ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

স্বপ্নের পদ্মা সেতু, যাত্রা যখন শুরু
ড. কাজী এরতেজা হাসান
ড. কাজী এরতেজা হাসান

আজকের এই লেখার শুরুতেই দক্ষিণাঞ্চলের একজন নাগরিক হিসাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা এবং দৃঢ় নেতৃত্বের কারণেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। মাত্র ৬ শতাংশ কাজ বাকি। তবে এই স্বপ্ন পূরণের পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না, কণ্টকার্কীণ পথ পাড়ি দিয়েই আজ বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। আজ থেকে ঠিক ২০ বছর আগে এই দিনেই ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। 

আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ১৯৯৮-৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রিফিজিবিলিটি সম্পন্ন করে। ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করে। ২০১১ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে। এসময় শুরু হয় ষড়যন্ত্রের খেলা। বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি জাইকা, এডিবিসহ দাতাসংস্থাগুলোও সরে দাঁড়ায়। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সচিবসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ মন্ত্রীসহ কারোর বিরুদ্ধেই কোনও অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। পরে কানাডার এক আদালতে মামলা করা হয়। বিশ্বব্যাংক সেখানেও কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ইমেজকে কলঙ্কিত করা হয়। বিএনপিসহ দেশের সুশীল সমাজ সরকারের সমালোচনায় মেতে ওঠে। ২০১২ সালে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির জন্য বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ায়। বিএনপির নেতারাসহ অনেক বিশিষ্ট (!) ব্যক্তিবর্গ সরকারের সমালোচনা করে। মনে হয় সরকারকে অপরাধী প্রমাণ করতে পারলেই তাদের লাভ। আসল কথা হলো, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৫ বছরে পদ্মা সেতুর কাজ এক ইঞ্চিও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। সে সময় দুর্নীতির অভিযোগে যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতের ৬টি প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থ প্রত্যাহার করে নেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই বিশ্বব্যাংক আবার বাংলাদেশে অর্থায়ন শুরু করে।

নানা অভিযোগ ষড়যন্ত্র চাপ উপেক্ষা করে ২০১২-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। জুলাই মাসেও প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মা সেতু। তিনি এও বলেন, কোনও দুর্নীতি করা হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সেকথা কেউ কানে তুলেনি। বারবার দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার পরও বিদেশি কিছু এজেন্ট ও বিএনপি মানুষকে ভুল বোঝাতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগের সামনে মাথা নত করবে না বাংলাদেশ।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, শান্তিতে (!) নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা দিতে বাধা দেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুতে টাকা দিতে বিশ্বব্যাংক সব সময় রাজি ছিল। ইউনূসের কারণে সেটি হয়নি। বিশ্বব্যাংক যেন টাকা না দেয়, সেজন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে সংস্থাটিকে চাপ দিয়েছিলেন।’ বহির্বিশ্বে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অনবরত অভিযোগ করে যাওয়ায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খুবই অবাক হই এই ভেবে, একজন নোবেলজয়ী কী করে নিজের দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন।

কানাডার আদালত বলেছেন, এক নম্বর তথ্যদাতা পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে তথ্য দিয়েছেন তা মূলত ‘গুজবের’ ওপর ভিত্তি করে। একটি দলিলের উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত বলেছেন, ওই দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাছাই করা ৫টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতির গুজবের কথা আমরা শুনেছি।’ শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিকল্প অর্থায়নে বর্তমান সরকারের সময়েই পদ্মা সেতু হবে।

২০১০ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে অন্য দাতারাও সেটি অনুসরণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন পদ্মা সেতু প্রস্তুতিপর্বে কোনো দুর্নীতি হয়নি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নিজ অর্থে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি কানাডার আদালতে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত পরবর্তী সময়ে মামলাটি বাতিল করে দেন; কিন্তু তার আগেই শেখ হাসিনা সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যান। বৈদেশিক সাহায্য না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ হাতে নেন। অবশেষে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। 

শেষ মুহূর্তে এসেও নানা ষড়যন্ত্র পদ্মা সেতুর কাজে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা সামনে এসেছিল। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা লাগবে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অপহরণকারী ধারণা করে অনেক মানসিক ভারসাম্যহীনকে মারধরের পর পুলিশে হস্তান্তর করার ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনা গুজব ও ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। আজ সেই বহুমুখী চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রাক্কালেই পদ্মা সেতু দৃশ্যমান-ভাবতেই গর্ব হচ্ছে। 

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে কেন্দ্রের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি করবে। এই সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে তিন কোটিরও বেশি জনগণ উপকৃত হবে। ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটিতে ভবিষ্যতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। সেতুটি চালু হলে দেশের মোট জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। সেতুটি তৈরি করছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন চায়না মেজর ব্রিজ কম্পানি। এতে ব্যয় করা হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

এই পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের প্রতিধাপেই দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে লড়াই চালিয়ে যাওয়া কয়েকজন মানুষের অবদানের কথা বলতেই হবে। সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের লড়াইটা ছিল সততার। 

তিনি বারবার দাবি করেছেন, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি। তারপরও দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগে প্রথমে আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেয়া হয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে। পরে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। পদ হারানোর পর তাকে সহ্য করতে হয় জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সমালোচনা। এছাড়া আমি আরও দুইজন ব্যক্তির লড়াইয়ের কথা খুব সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে তৎকালীন দুদকের কমিশনার এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চুপপু বিশ্বব্যাংকের আনিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সরকারের পক্ষে প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে তিনি লড়াইয়ে বাংলাদেশের ইমেজ পুনরুদ্ধারে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। 

বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা মামলায় সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছেন সাবেক সেতু বিভাগের সচিব যিনি বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন সেই মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে কারাবরণও করতে হয়েছিল। সামাজিকভাবে তাকে হেয় হতে হয়েছিল। আজকের এই দিনে বিশ্ব মোড়লদের রক্তচুক্ষুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোদ্ধা হিসাবে এইসব মহান ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।  

আজ বিশ্ববাসী জেনেছে বাংলাদেশের সক্ষমতা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ও জীবনমানের বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বারবার প্রমাণিত হয়েছে-বাংলাদেশ কখনো মাথা নত করে না। বীরদর্পে সামনে এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতুর অবকাঠামোগত চূড়ান্ত বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের বুকে আরেকবার অনন্য অবস্থান পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের স্বার্থেই আমাদের সকলের উচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করা, তার সহযোদ্ধা হিসাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করতে হবে। আজকের এই নিয়ে এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। 

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম পরিচালক, এফবিসিসিআই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত



এই পাতার আরো খবর