ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

সাধারণ মানুষটা তার পৃথিবীর রাজা সে নিজেই হয়
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী :
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী (ফাইল ছবি)

একজন সাধারণ মানুষের কথা ভাবছি। খুব সাধারণ মানুষ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খেটে খাওয়া মানুষ। জীবন যাকে পাগলা ঘোড়ার মতো তাড়িয়ে বেড়ায়। জীবন থেকে পালাবার পথ খুঁজে প্রতিদিন। অথচ জীবনের বাস্তবতা যখন সামনে এসে দাঁড়ায় তখন পালাবার কোনো গোপন দুয়ার সে খুঁজে পায় না। খুব অসহায় হয় সাধারণ মানুষটা তখন। সে  কাঁদতেও পারে না, হাসতেও পারে না। থামতেও পারে না, চলতেও পারে না। 

রেল লাইনের মতো সমান্তরাল সে জীবন। যা জীবনের পথে পা বাড়িয়েও আবার জীবনকে বিপরীত স্রোতের দিকে টানে। যেখানে প্রশ্ন আছে অনেক, তার কোনো উত্তর নেই। যেখানে যাত্রাপথ আছে অগণিত, তার গন্তব্যের কোনো ঠিকানা নেই। জীবনে স্বপ্ন আছে অনেক তবে সেসব স্বপ্নের কাছাকাছি কোনোদিন পৌঁছানো যাবে কিনা সে মানুষটা তা জানে না। তারপরও কঠিন জীবনের বোঝা মাথায় নিয়ে মানুষটা স্বপ্ন দেখতে জানে, কারণ স্বপ্ন দেখতে তো আর টাকা পয়সা লাগে না, রাজনীতির শক্তি লাগে না, ধনসম্পদ লাগে না।

তার সাধারণ পৃথিবীর রাজা সে নিজেই হয়। তার পরিবারের ঘানি টানা বউটা হয় তার রানী। আর তার কাঁদামাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া ছেলে-মেয়েরা হয় রাজপুত্র-রাজকন্যা। আমি ইতিহাসের কোনো বড় বড় রাজাদের কথা বলছি না, সাধারণ মানুষ ক্রমে ক্রমে তার নিজের পৃথিবীতে কিভাবে রাজা হয়ে উঠে সে কথাই বলছি।  

আপাতদৃষ্টিতে আমরা যাদের এমন সাধারণ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করি, তাদের জীবনেও ঘটে অনেক অসাধারণ ঘটনা। যা তারা হয়তো কখনো ভাবেনি, ভাবতেও পারেনি। আবার অনেক সময় সাধারণ মানুষরা অসাধারণ অনেক কিছু ঘটিয়ে থাকে, তারা যে এমনটা করতে পারে তা কখনো তাদের মাথাতেও হয়তো আসেনি। তারপরও সে অঘটন ঘটানোর  মতো ঘটনার জন্ম দেয় তারা। খুব অদ্ভুত জীবনের কিছু কিছু সমীকরণ হয়। যা অনেক রহস্যের জন্ম দিয়েও তা উন্মোচন করতে পারে না। অনেক জল্পনাকল্পনার সৃষ্টি করেও তার রহস্যভেদ করতে পারে না। 

সাধারণ মানুষদের জীবনে অনেক চাওয়া না পাওয়ার টানাপোড়েন থাকে, সে টানাপোড়েনে একটা আনন্দের পৃথিবীও থাকে। কারণ অপূর্ণতার মধ্যেই পূর্ণতার স্বাদ থাকে, গন্ধ থাকে, রস থাকে, যা পূর্ণতার মধ্যে থাকে না। সেটা বোঝার মতো শক্তি খুব বেশি মানুষের মধ্যে থাকে না তবে যার জীবনে এমনটা ঘটে সে সাধারণ মানুষটা সেটা বুঝে। সে সাধারণ মানুষটার অনেক টাকা পয়সা থাকে না, বড় বড় পদধারী ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ বা তাদের মতো বিত্ত বৈভবে ঠাসা মানুষদের মতো তার ক্ষমতাও থাকে না। দামিদামি প্রাচুর্যের মায়াজালও তার থাকে না, মায়াবী পৃথিবীর হাতছানিও তার জীবনে বসন্ত হয়ে ধরা দেয় না। বরং সারাজীবন তার অভাব লেগেই থাকে। 

এই অভাববোধ থাকে বলেই সাধারণ মানুষটা তার জীবনকে নিজের মতো করে সাজাতে পারে। সেটা খুব ছোট হয়, খুব নগন্য হয়, অনেকের কাছে অবহেলার বস্তু হয়। অথচ সে মানুষটার কাছে সেটা একটা স্বর্গ হয়, স্বস্তির জায়গা হয়, গৌরবের বস্তু হয়। এই অভাববোধ তাকে শেখায় জীবনকে কিভাবে ছোট ছোট অনুভূতির পরশ পাথরে ঘষে ঘষে সুখের সন্ধান করতে হয়। সুখ কেনা যায় না, সুখ তৈরি করাও যায় না, সুখকে মনে প্রাণে ধারণ করতে হয়। সাধারণ মানুষদের না চাইলেও সেই সুখকে ধারণ করার মন্ত্রটা জানতে হয়।

কারণ অভাব কখনো দরিদ্র  হয় না বরং দারিদ্র্যকে মহান করেই অভাব মর্যাদাবান হয়ে উঠে। তার বিন্দু বিন্দু জলকণা যখন সাধারণ মানুষটার গায়ে পড়ে আলো হয়ে উঠে তখন সে মানুষটাই বদলে যায়। পৃথিবীতে অভাবী মানুষরা যতটা সুখী হয়, ধনী মানুষেরা ততটাই অসুখী হয়। সুখ সাধারণ মানুষের ঘরে বাস করে, ধনীদের ঘর থেকে বের হয়ে যায়  । কথাটা সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তার প্রমাণ পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনা। সমাজের প্রতিদিনের চালচিত্রের ছবি। গবেষণার ফলাফল। 

আমি একজন সাধারণ মানুষের কথা বলছি। যার পায়ের নিচে আছে শক্ত মাটি, মাথার উপরে আছে আকাশ। সে আকাশটা মানুষটার কাছে ছাতার মতো। যে ছাতার নিচে নিজের দেহটা কোনোমতে গুঁজে মানুষটা নিজেকে যতটা ছোট করে ভাবতে শিখে, মানুষটা তত বড় হয়ে উঠে। সাধারণ মানুষের সে বড়ত্বের কাছে অসাধারণ মানুষদেরও হার মানতে হয়।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক



এই পাতার আরো খবর