ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

রাজনীতিতে গুরুর দীক্ষায় শিষ্য এবং অতিভক্তির পরিণতি
সোহেল সানি
সোহেল সানি

রাজনীতিতে কর্মীর নেতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুদীক্ষা, গুরুভক্তি, গুরুপূজা, গুরুবন্দনা অর্থাৎ নেতাভক্তি চিরাচরিত একটা সংস্কৃতি। শিকড় থেকে শিখরে পৌঁছার একটা মহত্তম সিঁড়ি, যা সর্বযুগে, সবদেশে ছিল, আছে এবং থাকবে।

রাজনীতির মতবাদে গুরুজীর "দীক্ষাপাঠগ্রহণ" প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যেই দেদীপ্যমান। শিষ্যত্ব কবুলে নেতার কেউ ডানহস্ত, কেউবা বামহস্ত। এমনকি কেউ চক্ষু-কর্ণ, কেউ বুক-পিঠ আবার কেউবা গুরুজীর 'মানসকন্যা', 'মানসপুত্র' সর্বোপরি গুরুজীর জান-প্রাণ আরও কত কি! 

গুরু মনে ঢুকতে হলে চাই অতিভক্তি। এটা কর্মীর উত্তম এক হাতিয়ার। এর  অপরিসীম মূল্য দেন রাজনীতিক নামের সমাজপতি রাজপতিরা। রাজনৈতিক গুরুরা অবচেতন মনে শিষ্যদের কাছ থেকে এ অন্ধভক্তিই আশা করেন। 'পা' না পেলে গুরুর 'পাদুকা' ছুঁয়ে ভক্তি প্রদর্শন করে শিষ্যরা। যোগ্য শিষ্যত্বেই গুরুর অস্তিত্ব। আদিযুগে শিষ্যদল ব্যবহার করেই  যুদ্ধবিগ্রহ সৃষ্টি করতো গুরুজীরা। এলাকার বিস্তার ঘটিয়ে রাজ্যপতি হয়ে ওঠেন গুরুজীরা। সনাতন যুগে শিষ্যত্বদানের জন্য গুরুরা কোমলমতি বা বিদ্যার্থী কিশোর-তরুণদেরই বেছে নেন। গুরুদের মধ্যে বিভক্তিও আছে। কেউ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে কেউ বেছে নেন, আবার কেউবা ধর্মকেই অস্বীকার করেন। নবীদের যুগে বেধর্মীরা নিজেকেই 'প্রভু' বা আল্লাহ দাবি করেন। ফেরাউন, নমরুদদের মতো শাসকরা ধ্বংস হয়ে যায়। শাসক শাদ্দাদ তো বেহেশত বানিয়ে ফেলেছিল। যাতে প্রবেশ করতে গিয়ে নিজেই ধ্বংস হয়। 

এখনো সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজপতির কল্যাণেই নিজের কল্যাণ খুঁজে। কমিউনিস্ট যুগে গুরুভক্তিতে চরম শপথে দীক্ষিত হতো শিষ্যরা। জীবনের সন্ধানে অন্য সবার মতো আমারও রাজধানীতে ছুটে আসা। এরশাদ জামানায় একদিন মন্ত্রীপাড়া বলে পরিচিত মিন্টো রোডে হাজির হলাম। ঘুরতে ঘুরতে ফুলার রোড, হেয়ার রোড হয়ে বেইলী রোডও দেখা হয়ে গেল। এলাকার অবস্থান থেকে মনে হতে পারে বৃটিশ শাসকের নামে অঙ্কিত রোডগুলোর পাশাপাশি অবস্থান দেখে মনে হলো উনারা চার সহোদর। ইতিহাসে মিন্টো ভারতবর্ষেরই শাসক ছিলেন। আর ফুলার, হেয়ার ও বেইলী ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানে বর্তমান বাংলাদেশের শাসক লে. গভর্নর। ১৯০৫ সালের  বঙ্গভঙ্গে পশ্চিম বঙ্গকে পৃথক প্রদেশ করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' মিলে একটি প্রদেশ হলে এই লে. গভর্নর পদের জন্ম হয়। লর্ড কার্জন, লর্ড মিন্টো ও লর্ড হার্ডিঞ্জ ছিলেন ফুলার, হেয়ার ও বেইলীর প্রভুসম গুরু। অবশ্য বঙ্গভঙ্গ রদে গুরু-শিষ্য ছ'জনেরই বিদায় ঘটে। আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে। ভারত ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের পরামর্শেই লে. গভর্নর বেইলী বঙ্গভঙ্গ রদ করে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে একীভূত করতে প্রস্তাব পাঠান ব্রিটিশ কমন্স সভায়। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লির দরবার হলে বঙ্গভঙ্গ রদ করে বাংলা প্রেসিডেন্সিকে কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদের অধীন করেন। সৃষ্টি হয় গভর্নর পদের। বাংলার প্রথম গভর্নর হিসেবে আসেন লর্ড কারমাইকেল। 

প্রসঙ্গত একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এই মরণঘাতী করোনাকালে আমি একটি রিকশায় করে মিন্টো রোডে এক প্রতিমন্ত্রীর বাস ভবনে ছুটছিলাম সিদ্ধেশ্বরীর গলি হয়ে। আচমকা পেছন থেকে একটা ধাক্কা। রাস্তায় চিত হয়ে পড়ে দেখি, রিকশাটাকে মেরে দিয়েছে একটি মার্সিডিস। সামনে সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দির। চোখে পড়লো বড় জটলা ও অসহনীয় শব্দ ধ্বনি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রী বা পরিবেশ মন্ত্রী এমন পরিস্থিতির শিকার হলে শব্দ দূষণ কারে কয় টের পেতেন? যাহোক রিকশা বিদায় করে দিলাম। মন্দিরটির গায়ে সাঁটানো কিছু পোস্টার চোখ কেড়ে নিল। গুরুভক্তি মানে নেতার প্রতি কর্মীর ভক্তি কাকে বলে পোস্টারের বড় বড় হরফে লেখা বন্দনার বাণীগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এই যুগেও গুরুভক্তির দীক্ষা নিতে হয় শিষ্যদের। 

রাজা-বাদশা, সম্রাট-সম্রাজ্ঞী, সুলতান-যুবরাজ, পোপ-পতি-নৃপতি, নবাব-নায়েব, বড়লাট-ছোটলাট, ভাইসরয়, গভর্নর-জেনারেল এবং উজির-নাজিরদের আমলে যেমন গুরুভক্তি ছিল, তেমনি এখনকার যুগে নেতা-নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীর কাছে দীক্ষিত হতে হয় কর্মীদের। আগের পদপদবী প্রাচীনতার গর্তে ম্লান হয়েছে। পদবিধারীর আলংকারিক চাকচিক্কের পোশাক ও পরিচ্ছদীয় পরিবর্তন এনে সাধারণের কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু শাসকদের কাছে কর্মীদের দীক্ষা নেয়ার হকার্য প্রণালী এক এবং অভিন্ন রয়ে গেছে। প্রাচীন সংস্কৃতির আবহাওয়াকে বলবৎ রেখেই যে দীক্ষা। গণতন্ত্রের যুগেও গোপনীয় শপথ সংস্কৃতি চালু রয়েছে। অবশ্য নেতাও শাসকবনে যান ধর্মীয় গ্রন্থের ওপর হাত রেখে শপথবাক্য পাঠ করে। সেটা নিজেদের রচিত বিধি বিধানের আলোকে। কালি মন্দিরে সাঁটানো পোস্টারের প্রসঙ্গে না ফিরলে এটা তামাদি হয়ে যাবে। 

১৯০৫ সালের  বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় সবচেয়েও সহিংস ঘটনার জন্ম দিয়েছিল দুটি সংগঠন। একটি  "যুগান্তর" অপরটি "অনুশীলন সমিতি"। দুটোই ছিলো সশস্ত্র সংগঠন। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের বিরুদ্ধবাদীদেরকে মেরে ফেলার নীতিগ্রহণ করছিল হিন্দুত্ববাদী এ দুটি চরমপন্থী জঙ্গি সংগঠন। এবং বহু লোককে তারা কতল করেও ছিল। দেশ বিভাগ কালে হিন্দুত্ববাদী উগ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলোর কারণেই "ডাইরেক্ট একশন ডে' কেন্দ্র করে ৫/৬ লাখ হিন্দু-মুসলমানের জীবন চলে যায়। বাংলা হয় দুটুকরো। ধর্মান্ধ শিবসেনা সংঘের নথুরাম গডসের হাতে প্রাণ চলে যায় ভারত পিতা মহাত্মা গান্ধীর। জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা আবু আলা মওদুদীর "মওদুদীবাদ'-এর ভ্রান্ত দীক্ষায় পাকিস্তানে হাজার হাজার প্রাণ চলে যায়। আইয়ুব খানের দয়ায় মওদুদী ফাঁসি বাতিল হয়। একাত্তরে মওদুদীবাদীরা কি করেছে তা সবার জানা। কমিউনিস্টের মধ্যেও জঙ্গীদের তাণ্ডব ছিল। সর্বহারা শ্রেণি, মাওবাদী লেলিনবাদী বলে জাহির করে নিজেদের। বাংলাদেশে থানা ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র লুটপাটের ঘটনা ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। ভ্রান্তনীতিতে ডুবেছে তারা। শত শত প্রাণ চলে গেছে শিষ্যদের। এখন গুরুভক্তিতে ধর্মান্ধ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে। মৃত্যুকে জান্নাতলাভের উপায় মনে করে তারা। হেফাজত মানে প্লাটফর্ম। এতে জড়ো ধর্মান্ধ বহুজঙ্গি গোষ্ঠী। ফাঁসিতে ঝুললেও বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমানদের শিষ্যরাও হেফাজতে।

বাংলাদেশের গত দুই দশকের রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেনকে কেন্দ্র করে। "টু মাইনাস থিউরি" মানে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত রাজনীতির একটি ফর্মুলাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে নেতা বন্দনার চিত্রটি বদলে যায়। মঈনউদ্দীন-ফখরুদ্দিন ফর্মুলা ভেস্তে গেলে দুটি দলেই মেরুকরণ ঘটে। যেসব দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতারা একসময় শিষ্যবনে যেতে আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল জলিলদের পদধূলি নিতেন, সেই তারাও রাতারাতি ভোল পাল্টান। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে ওই সব শীর্ষ নেতারাই আপনাকে বাদ দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হবার পর মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পাওয়া এবং দলীয় কাউন্সিলে শীর্ষ নেতারা প্রেসিডিয়াম শুধু একেবারে ওয়ার্কিং কমিটি হতে বাদ পড়ায় উঠতি নেতারা নিজেদের স্বার্থে শীর্ষনেতাদের বাড়ি-ঘরে যাওয়া রীতিমতো বন্ধ করে দেন। শেখ হাসিনার অন্ধভক্ত রূপে প্রকাশ করেন নিজেদের। এতে ফলও আসে যারা সরকারের বা দলের পদপদবি পাবার স্বপ্নেও ছিলেন না, সেই তারা অনেকেই দলের শীর্ষ পদ অলংকৃত করেন। উপমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হওয়ার চিন্তা করেননি সেই তারা মন্ত্রী হয়ে নিজেরাই আকাশ থেকে পড়েন। শীর্ষ নেতারা অনেকে পরপারে চলে গেছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের কাছেও শিষ্যদের গুরুভক্তি এখন পরিত্যক্ত অতীত। সবই 'নেত্রীকেন্দ্রীক'। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না গেলে এমন চিত্র দেখা যেতো কিনা, সেটা গবেষণার বিষয়। ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েছেন বহু পরীক্ষিত নেতা। বিএনপির নেতৃত্ব দ্বৈতনীতিতে পরিচালিত-অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের (মা-পুত্রের) যৌথ নেতৃত্ব। 

অপরদিকে আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা নির্ভর এককেন্দ্রিক নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-ভাষণ এবং তার আত্মজীবনীতে প্রমাণ মিলে যে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই ভাবশিষ্য ছিলেন। মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলের শিষ্য। আর পাকিস্তানের জনক মুহাম্মদ আলীর গুরু ছিলেন নওরোজী দাদাভাই। এদেশের অনেক বামপন্থী লেলিন, কাল মার্কস, মা-ও সেতুং-কে মনে মনে নিজেদের গুরু মনে করতেন। দেখা যায় নেতারা নেতৃত্বের পরিস্থিতিতে নানা পথ অবলম্বন করে থাকেন। এসব পথগুলো উদারপন্থা, মধ্যপন্থা ও কট্টরপন্থা বলে পরিচিত। 

১৮৮৫ সালে ভারতবর্ষে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল কংগ্রেস গঠনের পর থেকে এসব পন্থা বিভিন্ন রকম পরিণতি বয়ে এনেছে। কংগ্রেস ছেড়ে যেমন জিন্নাহর মতো অনেক মুসলিম লীগ করেন, ঠিক তেমনি মুসলিম লীগ ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, মুজিব আওয়ামী লীগ করেন।  

নেতৃত্বের একটি পথ হলো, সার্বভৌম কর্তৃত্ব করা। সার্বভৌম নেতা একাই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিম্নস্থদের ওপর চাপিয়ে দেন। নিম্নস্থদের মতামত জানতে চান না। এ কারণে যে, নেতা অবচেতন মনে আশঙ্কা করেন, নিম্নস্থ ন্যায্য কথা বলছেন, যা নেতার পক্ষে মানা সম্মানহানিকর। নেতার একাধিপত্য বেশিদিন টিকে না। অল্প সময় দলের কর্মীরা কপট আনুগত্য দেখায়, কিন্তু অচিরেই দলে বিক্ষোভ দেখা দেয়। প্রতিভাবান কর্মীরা কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। আর যারা লোভী তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। ফলে দলে কোন্দল ও দ্বন্দ্বের মুখে স্থবিরতা নেমে আসে। এতে করে সার্বভৌম নেতার কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। যার ফল ভোগ করে কর্মীরা। 

নেতৃত্বের দ্বিতীয় প্রণালীটি হলো, হিমশীতল, যন্ত্রবৎ, নিয়মানুবর্তী কর্মীপন্থা। অথচ, হিমশীতল নিস্পৃহ পদ্ধতিতে কর্মনিপূণতা আনার চেষ্টা যথাযথপন্থা নয়। যে সব 'মেশিন' গুলো শাসক বা নেতার অধীনে কাজ করে তারা নিজেদের সম্পূর্ণ কর্মদক্ষতা প্রয়োগ করে না। এই পথ অবলম্বনকারীরা আক্ষরিক অর্থে পুস্তিকা আলোকে পথ চলেন। প্রতিটি প্রণালী সাধারণ বিষয়গুলোর জন্য পথনির্দেশ মাত্র-এটা তারা বুঝতে চান না। এই নেতারা সাধারণ মানুষকে যন্ত্র মনে করেন। আর মানুষ যে সব জিনিস ঘোর অপছন্দ করে তার মধ্যে একটা হলো যন্ত্রের মতো আচরণ পাওয়া। তৃতীয় পন্থা অবলম্বনকারীরা হলেন, 'মানবিক বোধসম্পন্ন নেতা'-যিনি শ্রেষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পারেন। নেতৃস্থানীয় বলতেই বোঝায় প্রচণ্ড ব্যস্ত নেতা। 

নেতৃস্থানীয়রা কর্মযুদ্ধের মাঝখানে দাঁড়ান। তবে নেতৃস্থানীয়রা কিন্তু বেশ খানিকটা সময় কাটান, যখন তাদের একমাত্র সঙ্গী হয় ভাবনা-চিন্তা। বিভিন্ন ধর্মের মহাপুরুষরা, প্রত্যেকেই বেশ খানিকটাসময় একাকী থাকতেন। এতে নেতার মধ্যেই উদারতার সৃষ্টি হয়, হয়ে ওঠেন মধ্যপন্থী। মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যীশু, বুদ্ধ, কনফিউসিয়াস জীবনের ঘোরপ্যাঁচ থেকে দূরে একা নিজের সঙ্গে নিজে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। তারা একাকীত্বে পেয়েছিলেন চিন্তার স্বাধীনতা, চিন্তার গভীরতা। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট পোলিও আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে ওঠার সময় যদি একা না থাকতেন তাহলে আদৌ নিজের অসাধারণ নেতৃত্বের ক্ষমতা বিকশিত করতে পারতেন কিনা সন্দেহ সে নিয়ে গবেষকদের প্রশ্ন আছে। হ্যারি ট্রুম্যান দীর্ঘসময় মিসোরিতে একাকী কাটিয়েছেন। এডলফ হিটলার বেশকিছু বছর জেলজীবন কাটিয়ে ছিলেন বলেই ক্ষমতার পাহাড় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই জেলে বসেই কুখ্যাত 'মাই ক্যাম্ফ' লেখার সুযোগ পান, যাতে বিশ্বজয়ের কূটকৌশলের উল্লেখ ছিল এবং জার্মানরা যার অন্ধভক্ত হয়ে উঠে ছিল। কিন্তু শেষে কট্টরপন্থাই তাকে ধ্বংস করে। 

কমিউনিজমের কূটনীতিতে সুদক্ষ লেলিন, স্ট্যালিন, মার্কস সবনেতাই জেলে বসে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্বিঘ্নে তৈরি করেন। মহাত্মা গান্ধী একাকীত্বের কারণেই  অহিংসবাদী চিন্তা-ভাবনা নিজেকে গড়ে তুলেন। নেলসন ম্যান্ডেলাও বিকশিত হন জেলবন্দী হয়ে। দীর্ঘ কারাজীবনে বঙ্গবন্ধুও বিকশিত হন। মানবিক পন্থা অনুসরণ করে সুদক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তার সুফলও উপভোগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি নিজের অধীনস্থদের কাজে বেশি উৎসাহ দিয়েছিলেন। যে কারণে তার দৈহিক অনুপস্থিতিতেও মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সমর্থ হন সহচররা। 

সেদিক থেকে যেমনি 'নেতা-শিষ্য' সংস্কৃতি দলের বিকাশে অপরিহার্য। তেমনি নেতৃত্বের বিকল্পও রাজনৈতিক দলে অনস্বীকার্য। তবে অন্ধত্ব ভয়ঙ্কর।  

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন



এই পাতার আরো খবর