ঢাকা, বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

গবেষক হতে হলে একটা নির্ভেজাল মন থাকতে হয়
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

পৃথিবীতে অনেক শক্তি আছে। সে শক্তিগুলোর ধংসও আছে। তবে কিছু কিছু শক্তি আছে যা অবিনশ্বর। মানুষ তার পেশিশক্তি, ক্ষমতা, ষড়যন্ত্র কোনটা দিয়েই সেগুলোকে দমাতে পারে না। সে শক্তি টাকা দিয়ে কেনা যায় না, কেউ চাইলেও সে শক্তি অর্জন করতে পারে না।    যেমন মানুষের চিন্তা শক্তি, চিন্তা শক্তিতে গড়ে উঠা মানুষের গবেষনা শক্তি।

গবেষণায় এমন এক অভূতপূর্ব শক্তি যা মানুষের ঘুমকেও কেড়ে নেয়। কঠিন তপস্যার সে জীবন। তবে সেটা যতই কঠিন হোক না কেন,  মানুষ যখন তার চিন্তা দিয়ে নতুন কোনো ধারণা তৈরী করে তখন সে কঠিনত্ব বরফের মতো গলতে গলতে জলে ভেজা আনন্দ হয়ে উঠে। সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে গবেষককে আরেকটা নতুন চিন্তার জগতে নিয়ে যায়। কারণ গবেষণা কখনো থেমে থাকে না। একটার পর একটা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ক্রমাগত একটার পর একটা নতুন চিন্তার জন্ম দিতে থাকে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে সারা পৃথিবী চিনেছে চিত্রশিল্পী হিসেবে। তবে যে মানুষ বিস্ময়করভাবে আঁকতে জানে সে মানুষটা তার শিল্পের ভিতর দিয়ে নতুন ধারণার জন্ম দিতেও পারে। কারণ মানুষের শিল্প সত্তা মানুষের ভিতর কল্পনাশক্তি গড়ে দেয়। সে কল্পনাশক্তির একটু একটু করে উম্মেষ মানুষকে শিল্পী থেকে গবেষক বানায়। ঠিক যেমনটা ঘটেছিলো ৫০০ বছর আগে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপার, লেডি উইথ অ্যান আরমিন, ভার্জিন অব দ্য রকস্, দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান এর মতো বিস্ময়কর ছবিগুলোই আঁকেননি, রোবট, ফ্রিজ, গাড়ি এমনকি হেলিকপ্টারের ধারণার  জন্মও তিনি দিয়েছিলেন সে সময়। এর মধ্যে কোনটা কোনটা তিনি তৈরিও করেছিলেন। সে সময় এনার্জি সাশ্রয়ের বিষয়টা ভাববার মতো অবস্থায় না থাকলেও তিনি ভেবেছেন। সেখান থেকে ত্রিবলজি নামে নতুন আরেকটা গবেষণার পৃথিবী তিনি তখনই তৈরি করেছিলেন। এই বিষয়গুলি এখন পৃথিবীর গবেষণার অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়েছে। কেবল যান্ত্রিকতা নিয়ে তিনি গবেষণা করেননি বরং সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি মানবদেহ এবং রোগ নিয়েও গবেষণা করেছেন। 

