের মানুষটাকে দেহ থেকে বাইরে টেনে এনে। আবার কখনো তার পাশের চেনা-অচেনা মানুষের ভিতর ও বাইরের বিপরীতমুখী মুখ ও মুখোশ দেখে । সব মানুষের  জন্ম হয়। তখন সবাই মানুষ থাকে। যতই মানুষ বড় হয়ে মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ততই মানুষ মনুষত্বের কঠিন খোলসটা ফেলে দিয়ে ধীরে ধীরে দানব হয়ে উঠে।

স্বার্থের রেখাটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্রমাগতভাবে বেড়ে গিয়ে নিঃস্বার্থ মানুষটাকে হত্যা করে। জন্ম মৃত্যুটা বিপরীতমুখী হলেও একটা অন্যটার সাপেক্ষে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র গড়ে তোলে। মানুষ তেমনটাই করুক যেমনটা করেছে আকাশের বৃষ্টি মাটির সাথে সন্ধি। যেখানে কৃষকের সোনালী চোখ সে মাটিতে ফসল তোলার আনন্দে ঝিকিমিকি করে উঠে। সব অচেনা চেনা হোক। মানুষ হয়ে উঠুক মানুষের মানুষ। জনপদের পর জনপদে মানুষের মহামিলনের মিছিল হোক। যেখানে সত্যটা মিথ্যেকে হারিয়ে মানুষের ভিতরে জীবনবোধের আগুন ছড়িয়ে দেবে একটু আলোর খেলা দেখবে বলে। আমরা যতটা না মানুষ তার থেকেও বেশি মানবিক মানুষ হই। মানুষের মতো মানুষ হই। উদার হই। তখন যে ছাড়পত্রটা মানুষ পাবে সেটাই মানুষকে মানুষ বানিয়ে তার অস্তিত্বটা তাকে চিনিয়ে দিবে। হয়তো এটাই নিজেকে জানার মহাকাব্য। অন্যকে জানার মহাসন্ধিক্ষণ। সবটাই যেন একটা সেতারের সুরে বাধা চেনা অচেনা জীবনবোধের খেলা। সেটাই চেনা হোক যতটা চেনা যায় ঠিক ততটাই  অচেনা থেকে যায়। তারপরও সব অন্ধকার দর্শন ছেড়ে সাধারণ মানুষটা দার্শনিক হয়ে উঠুক। মানুষগুলো দর্শনের বই হোক। বই থেকে কালো অক্ষর বেরিয়ে ঠিকরে পড়ুক মানুষের অন্তরে। যে অন্তর মানবিক নগরের ইট পাথরের মানুষ ভেঙে সোনার মানুষ গড়ে তুলবে সহসাই।

আমরা যে  আলোকিত মানুষটাকে অযত্নে ফেলে রাখি সময় তাকে মূল্যায়ন করে সে সময়েও। মানুষ মূল্যায়ন করে আরো পরে কারণ যে সময়ে মানুষটা পৃথিবীতে ছিল সে সে সময়ের মানুষ তাকে বুঝে উঠার মতো শক্তি অর্জন করতে পারেনি কিংবা নিজেদের বড়ত্ব খর্ব হবে বলে সত্যটা জানলেও তা মেনে নেবার ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা থেকে বিরত থেকেছে। মানুষ মানুষকে মর্যাদা দিলে ছোট হয় না বরং বড় হয় সেটা মানুষ মানুষের সাপেক্ষে আয়ত্ত করতে পারেনি অথবা সেটা চায়নি । বরং অনেকটা সময় পর যখন মানুষটা পৃথিবীতে থাকে না তখন মানুষটার কদর বাড়ে। মানুষ কেন যেন বেঁচে থাকতে মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারে না কিন্তু মানুষ মরে গেলে  মানুষ বড় হয়ে উঠে। বিস্ময়কর এক মানুষের বানানো নিয়ম । যে নিয়ম বলছে মানুষ মরে গেলে বেঁচে উঠে, বেঁচে থাকতে মরে যায়। এমনটা তো আমরা চাইনা। যা ঘটার ঘটুক, যা চলার চলুক। তবে তা যেন ইতিবাচকতার প্রাচীরে ফাটল না ধরায়। মানুষের মনে ফাটল না ধরায়।

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর