ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আবেগ আর যুক্তি কখনো কখনো খুব অসহায় হয়
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

আবেগ আর যুক্তি কোনটা বেশি শক্তিশালী। কোথাও কোথাও আবেগ, আবার কোথাও কোথাও যুক্তি। তবে যুক্তি যেখানে থাকে আবেগের সেখানে মৃত্যু ঘটে। যেখানে যুক্তি নেই সেখানে আবেগ শক্তি নিয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়, কখনো কখনো তার প্রয়োজন যুক্তির থেকে অনেক বেশি। বিজ্ঞান আবেগে চলেনা যুক্তিতে চলে তবে বিজ্ঞানের নতুন চিন্তা আবেগ থেকেই আসে। আবেগ মানুষের মধ্যে কল্পনা তৈরি করে। সে কল্পনা নিছক কল্পনা থেকে একদিন বিজ্ঞানের যুক্তিতে পরিণত হয়। আবেগ তাহলে যুক্তি তৈরি করতে পারে। যুক্তি কি আবেগ তৈরি করতে পারে? যুক্তি ও আবেগ হয়তো উল্টোপথে হাটতে হাটতে একদিন হাত ধরাধরি করে চলে। 

হেলাল হাফিজের কবিতাটা মনে পড়ে গেলো:

যুক্তি যখন আবেগের কাছে অকাতরে পর্যুদস্ত হতে থাকে, সেইটে বোধ করি সবচেয়ে বেশি সংকোচ আর সংকটের সময়।

আবেগ থেকে অনেক সময় জন্ম নেয় প্রেম যা যুক্তিকে মানতে চায় না। ব্রিটিশ রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড ফ্রান্সে পালিয়ে থাকা ওয়ালিস সিম্পসনের প্রেমে পড়ে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। অষ্টম এডওয়ার্ড কাছে ক্ষমতা যৌক্তিকতা হারিয়ে আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আবেগ দুমড়ে মুচড়ে খেয়েছে ক্ষমতার লোভকে, দুর্বোধ্য অহংকারকে। কখনো কখনো ক্ষমতা যে আবেগের কাছে খুব অসহায় তার প্রমাণ মিলেছে এখানে। 

রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও টলস্টয় মানুষের ঘুমন্ত জীবনবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, নীতিবোধকে জাগিয়ে তোলার মনস্তত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। টলস্টয় সম্পর্কে উনিশ শতকের ব্রিটিশ কবি ও সমালোচক মেথু আর্নল্ড বলেছেন, “টলস্টয় শুধু এক শিল্পকর্ম নয়, বরং জীবনের একটা অংশ।” বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন, “টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।” এতো বড় মাপের একজন মানুষ যিনি সাহিত্যকে জীবনের যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে বিচার করেছেন তিনিও আবেগের কাছে পরাভূত প্রেমে পড়েছেন।

লিও টলস্টয়ের ভেলেরিয়া আরসেনাভকে আবেগ মথিত প্রেমের চিঠি দিয়েছেন এভাবে : 

"প্রিয় আমি তোমার সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত, বিমোহিত। আমার এ ভালোবাসা অপার্থিব। পৃথিবীর কোনো কিছুই টলাতে পারবে না আমার এ ভালোবাসাকে। পৃথিবীর কোনো কিছুই সহজলভ্য নয়। সেরূপ তোমার প্রতি আমার প্রেম বন্দনাও আমার সাধনা।

তোমারই লিও"

এই মানুষটা একসময় আবেগ আর যুক্তিকে পিছে ফেলে জীবনকে দেখেছেন আরেক রূপে। সেটা যে কি তা হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না। সে  জানাটা হয়তো যুক্তির পিছনে আবেগ, আবেগের পিছনে যুক্তিকে খুঁজে মরেছে। তারপরও কোনো একটা অদেখা জীবনবোধের স্বপ্নের সাথে জীবনের অংক মিলাতে না পেরে অসহায়ত্বকে আঁকড়ে ধরেছে। যৌবনে তার বেহিসাবি জীবন যাপন অর্থের অপচয় ঘটিয়েছে যুক্তিহীনভাবে অথচ বয়স যতই বেড়েছে মানুষটা ততই আত্মত্যাগের মন্ত্রণা দ্বারা তাড়িত হয়ে সর্বত্যাগী হয়ে উঠেছে যুক্তিবাদের বিশ্বাসে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে  কাউকে না জানিয়ে ঘর ছেড়ে তিনি হঠাত করেই বেরিয়ে পড়েন লোকালয়ে। প্রচণ্ড শীতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রেলস্টেশনে পু ঝিক ঝিক শব্দের অন্তরালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন অবলীলায়। সকলের অগোচরে। হয়তো আবেগ আর যুক্তির সব মূল্য মিটিয়ে দিয়ে তিনি মানুষকে জীবনবোধ শিখাতেই এমনটা করেছেন।

কিছু মানুষ যুক্তি নির্ভর হয় কিন্তু পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের মধ্যে তার নিজের আবেগের একটা জায়গা থাকে। একটা ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে তার ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য দু'মুঠো খাবারের চেয়ে পৃথিবীর আর কোনোকিছুই মহা মূল্যবান হতে পারে না। এই সময়টাতে আবেগ আর যুক্তি দুটোই মূল্যহীন। 

আবার কেউ কেউ অবৈধ টাকা খেতে খেতে তার ক্ষুধার যন্ত্রণাকে ভুলে যায়। তার কাছেও যুক্তি আর আবেগ দুটোই মূল্যহীন। কিন্তু এ দুটো মানুষের মধ্যে কোন মানুষটাকে আমরা যুক্তি আর আবেগ দিয়ে যথার্থ বলবো। যে মানুষটা একমুঠো খাদ্যের জন্য জীবনের সাথে লড়ছে নাকি যে মানুষটা টাকার ক্রীতদাস হয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণাকে ভুলতে বসেছে। বিচার বিবেচনাটা আমাদের সকলের। আমরা কখনো স্বার্থের টানে যুক্তির আশ্রয় নেই, আবার কখনো স্বার্থের টানে আবেগের আশ্রয় নেই। স্বার্থে না আছে আবেগ, না আছে যুক্তি, আছে ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়’ এর মতো গভীর তত্ত্ব। তারপরও মানুষ আবেগের কাছে হারুক, যুক্তির কাছে হারুক কিন্তু জীবনের কাছে জিতুক। বাস্তবতার সাথে লড়তে লড়তে জিতুক। কল্পনা আর স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে ধুঁকে ধুকে জিতুক। যেখানে আমৃত্যু দুঃখের আগুনে পুড়তে পুড়তে মানুষ যেন একদিন খাঁটি সোনা হয়ে উঠে।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর