ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আমার বাবা জননেতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী স্মরণে
হেলাল উদ্দিন চৌধুরী (তুফান)
জহুর আহম্মদ চৌধুরীকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি (বামে) এবং তৎকালীন ঢাকা পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জহুর আহম্মদ চৌধুরীকে দেখতে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ডানে)

১ জুলাই আমার পিতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরীর ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই ঢাকা পিজি হাসপাতালে ৬৯ বছরে পরলোকগমন করেন।  আমার বয়স যখন ১৪ বছর তখন আমার পিতার মৃত্যু হয়। এ কিশোর বয়সে আমার শিশু ও কৈশোর থেকে কিশোর বয়সে পিতার কর্মকাণ্ডের অনেক স্মৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে আমার ক্ষুদ্র পরিসীমায় লেখার চেষ্টা করছি।  মুুসলিম লীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। সারা জীবন গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। আমার স্মৃতিতে আমি আমার পিতাকে একজন পুত্র হিসেবে খুব একটা কাছে পাইনি। জীবনে উনাকে কখনো পর পর সাত দিন দেখার সুযোগ হয়নি। ষাটের দশকে আমার জন্মের পর উনি ছয় দফা, ১১ দফা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে বার বার কারাবরণ করেছেন। পুত্র হিসেবে, আদর যত্ন পাওয়ার সুযোগ কখনো হয়নি।  সারাজীবন ন্যায় নীতি ও সততার সঙ্গে নিজ পেশা রাজনীতিকে ধারণ করেছেন তিনি। রাজনীতির ব্যাখ্যায় রাজনীতি বলতে যা বুঝায় তিনি সেই আদর্শই ধারণ করতেন। আমার স্মৃতিতে কিছু ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। 

৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্যে ঘোষণা দিলেন- ২৮ তারিখে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করার জন্য। আমার বাবা ঢাকার জনসভা থেকে ফিরে আসার পর আমার মরহুম মাতা বেগম ডা. নুরুন নাহার জহুর, আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন- বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, কিন্তু ২৮ তারিখে যে সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? সারা দেশতো এখন অচল! আমার মা তৎকালীন সরকারি চাকরিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা দফতর চট্টগ্রামের মেডিকেল অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। আমার মায়ের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুকে ফোন দিলেন। তিনি চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালককে ডেকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। এবং প্রত্যেক সরকারি অফিসে বেতন পাঠানোর জন্য শহর আওয়ামী লীগের সভাপতির সিল ও স্বাক্ষরসংবলিত একটি কাগজ বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রামে পাঠিয়ে বেতন প্রদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এবং বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম আমার পিতা জহুর আহম্মদ চৌধুরীর আদেশ অনুযায়ী বেতনের টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর সারা বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালিত হয়।  ৭০ সালের নির্বাচনের পর সারা দেশে তুমুল আন্দোলনে উত্তপ্ত চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশ। শহর আওয়ামী লীগের প্রতিদিনের কর্মসূচি পালনের জন্য তৎকালীন কিছু অবাঙালি ব্যবসায়ী আমার বাবার কাছে অর্থ সাহায্য দিতে আমাদের দামপাড়া বাসায় আসে। আমার বাবা ওইসব ব্যবসায়ীকে রাস্তায় বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন। বাসায় দলীয় কর্মীদের সঙ্গে কাজ শেষ করে বাইরে গিয়ে ওই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা করেন। সবাই চট্টগ্রাম শহরের জুবলি রোডের অবাঙালি বোররা কমিউনিটির ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী নেতা। এখনো ওইসব ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জুবলি রোডে চালু আছে। উনারা বাবার হাতে আন্দোলনের জন্য অর্থ সহযোগিতা করেন এবং আন্দোলনে উনাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। পরে ওইসব ব্যবসায়ী চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের এক কর্মী আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, উনাদের বাসার ভিতরে ডাকা হয়নি কেন! চা খাওয়ানো হয়নি কেন!? আমার বাবা জবাবে বলেন, ‘যার কাজ যেটা, তাকে মানায় সে কাজে’ অর্থাৎ আমি রাজনীতিবিদ উনারা ব্যবসায়ী আমার সঙ্গে উনাদের সম্পর্ক সীমিত, আমি ব্যবসায়ী না। ব্যবসায়ীরা বিচার বিবেচনা করে আমাদের আন্দোলন সফল করার জন্য অর্থ সাহায্য দিচ্ছে, আমরা সাফল্য অর্জন করলে দেশ পরিচালনায় ব্যবসায়ীদের সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সাহায্য সহযোগিতা করব, এর বেশি নয়। যত বড় ব্যবসায়ী হোক সে যেই হোক যত অর্থ সাহায্য করুক তাকে তার অবস্থান থেকে করতে হবে। কোনো ব্যক্তিস্বার্থ অর্জন বা দলের পদে শেয়ার দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। আমি নেতা হিসেবে চট্টগ্রামে সব ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিকে তাদের অসুবিধা বা কষ্টের সময় সাহায্য করে যাচ্ছি। এবং ভবিষ্যতে এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য করে যাব। তবে ব্যবসায়ী ব্যবসা করবে রাজনীতিবিদ রাজনীতি করবে। রাজনীতিতে বা দলে অর্থের বিনিময়ে কোনো পদ বা ছাড় নয়, এ ধরনের মনোভাব ও আদর্শ নিয়ে আমার বাবা এদেশে রাজনীতি করেছেন। আমি বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ বা আদর্শ নিয়ে সমালোচনা করব না, কিন্তু আশা করব বাংলাদেশে আগামীতে রাজনীতিবিদদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। ৬০-এর দশকে ছয় দফা, ১১ দফা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম শহরে আওয়ামী লীগের সব কর্মসূচি, জনসভা এবং মিটিং মিছিলের সাফল্যের জন্য নেপথ্যে চট্টগ্রামের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও কিছু অবাঙালি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির আর্থিক সহযোগিতা এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।  বাঙালি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির মধ্যে অন্যতম মরহুম ইউসুফ মিয়া (বুলবুল ইউসুফ) মরাদের বাবা ইউসুফ টেক্সটাইলের মালিক এবং আগ্রাবাদের মরহুম সোলতান আহম্মদ (সোলতান মিয়া/কালা সোলতান) এ দুই ব্যবসায়ী বঙ্গবন্ধু এবং আমার বাবার খুবই কাছের লোক ছিলেন। দেশ বিভাগের আগে থেকেই মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুুসারী এ ব্যবসায়ীগণ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সঙ্গে সারা জীবন ছায়ার মতো সহযোগিতা করে গেছেন কোনো পদ বা পদবি ধারণ না করে।  ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে আমার বাবাকে একটি পত্র লেখেন, উনার বড় মেয়ে আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিতে। আমার বাবা পত্র পাওয়ার পর চট্টগ্রামের শ্রদ্ধেয় জননেতা মরহুম এম এ আজিজ, ইউসুফ মিয়া এবং সোলতান মিয়া আলোচনায় বসেন আমাদের দামপাড়া বাড়িতে। বিয়ের সব ব্যবস্থা ও আয়োজন করা হলে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেসা চট্টগ্রাম আসেন। তিনি আমার বাবা এবং মরহুম এম এ আজিজকে অনুরোধ করেন সাদামাটা বিয়ের আয়োজন করে জননেত্রী শেখ হাসিনার বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য। জবাবে আমার বাবা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য অনুযায়ী বিয়ের আয়োজন করা হবে বলে অবহিত করেন এবং ১৯৬৮ সালে শ্রদ্ধেয় মরহুম ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রাম শহরের তৎকালীন ‘রাইফেল ক্লাব’ (শহীদ মিনারের পাশে) বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজারখানেক মেহমানের ব্যবস্থা করা হয়। এবং চট্টগ্রাম শহরের শাহাজান হোটেলে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যরা রাত যাপন করেন। চট্টগ্রামের প্রথা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী জননেত্রী শেখ হাসিনা মরহুম ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ে ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম শহরে অনুষ্ঠিত হয়।  ষাটের দশকে ছয় দফা, ১১ দফা আন্দোলনে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচি হরতাল, মিছিলের সাফল্য অর্জনের জন্য নেপথ্যে তৎকালীন কিছু অবাঙালি ব্যবসায়ী সব সময় আর্থিক সহযোগিতা করতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মরহুম বশির আহম্মদ, রমনা সিগারেট কোং এবং মরহুম এইচ আকবর আলী (বিএসআরএম) এর মালিক। রমনা সিগারেট কোং-এর অফিস ছিল টেরি বাজার গলি, নিজাম নামে একজন ম্যানেজার ছিলেন। আমার বাবা মিটিং-মিছিলের খরচের জন্য একটি ছোট কাগজে লিখে পাঠাতেন। আর ওনি মিটিংয়ের হল ভাড়া, খাওয়া, মাইকের বিল, ডেকোরেটর বিল পরিশোধ করতেন। লালদীঘি মাঠের জনসভার খরচ চালাতে আজিজ উদ্দিন লিমিটেড অর্থাৎ রমনা সিগারেট কোং-কে বুঝাতো। পাশাপাশি এইচ আকবর আলী দলের প্রয়োজনে সবসময় আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। আমি এ কথাগুলো প্রকাশ করছি এ জন্য যে তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাংলাদেশ স্বাধীন তথা ছয় দফা ১১ দফা অসহযোগ আন্দোলনে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা আর্থিক সহযোগিতা করতেন। তবে বিনিময়ে পাওয়া বা নিজ স্বার্থে পদ-পদবির লোভে নয়। এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশে কোনো ব্যবসায়ী কখনো পদ-পদবি পাওয়ার বা লাভবান হওয়ার জন্য সাহস করত না।  ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ট্রাকে করে নগদ অর্থ আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। উক্ত অর্থ আগরতলায় আমার বাবার বিএলএফের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কার্যালয়টি ছিল বাসা। আমি এবং আমার ভাই মরহুম কামরুদ্দিনকে ৭১-এর জুলাই মাসে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ অফিসের পিয়ন মরহুম নুরুল হক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যায়। আমি রাতে ঘুমাতে গেলে দেখি বিছানাটা খুব শক্ত, ঘুমানো খুব অসম্ভব হয়ে গেল। সকালে আমি আমার বাবার পিএস আহাদকে জানালাম রাতে বিছানা শক্ত ও খসখস আওয়াজ হওয়ায় ঘুমাতে পারিনি। তখন উনি আমাকে বিছানার চাদর সরিয়ে যা দেখালেন তা অবিশ্বাস্য। পুরো বিছানাটি টাকা দিয়ে তৈরি এবং ওপরে পুরনো পেপার দ্বারা প্যাকেট করা। এ ধরনের চারটি বিছানা, সব টাকা আর টাকা, এ টাকা তৎকালীন ভারত সরকারের সহযোগিতায় কুয়েত থেকে বিনিময় করে বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিচালনায় খরচ করা হয়। একজন নির্লোভ, ন্যায় ও আদর্শবান রাজনীতিবিদের সন্তান হয়ে গর্বে আমার বুক ভরে যায়।  ১৯৭২ সালে আমি তখন ঢাকায় এয়ারফোর্সের শাহীন স্কুলের ছাত্র, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমরা নিয়মিত স্কুলে আসা-যাওয়া করার জন্য বাবার পিএস জোহার গাড়িটি ব্যবহার করতাম। বাবা উনার সরকারি (Brand New Mercedes) গাড়িটি ব্যবহার করতে দিতেন না। যাই হোক একদিন জোহার গাড়িটি না আসায় আমরা সব ভাইবোন মিলে বাবার গাড়িটি নিয়ে স্কুলের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। আমরা বাংলামোটর বরাবর আসতেই পেছন থেকে পুলিশের গাড়ির বাঁশি এবং তারা আমাদের থামার ইশারা দিচ্ছেন। পরে দেখলাম আমার বাবার নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ দল আমাদের পিছু নিয়েছে। ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে পুলিশের কাছে কারণ জানতে চাইলে পুলিশ বলে মন্ত্রীর গাড়ি দিয়ে স্কুল ডিউটি কেন? মন্ত্রী মহোদয় এখনই গাড়ি বাসায় নিয়ে যেতে আদেশ দিয়েছেন। আমরা সব ভাইবোন একথা শুনে একদিকে লজ্জা এবং অন্যদিকে ক্ষোভে মাথা নিচু করে গাড়ি থেকে সবাই নেমে হেঁটে স্কুলে গেলাম। রাতে খাওয়ার সময় বাবাকে আমাদের ক্ষোভের কথা জানালে উনি অতি সহজভাবে জবাব দিলেন- এটা তোমার বাবার গাড়ি নয়, সরকারি মন্ত্রীর গাড়ি, শুধু মন্ত্রীর ব্যবহারের জন্য, তোমাদের জন্য নয়। তখন আমরা প্রতিবাদ করে বললাম, আমরা কাল থেকে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাব। যদিও স্কুলের দূরত্ব প্রায় চার মাইল। যাই হোক মায়ের মধ্যস্থতায় আমরা আমাদের ক্ষোভ প্রত্যাহার করলাম এবং আগের মতো পিএস বা দফতরের গাড়ি নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতাম।  মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের দামপাড়ার বাসা সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের নিজ বাড়িতে থাকার কোনো ঘর ছিল না। আমরা চট্টগ্রামের থাকার জন্য বাড়িটি মেরামত বা নতুন বাড়ি তৈরি কোনোটিই পারব না। আমার মা উনার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে আমাদের টিনের ঘর মেরামত করে থাকার ব্যবস্থা করেন।  ১৯৭৩ সালের ঘটনা। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের কিছু ব্যবসায়ী একদিন একটি গাড়ি (Brand New Mercedes, ১৯৭০ মডেলের) আমার বাবাকে উপহারস্বরূপ দেন ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। গাড়িটি গ্যারেজে দীর্ঘদিন পড়ে ছিল। আমরা ড্রাইভার কোরবান আলীকে অনুরোধ করে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে নতুন গাড়ির গন্ধ শুঁকতাম আর গিয়ার, স্টিয়ারিং নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম, এতে খুব আনন্দ পেতাম। যাই হোক একদিন আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর মহিলা সমিতির মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য বের হলে বাসায় কোনো গাড়ি না থাকায় উনি একটি ট্যাক্সি ডেকে আনতে বলেন কোরবান আলীকে; কিন্তু ট্যাক্সি ডাকতে গেলে মার দেরি হতে পারে তাই সে গ্যারেজ থেকে (Brand New Mercedes Benz) গাড়িটি বের করে বেইলি রোডে মহিলা সমিতি অফিসে নামিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি নতুন গাড়িতে ওঠার লোভ সামলাতে না পেরে গাড়িতে ওঠে গেলাম। তখন সময় বিকাল ৫টা।  আমরা বের হওয়ার সময় আমার বাবা অফিস থেকে ঘরে ফিরছিলেন; উনার গাড়ি গেটে প্রবেশ করার ঠিক আগ মুহূর্তে আমরা নতুন গাড়ি নিয়ে বের হলাম। আমাদের গাড়ি মিন্টো রোড পার হওয়ার আগেই পিএসের গাড়ি দ্রুতগতিতে এসে আমাদের থামালেন এবং বললেন এখনই গাড়ি বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মন্ত্রী মহোদয় আদেশ করেছেন। আমার মা অনেক রাগী মহিলা। উনি মহিলা সমিতির অফিসে পৌঁছে গাড়ি পাঠিয়ে দেন। বাসায় গাড়ি আসার আগে বাবা ঢাকার ডিসিকে ডেকে এনে হুকুম দিলেন উপহারস্বরূপ পাওয়া গাড়িটি ডিসি পুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওই রাতেই গাড়িটির বিদায়।  পরদিন সকালে দেখলাম নীল রঙের গাড়িটি অন্য একজন মন্ত্রীকে নিয়ে মিন্টো রোডের মন্ত্রীপাড়া থেকে বের হচ্ছে। আমরা রাতে বাবাকে সবাই অবহিত করলাম, জনৈক মন্ত্রীকে গাড়িটি ব্যবহার করতে আমরা দেখেছি। আপনি ব্যবহার করলে ক্ষতি কী? উনি জবাব দিলেন আমার সামর্থ্য নেই এ গাড়ি চালানোর, তাই সরকারের পুলে দান করে দিয়েছি। সরকার যাকে খুশি তাকে ব্যবহার করতে দিতে পারে।  আসলে অবাক লাগে, বিশ্বাস হয় না। বর্তমান যুগের মন্ত্রী-এমপিদের অবস্থা দেখে অনেক সময় দুঃখ হয়। আমার বাবার কবরটি দামপাড়ায় আমাদের বাড়ির সামনে একজন আউলিয়ার সমাধির পাশে। কবরস্থানটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের একোয়ার করা জায়গায় অবস্থিত। আমার বাবা ১৯৪০ সালে দামপাড়ায় বসবাস করার পর থেকে মাজারটি সংরক্ষণ করতেন। বিভিন্ন শাক-সবজির চাষ করতেন। জায়গাটি আমার বড় আম্মার বাবার সম্পত্তি, পরবর্তীতে একোয়ার করা হয়। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় উনি মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও ওই জায়গা নিজের বা পরিবারের জন্য লিজ, বন্দোবস্ত বা দখল করার কোনো চেষ্টা করেননি। কত নির্লোভ, নিঃস্বার্থ বাবা আমার। অথচ ওই জায়গা উনি সারাজীবন ব্যবহার করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য এবং তিন বাহিনীর প্রধানসহ আমার বাবাকে ওই জায়গায় সমাহিত করেন।  আমার বাবা মারা যাওয়ার দীর্ঘ ৪৬ বছর পার হওয়ার পর আমি নিজ চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সহায়তায় মাজারটি সংরক্ষণ, সংস্কার এবং সীমানা প্রাচীর তৈরি করার অনুমতি লাভ করি।  স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভায় উনি স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।  মন্ত্রী হওয়ার পর উনি প্রথম দিন আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুরকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন। আমার মা উনার মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি করলে প্রভাব খাটানোর সম্ভাবনা থাকবে তাই মাকে দীর্ঘ ১২ বছরের সরকারি চাকরি হারাতে হয়।  ছেলে হিসেবে আমি খুব উপভোগ করেছি আমার বাবার ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনকে। কোরবানির সময় তিনটি গরু কিনতেন এবং চারটি ছাগল ও ভেড়া জবাই করে কোরবানি দিতেন। এতে আমরা আনন্দিত হতাম। রোজার মাসে একা কখনো ইফতার করতেন না। আছরের নামাজের পর থেকে আয়োজন শুরু করতেন, অন্তত ৩০/৫০ জন মেহমান নিয়ে নিয়মিত ইফতার করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে উনি খুবই ধর্মপ্রাণ ছিলেন। উনি রাতে অল্প সময় ঘুমাতেন। শেষ রাতে ঘুম থেকে ওঠে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। ফজরের নামাজ পড়ে নিয়মিত দরুদ শরিফ পাঠ করতেন এবং ভোরে মুড়ি ছিটাতেন কাকের খাবারের জন্য। তিনি রোজা পালন করতেন। বেরোজাদারকে ঘৃণা করতেন। ঈদের আগে চট্টগ্রামের প্রত্যেক এলাকার মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জেমদের জন্য লুঙ্গি, পাঞ্জাবি পাঠাতেন।  ব্যক্তিগত জীবনে উনি এত সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন যে, কেউ নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। উনি জীবনে কখনো হাতঘড়ি ব্যবহার করতেন না। জুতা না পরে স্যান্ডেল পরতেন। সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি ও বার্মিজ স্যান্ডেল নিয়মিত পরতেন। বাসায় এবং অবসরে নীল রঙের এক রঙা লুঙ্গি এবং সাদা হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরতেন।  আমি ১৯৭৯ সালে সরকারি বাণিজ্য কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর আমার মা আমাকে বেশ কিছু বই দিলেন। বইগুলো ছিল সম্পূর্ণ ইংরেজিতে Business Management, Industrial Management এবং আধুনিক বাণিজ্য ও শিল্প ব্যবস্থাপনার ওপর আমেরিকান বই। আমি খুবই আশ্চর্য ও বিস্মিত হয়েছিলাম। রাজনৈতিক নেতা হতে হলে শুধু রাজনীতির বই নয়, পৃথিবীর সব বিষয়ের বই পড়তে হয়। আমার বাবার সংগৃহীত বইগুলো ছিল অনেক উঁচুমানের। উনি ভালো ইংরেজি পড়তে ও বলতে পারতেন। অথচ উনি ছিলেন আন্ডার ম্যাট্রিক; মন্ত্রী হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকতার কারণে খুব সামান্য সময় স্যুট এবং জুতা ব্যবহার করতেন। তাও বিদেশে মিটিংয়ের সময়। বিলাসিতা ছিল ডানহিল সিগারেট পান করতেন। পাকিস্তান টোব্যাকো কোম্পানি নিয়মিত সিগারেট পাঠাত। এটাই উনার বিলাসিতা ছিল।  মদ্যপায়ীদের ঘৃণা করতেন এবং শরাবি বলে বকা দিতেও শুনেছি। বাবার সবচেয়ে বড় নেশা ছিল বই পড়া এবং কারও কাছ থেকে ইতিহাস ও গল্প-পুঁথি শোনা। রাত জেগে বই পড়তেন। বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করার পর চারটি মন্ত্রণালয়-স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে উনি যোগ্যতা, মেধা ও সততার সঙ্গে শুধু দেশের জনগণের অর্পিত দায়িত্ব নিয়ে সর্বদা সজাগ থাকতেন। এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করার কথা ভাবতেন। আমার দেখা ও জানা সে সময়ের কিছু ঘটনা এখনো আমার মনে নাড়া দেয়।  স্বাধীনতা-উত্তর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর সদস্য বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বেশ কিছু উল্লেখ্যযোগ্য পদক্ষেপ নেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখ লাখ শিশু ও নারী মানবেতর জীবনযাপন করছিল। যুদ্ধে পিতৃমাতৃহারা লাখ লাখ এতিম ছেলেমেয়েকে এতিমখানায় থাকা-খাওয়া, লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য, উনি চট্টগ্রাম লালখান বাজারের ইস্পাহানি বিল্ডিং, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে তিনটি বাড়ি, মুরাদপুরে বিশাল কয়েকটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং উনি সশরীরে এতিমখানাগুলো পরিদর্শন করতেন। সমাজকল্যাণ দফতরের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক, চট্টগ্রামের মেয়ে জওশন আরা রহমানের প্রজেক্টগুলো পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত এবং পিতা, স্বামীহারা বিধবা, এতিম, নির্যাতিত নারীদের পুনর্গঠনের জন্য নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। এ প্রকল্পের আওতায় সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় নারী পুনর্বাসন প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। মহিলাদের সেলাই শিক্ষা, কুটির শিল্প তৈরির শিক্ষা এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র কর্তৃক উৎপাদিত পণ্য বিপণনের ব্যবস্থা নেন।  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় উনি বাংলাদেশে বৃহৎ দুইটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালটি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানিদের শাহবাগ হোটেল। এ শাহবাগ হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে উনি বাসা থেকে যাওয়ার সময় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। শাহবাগ হোটেলকে হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা ও স্বপ্ন দেখেন। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামকে দায়িত্ব দিয়ে তৎকালীন পিজি হাসপাতাল (Post Graduate Hospital) প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদন নিয়ে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করার সময় বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি উক্ত শাহবাগ হোটেলটি সরকার থেকে লিজ নিয়ে হোটেল ব্যবসা চালুর চেষ্টা করেন কিন্তু আমার বাবা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী কঠোরভাবে অবস্থান নিয়ে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল নামে পরিচিত।  চট্টগ্রামে ফয়স লেকস্থ চক্ষু হাসপাতাল তাঁরই অবদান। জার্মান সরকার থেকে একটি চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এলে তিনি ফয়স লেকে রেলওয়ে থেকে জমি বরাদ্দ নিয়ে জার্মান সরকারের সহায়তায় বর্তমান চক্ষু হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতিও প্রতিষ্ঠা করেন।  জীবনে কখনো তিনি আদর্শ ও দায়িত্বের কাছে পরাজিত হননি। ওই হাসপাতালেই তিনি ১ জুলাই ১৯৭৪ সোমবার ভোর ৬টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।  শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশে শ্রম আইন সংস্কারের কাজ শুরু করেন। জাতীয় সংসদে শ্রম আইনের সংস্কারে প্রথম বিল উত্থাপন করেন। এতে দেশের শিল্প উন্নয়নের জন্য মালিক-শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ দেশের শ্রমিক সমাজের স্বার্থ এবং বাংলাদেশের শিল্পে দ্রুত অগ্রগতির লক্ষ্যে উনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর উনি শ্রম দফতরে সরকারি কর্মকর্তাদের এক সভা আহ্বান করেন। সভায় এমন একজন উপ-পরিচালক উপস্থিত ছিলেন যিনি পাকিস্তান আমলে আমার বাবার বিরুদ্ধে শ্রম আইনে বিভিন্ন সময় মামলা দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে কিছু মামলার কারণে তিনি কারাবরণও করেন। ভদ্রলোক পেছনের সারিতে বসা ছিলেন। আমার বাবা উনাকে ডেকে সামনের সারিতে বসতে বললেন এবং সভা চলাকালীন উনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি সরকারি কর্মকর্তা, আপনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এখন আপনি বাংলাদেশ সরকারের অধীনে সরকারি কর্মকর্তা, তাই এ সরকারের হুকুম মেনে কাজ করবেন। তখন ভদ্রলোকের ভয় ও জড়তা কেটে যায় এবং পরবর্তী সময়ে উনি আমার বাবার একজন প্রিয় কর্মকর্তায় পরিণত হন এবং পদোন্নতি লাভ করে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করেন। 

 



এই পাতার আরো খবর