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যদি আজকের দিনের গবেষণা নিয়ে ৫০০ বছর আগে ভেবে থাকতে পারেন, তবে আজকের দিনে যারা গবেষণা করছেন তারাও ৫০০ বছর পরের কিংবা তারও পরের গবেষণার ভিত্তি এখনই গড়ে দিতে পারেন। গবেষণা মানুষকে কেবল বর্তমান নিয়ে ভাবায় না, ভবিষ্যত কিংবা ভবিষ্যত পেরিয়ে অসীম কোনো সময় পর্যন্ত মানুষকে ভাবায়। কিন্তু কিভাবে ভাবায়। মানুষের মধ্যে চিন্তা তৈরির মানসিকতা থাকলেই মানুষকে ভাবায়। চোখ দিয়ে সবাই দেখে কিন্তু মন দিয়ে কেউ কেউ দেখে। এই মন দিয়ে দেখাটাতে যখন নতুন কিছু অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা থাকে তখন মানুষ না চাইলেও মানুষের মন মুঠো মুঠো নতুন চিন্তার দ্বারা তাড়িত হয়ে একদিন অনুসন্ধিৎসু মানুষে পরিণত হয়। মানুষ তখন আর বসে থাকতে পারেনা, আপন মাঝে শক্তি ধরে উঠে দাঁড়ায় সহসাই। মন থেকে কল্পনা, কল্পনা থেকে নতুন চিন্তার জন্ম হয়। মানুষের অগোচরেই সেই নতুন চিন্তাটা সব অচলায়তন ভেঙে স্বপ্ন হয়ে যায়। যখন চিন্তাটা স্বপ্ন হয় তখন মানুষ তার পিছনে বিরামহীন ছুটতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা লক্ষ্যে পরিণত হয়। মানুষ যখন এই লক্ষ্যকে অর্জন করার প্রচেষ্টা শুরু করে তখন সে মানুষটা গবেষক হয়ে যায়। স্বপ্ন আর লক্ষ্যের মধ্যে তিল তিল করে মানুষটার যোগসূত্র তৈরির যে আরাধনা অবিরত চলতে থাকে সেটাই হলো গবেষণা। গবেষণা করা কি এতো সহজ। সেখানে পরতে পরতে অনিশ্চয়তা থাকে। ভাঙা-গড়া, চড়াই-উৎরাই থাকে। সফলতা-বিফলতা থাকে। আশা-ব্যর্থতা থাকে। তবে গবেষণায় বিফলতা ও ব্যর্থতাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখাটা ঠিক নয়। কারণ গবেষণার ব্যর্থতা ও বিফলতা একধরণের নতুন অভিজ্ঞতা যা সেই গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করার অমিত শক্তি প্রদান করে। যখন গবেষণা ব্যর্থ হয় তখন সেই ব্যর্থতার ফলাফল থেকে নতুন নতুন গবেষণার পথ তৈরি হয় হয়। গবেষণা তাই কখনো হারে না, পথ হারায় না। গবেষকরাও কখনো হারেনা, পথ হারায় না। গবেষকদের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সেখানে হারাবার থাকে অনেক কিছুই, পাওয়ার কিছু থাকে না। একটা উদার মন গবেষকদের থাকতে হয়। উদার মানে অনেক বড় একটা বিশুদ্ধ মন থাকতে হয়। কারণ বিশুদ্ধ মন থেকেই নতুন চিন্তা উৎসারিত হয়। যেখানে নৈতিকতা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। এই নৈতিকতার বিষয়টিকে মাথায় রেখেই একজন গবেষককে কাজ করে যেতে হয়। যে সৃষ্টি মানুষের ধ্বংস আনে তা আবর্জনা হতে পারে, তা কখনো গবেষণা হয় না। গবেষকদের গবেষণা পিপাসা কখনো পূরণ হয় না। এটা যেন আব্রাহাম মাসলোর নিড ফর সেলফ একচুয়ালাইজেশন থিওরির মতো। যেখানে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ তার বিখ্যাত অর্জনেও তৃপ্ত হয়না বরং কি যেন একটা না করতে পারার বাসনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, তাড়িয়ে বেড়ায়। যেমন আইজাক নিউটনের মতো পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানীও শেষ বয়সে এসে বলেছেন “আমি জানি না বিশ্বের কাছে আমি কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছি, কিন্তু আমার কাছে আমার নিজেকে মনে হয় এক ছোট বালক যে কেবল সমুদ্র উপত্যকায় খেলা করছে এবংএকটি ক্ষুদ্র নুড়ি বা ক্ষুদ্রতর এবং খুব সাধারণ পাথর সন্ধান করছে, অথচ সত্যের মহাসমুদ্র তার সম্মুখে পড়ে রয়েছে যা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেল।” হরিপদ কাপালী একটা অশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। না ছিল তার অর্থ, না ছিল তার বিত্ত। কিন্তু ধানক্ষেতে কাজ করার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ছিল। একবার ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে নতুন ধরণের গাছ দেখতে পেলেন। তার কাছে সেটা ধান গাছের মতো মনে হলো। অনেকে বলেছিলো এটা আগাছা, ফেলে দাও। হরিপদ কাপালী তা করেননি। খুব নিবিড়ভাবে গাছগুলোর যত্ন করেছেন। সন্তানের মমতা দিয়ে বড় করেছেন আর অবাক হয়েছেন যখন দেখেছেন সেই গাছগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে নতুন জাতের ধান। সে ধানের বীজ তৈরি করে তা ছড়িয়ে দিলেন সারা মাঠে। এরপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা। অপেক্ষার ঘোমটাটা লজ্জা ভেঙে একদিন খুলে গেলো। মাঠ ভরে এতো পরিমান ধানের ফলন হয়েছে যা মানুষ আর কখনো দেখেনি। হরিপদ কাপালী একজন সাধারণ কৃষক থেকে হয়ে গেলেন গবেষক। তার আবিষ্কৃত ধানটির নাম রাখা হলো হরি ধান।গবেষক হতে হলে শিক্ষা লাগে না। গবেষক হতে হলে একটা নির্ভেজাল মন থাকতে হয়। যে মন মানুষের অজান্তে মানুষকে গবেষক বানিয়ে ছাড়ে। যে ভেবেছিলো সে গবেষণার কিছু জানে না সে হয়েছে গবেষক। আর যে ভেবেছিলো সে গবেষক হবে সে কখনো গবেষক হতে পারেনি। কোথায় যেন একটা অদেখা আলো। সে আলোটা ঠিকরে পড়বে কখন কার দেহে। কেউ জানে না। তবে যে জানে সে বলতে চায় না। হয়তো সে হবে আগামী পৃথিবীর বিখ্যাত গবেষক। গবেষণায় আমাদের নতুন দিনের ডাক দিতে হবে। যেখানে গবেষণা মানুষের কাছে বোঝা না হয়ে গবেষণার সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হবে। জয়তু গবেষণা, জয়তু গবেষক।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর