ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর বন্ধুত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছে। পাঁচটি সমঝোতা স্মারক চুক্তির পাশাপাশি ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে তাঁরা আন্তরিকভাবেই আগ্রহী। আন্তরিক উদ্যোগ দেখা গেছে, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার ক্ষেত্রেও। মোদি বুঝিয়ে দিয়েছেন, জিওপলিটিক্সে বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়েই চলতে চায় দিল্লি। তাই কোভিড পরিস্থিতিতেও ঢাকা সফরকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তিনি।
ঐতিহাসিক একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে মোদির এবারের বাংলাদেশ সফর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও ৫০ বছর পূর্তি। তাই মোদি ঢাকা সফর এবার ঐতিহাসিক কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন মোদি। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সুদৃঢ় সম্পর্ক কেউ নষ্ট করতে পারবে না, বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে-এমন কোনো শক্তি নেই’। মোদির বক্তব্যের সঙ্গে কাজেরও অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। তিনি শুধু কথায় বিশ্বাসী নন, কাজেও বিশ্বাসী। তাই দুই দিনের সফরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা শোনা যায় তার কাছ থেকে। ৫টি চুক্তি স্বাক্ষরের পাশাপাশি উভয় দেশের বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করার চেষ্টাও চোখে পড়ে। মানুষের কল্যাণে কাজ করার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ। সন্ত্রাস দমন ও দরিদ্রতা দূরীকরণ নিয়ে উভয় নেতার মধ্যে আলোচনা হয়।
মোদির এবারের সফর বিভিন্ন কারণে ঐতিহাসিক হিসেবেই চিহ্নিত হবে। ৫টি সমঝোতা স্মারক এবার স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তিগুলি হলোঃ ১) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, ২) বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এবং ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়ার (আইএনসিসি) মধ্যে সহযোগিতা, ৩) বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূর করতে একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা, ৪) বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার ও রেফারেন্স বই সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ সহযোগিতা এবং ৫) রাজশাহী কলেজ মাঠের উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতেই এই পাঁচটি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়।
শুধু দ্বিপাক্ষিক ৫টি চুক্তিতেই সীমাবদ্ধ নয় মোদির এই সফর। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতের পক্ষ থেকে ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স ও ১২ লাখ করোনা টিকা উপহার তুলে দেন। ভারতের এই উপহার দু’দেশের মৈত্রীকে আরও সুদৃঢ় করবে। মোদি তার ভাষণে বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্ব যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তারও প্রশংসা শোনা গিয়েছে। সব মিলিয়ে মোদির সফর ছিল উভয় দেশের সম্পর্কের উন্নয়নে নতুন দিক নির্দেশক। সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাইছে উভয় দেশ।
বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব যৌথভাবে উদযাপনের বিভিন্ন পরিকল্পনাও তাদের আলোচনায় স্থান পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আগামী বছর ভারত সফরের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আসলে ভারত ও বাংলাদেশ তাদের সম্পর্ককে শুধু তিস্তার পানি বণ্টনের মধ্য আটকে রাখতে নারাজ। তিস্তা নিয়েও ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। ভারত নীতিগতভাবে তিস্তার পানি দিতে সম্মতও হয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সেটা এখনই হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি হওয়া আমাদের জন্য খুব দরকার। আমাদের দেশের একটা অঞ্চল পানির অভাবে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পানির দরকার তারা বলেছেন, তাদের কিছু সমস্যা আছে। দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ও আন্তরিক তারা। শুধু তিস্তা নয়, ছয়টি যৌথ নদীর ন্যায্য হিস্যার বিষয় আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ, এ বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এর থেকেই পরিস্কার, দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত আন্তরিক উভয় দেশ। আর মোদির এই সফর দীর্ঘমেয়াদী সুফল দেবে সীমান্তের দুপারের মানুষকেই। কারণ বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করার অঙ্গীকারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থসিদ্ধিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবারের শীর্ষ সফরে। ফলে উভয় দেশের মানুষই উপকৃত হবেন।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা