ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন অভিজ্ঞতা এবং করোনা নিয়ন্ত্রণে সফলতা
ডা. নুর রহমান (খোকন)

প্রায় দেড় বছর আগে শুরু হওয়া করোনা তাণ্ডব বিশ্বের প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সামাজিক জীবন, ভ্রমণ, বাণিজ্যসহ সার্বিক অর্থনীতির উপর অভাবনীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনা রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসটির পরিবর্তনশীল এবং অনেক অজানা প্রকৃতির কারণে নিশ্চিত সঠিক প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক ব্যবস্থা প্রণয়নে বিশ্বব্যাপী সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। ঔষধ বা ভ্যাকসিন এর কার্যকারিতা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চয়তা কেউ দিতে না পারলেও একটি বিষয় সম্পর্কে সবাই একমত এবং প্রমাণিত যে রোগটির সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো সংক্রমণের চেইনকে বিঘ্নিত করা। তার মধ্যে সঠিক নিয়ম মেনে সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়া এবং টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার আগে কাউকে জনগোষ্ঠীতে প্রবেশে বাধা দেওয়া তথা কোয়ারান্টিনে ব্যবস্থা করা।  যেসব দেশে এই নিয়মগুলি যত বেশি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে সেই দেশগুলোতে করোনা সংক্রমণ ততটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধের নিয়মগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো অন্য দেশ থেকে আসা কোনো ব্যক্তিকে নিজের দেশের অভ্ভন্তরে প্রবেশের আগে বিশেষ ব্যবস্থায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা। সম্প্রতি ব্রুনেই থেকে অস্ট্রেলিয়া গমন এবং ফেরত আসার সময় দুই দেশেই কোয়ারেন্টাইনের বিশেষ ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর এই অভিজ্ঞতার আলোকেই বলতে পারি করোনা নিয়ন্ত্রণে এই দুই দেশের অভাবনীয় সফলতা এসেছে।

২০২০ সালের মার্চ মাসের ৯ তারিখে ব্রুনেইতে প্রথম করোনা রোগী চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকেই ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপসহ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া শুরু করে দেশটির সরকার। এর মধ্যে অন্যতম হলো দেশে আগমন আর দেশ থেকে বহির্গমনের উপর অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পূর্বানুমতি ছাড়া কেউ দেশে আগমন বা দেশ থেকে বহির্গমন করতে পারে না।  বিশেষ ব্যাবস্থায় বিদেশে অবস্থানরত ব্রুনেইয়ান দেড় দেশে ফেরত আনার পদক্ষেপ গ্রহণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকরী পদক্ষেপ হলো বিদেশ থেকে বিমান, স্থল, নদী বা সমুদ্র পথে আসা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের (যা বর্তমানে দেশ ভিত্তিক শিথিলযোগ্য করা হয়েছে) হোটেল কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্রুনেই থেকে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করি। করোনাকালীন ভ্রমণের নিয়ম অনুযায়ী আমার রিপোর্টিং মন্ত্রী তথা আমাদের কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এর চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত ভ্রমণের পূর্বানুমতি পত্রসহ প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ে আবেদন দাখিল করি।  দীর্ঘ এক বছর পরিবারের সদস্যদের সাথে করোনা নিষেধাজ্ঞার কারণে দেখা না হওয়ায় বিষয়টিকে জরুরি ভ্রমণ হিসেবে দেখা হয়।  যথারীতি অনুমোদনও মিলে।  অন্য দিকে অস্ট্রেলিয়া শুধু নিজ দেশের নাগরিক বা অনুমতি সাপেক্ষে অতি জরুরি প্রয়োজনীয় ভ্রমণকারীদেরকেই আগমনের অনুমতি দেয়। সীমিত সংখক এয়ারলাইন চলাচলের এই দুঃসময়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন এর একটি ফ্লাইট বুক করি। এয়ারলাইন থেকে শর্ত ছিল (১) ব্রুনেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমতি (২) অস্ট্রেলিয়া প্রবেশের অনুমতি (৩) ভ্রমণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করোনা টেস্ট এবং নেগেটিভ রেজাল্ট (৪) অস্ট্রেলিয়াতে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য সরকার নির্ধারিত খরচ (অস্ট্রেলিয়ান ডলার ৩০০০+) বহন করার অঙ্গীকার (৫) ব্রুনেইতে ফেরত আসার জন্য ব্রুনেই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পূর্বানুমতি (৬) ভ্রমণের সময় সার্বক্ষণিক মাস্ক ব্যবহার (৭) স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা (৮) সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা । এই সবগুলি শর্ত পূরণ করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন এর একটি ফ্লাইট এ যাত্রা করি। 

সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট হোটেলে চেক ইন করতে গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ভ্রমণকারীদের জন্য ভিন্ন রকমের ব্যবস্থা।  করোনা মুক্ত হওয়ার কারণে ব্রুনেই থেকে আগত ভ্রমণকারীদেরকে এয়ারপোর্টে মাস্ক পরিধান এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনেচলা সাপেক্ষে অবাধ ঘোরাফেরার জন্য একপ্রকারের গলায় ঝুলানো অনুমতি ব্যাজ দেয়া হয় । হোটেল থেকে বলা হলো শুধু ব্রুনেই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড , তাইওয়ান, চীন , সিঙ্গাপুর থেকে ভ্রমণকারীদের জন্য এই ব্যাজ প্রযোজ্য।  অন্য দেশ থেকে আগতরা এই ব্যাজ পাবে না।

সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট হোটেলে  ১১ ঘণ্টা ট্রানজিট শেষে সিডনি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখলাম সুনসান নীরবতা।  যে এয়ারপোর্ট এ কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে এয়ারক্রাফট অবতরণ করতো সেখানে মাত্র একটি ফ্লাইট এর আগমন।  সব যাত্রীদেরকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া হলো। তাপমাত্রা চেক করার পর ইমিগ্রেশন, তারপর ব্যাগ সংগ্রহ করে দ্রুত সময়ে বাসে হোটেলে যাওয়ার প্রস্তুতি। মজার ব্যাপার হলো আমরা কোন হোটেলে থাকবো তা আগে থেকে বলা হয়নি। সম্ভবত মানুষের অহেতুক উৎকণ্ঠা এবং স্বজনদের ভিড় এড়ানোর জন্যই এই ব্যবস্থা। বাসে ব্যাগ উঠানো, হোটেলে চেক ইন এবং রুমে পৌঁছানো পর্যন্ত সমস্ত কাজগুলো করলো অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর লোকজন। বলা হলো ১৪ দিন অতিবাহিত হওয়ার আগে হোটেল রুম থেকে একেবারেই বের হওয়া যাবে না। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন তিন বেলা খাবার দিত। হোটেলের স্টাফরা এসে দরোজায় নক করতো এবং দরজার বাইরে খাবার রেখে চলে যেত। তার কয়েক মিনিট পরে দরজা খুলে প্যাকেট করা খাবার নিতাম। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খাবার দেওয়া হতো। হালাল খাবারের জন্য অনুরোধ করা ছিল। প্রতি বেলায় হালাল শব্দটি প্যাকেটের গায়ে লিখা থাকতো।  দিনে অন্তত দুইবার হোটেলে অবস্থানরত নার্স এবং স্টাফরা ফোন করতো।  বিশেষত প্রতি দিনই নার্সরা জিজ্ঞেস করতো বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে চাইতো। বুঝতে পারলাম এশিয়ানদের জন্য এই সমস্যাটা আমলে নেওয়ার মতো না হলেও পশ্চিমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  আঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে বড় হওয়া মানুষ। তাই কোয়ারেন্টাইনে একা থাকাটা কষ্টের হলেও অসম্ভব নয়।

দ্বিতীয় দিন এবং ১২তম দিনে করোনা  স্যাম্পল নেয়া হলো।  রুমের দরজার বাইরে ডাক্তার, নার্স আর হোটেল স্টাফ এসে মুখ এবং নাক থেকে স্যাম্পল নিয়ে গেলো।  দুটি টেস্টই নেগেটিভ হওয়ায় ১৪ দিন পর মুক্ত জীবন ফিরে পেলাম।  চেক আউট করার সময় পেমেন্ট এর কোনো প্রয়োজন ছিলো না কারণ নিদ্রিষ্ট ইনভয়েস ইমেইল করে পাঠানো হবে। অস্ট্রেলিয়ান সরকার প্রাথমিকভাবে হোটেলকে পেমেন্ট করেছে যা ভ্রমণকারীকে পরে সরকারের নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টে জমা করতে হবে।

আগে থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী স্ত্রী আর দু সন্তান অপেক্ষায় ছিল হোটেলের বাইরে। দীর্ঘ বিরতির পর প্রিয়জনদের কাছে পাওয়ার পরম আনন্দে সিডনি এবং কুইন্সল্যান্ড এ অত্যন্ত প্রাণবন্ত সময় কাটালাম ১৬ দিন।  তারপর ফেরার পালা।

অস্ট্রেলিয়া থেকে বহির্গমনের জন্য বিধান ছিল (১) গন্তব্যের দেশে ভ্রমণের পূর্বানুমতি (২) ভ্রমণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করোনা টেস্ট রেজাল্ট নেগেটিভ (৩) অস্ট্রেলিয়া থেকে বহির্গমনের অনুমতি , তবে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ৩ মাসের বেশি সময়ের জন্য ভ্রমণ করলে এই বিধান শিথিলযোগ্য।  আমি যেহেতু ৩ মাসের অধিক সময় ব্রুনেইতে  থাকবো তাই অনুমতির প্রয়োজন হয়নি।

নির্দিষ্ট দিনে মাত্র ২২ জন যাত্রী নিয়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন এর এয়ারক্রাফট টি যাত্রা করলো।  এয়ার হোস্টেজরা করোনার সব বিধান মেনে খাবারসহ সংশ্লিষ্ট সেবা নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। যাত্রী খুব কম থাকায় যাত্রী সেবা ছিল অপেক্ষাকৃত উত্তম মানের। আগের মতোই সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট হোটেলে ১২ ঘণ্টা ট্রানজিট শেষে ব্রুনেই এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। সামান্য কিছু পার্থক্য ছাড়া ব্রুনেই এবং অস্ট্রেলিয়ার কোয়ারেন্টাইন বিধান প্রায় একই।  পার্থক্যগুলি হলো (১) হোটেল ট্রান্সফার এর জন্য পুলিশ বা সেনাবাহিনী নিযুক্ত করা হয়নি ব্রুনেইতে (২) অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার কারণে মাত্র ৬ দিন কোয়ারান্টিনে থাকতে হয়েছে (৩) করোনা টেস্ট স্যাম্পল দেওয়ার জন্য মিনি বাসে নির্দিষ্ট সেন্টারে এ যেতে হয়েছে (৪) ব্রুনেইতে হোটেল রুম এর সাথে ব্যালকনি ছিল এবং ব্যালকনিতে যাওয়ার অনুমতি ছিল (কিন্তু করিডোরে এ নয়)।

দুই দেশেই সরকার নির্ধারিত এই সুশৃঙ্খল বিধানগুলি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালনের  কারণেই ব্রুনেই এবং অস্ট্রেলিয়াতে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। ব্রুনেই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে করোনার  বিধানগুলি যথাযথ পালন করলে অন্য দেশগুলিও করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।  আগে জীবন, পরে বাণিজ্য। নিজে বাচুন, অন্যকে বাঁচতে দিন। বাঁচতে চাইলে, বাঁচাতে চাইলে নিয়ম মানার বিকল্প নাই।

লেখক : প্রধান নির্বাহী, ঘানিম ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন (ব্রুনেই হালাল ফুডস) লেখকের মেইল rahmannur@hotmail.com

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর