মহররমের দশম দিন, যা আশুরা নামে পরিচিত। এদিন কারবালার যুদ্ধে শহীদ ইমাম হুসাইন (রা.)-কে স্মরণ করার দিন। একই সময়ে আফগানিস্তানের কাশ্মীরের কাছাকাছি আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যেখানে কোন প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়েই তালেবান বাহিনী কাবুল দখল করে নিয়েছে। আর তা হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই।
কিন্তু যে দ্রুততার সাথে তালেবান কাবুল দখল করেছে তা পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। সেইসাথে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও যথেষ্ট বিব্রত করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পাশাপাশি ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কোনটিই হয়নি। এর পরিবর্তে আমরা দেখেছি আতঙ্কিত কাবুলের বাসিন্দাদের বিমানবন্দরে ভিড় করতে। এমনকি মোবাইলে ধারণ করা এক ভিডিওতে বিমান ছেড়ে যাওয়ার সময়ে বিমান থেকে দুজনকে পড়ে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি। সুতরাং, এই ঘটনা আফগানিস্তান, আমাদের অঞ্চল (পাকিস্তান – লেখকের অঞ্চল), কাশ্মীর এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর কাছে কী বার্তা দেয়?
এসকল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে, আমাদের ২০০০ সালের দিকে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি হয় সেদিকে নজর দেয়া গুরুত্বপূর্ণ যখন তালেবান, পাকিস্তানের পশতুন অধ্যুষিত অঞ্চলে পশতু পুরুষ সৈন্যদের পাকিস্তানের আইএসআই দ্বারা মাদ্রাসায় দেওবন্দ মতাদর্শ শিক্ষা দিতো। তারপর এক দশকের গৃহযুদ্ধ এবং সোভিয়েতদের চলে যাওয়ার কয়েক দশক পরে ভেঙে পড়া কাবুল দখল করার জন্য তাদের বিভিন্ন জাতিগত জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে বিভক্ত আফগানিস্তানে পাঠানো হয়। সেসময় আফগানিস্তানকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তালিবানদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো হয়েছিল।
তালেবান সেসময়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে অবিলম্বে ধর্মীয় শরীয়াহ আইন বাস্তবায়ন করতে শুরু করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিলো সব পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং নারীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা। এমনকি এসময় তারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত বামিয়ান বুদ্ধদের শতাব্দী প্রাচীন মূর্তিও ভেঙে ফেলে। কিন্তু আফগানিস্তানে সৌদি কট্টরপন্থী ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়া তাদেরকে দ্রুত পতনের দিকে নিয়ে যায়। তালেবানদের অজান্তেই, ওসামা বিন লাদেন ও তার সংগঠন আল-কায়েদা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলা চালায়। এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী ঝড় তোলে এবং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আল-কায়েদা জঙ্গিদের নির্মূল ও তালেবানকে অপসারণ করতে আফগানিস্তানে ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ঘাঁটি স্থাপন করে। পরবর্তী দুই দশকে আফগানিস্তান নারীর শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিশ্বের মূলধারার সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করে। আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল শিক্ষা ও মূল্যবোধে শিক্ষিত আফগান যুবক-যুবতীদের একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্ম বড় হয়েছে। এছাড়া আধুনিক কাবুল শহরে একটি সম্পূর্ণ নতুন উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও আবির্ভাব হয়েছে।
কিন্তু ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার অন্যান্য দেশ থেকে প্রথমে ন্যাটো বাহিনী ও পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমেরিকান বাহিনী প্রত্যাহারের পর সমগ্র আফগানিস্তান আবারও বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে ডুবে যায়।
প্রকৃতপক্ষে, তালেবানের হাতে কাবুলের পতনকে রাশিয়া ও ইরান সমর্থিত পাকিস্তান ও চীনপন্থীদের বিজয় মনে হতে পারে। কিন্তু স্বাধীনচেতা আফগান জনগণের জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে কাবুলের দুর্গকে ধরে রাখা কঠিন মনে হতে পারে। এই ঘটনা প্রতিবেশী পাকিস্তানের ধর্মীয়ভাবে মৌলবাদীদের উপরেও প্রভাব ফেলবে। অনেক সন্ত্রাসী সংগঠন একইভাবে পাকিস্তানে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করছে। ফলে দেশটিতে দেওবন্দ মতাদর্শ সমর্থনকারী এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলিকে সমর্থনকারী বেরেলভী মতাদর্শের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আরও উস্কে দেবে।
তবে এই বিশৃঙ্খলার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের খ্যাতি এবং বিশ্বাসযোগ্যতার উপর। ইতিমধ্যেই বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সারা বিশ্বে সমালোচিত হচ্ছেন। তালেবানের কাবুল দখল আবারও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে আবারও উস্কে দিচ্ছে। এর আগে বাইডেনের দুর্বল আচরণকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলেন ট্রাম্প।
যদিও তালেবানের ক্ষমতায় আসার ফলে ভারত সরাসরি প্রভাবিত নাও হতে পারে, তবে এটি আফগানিস্তানের কাছেই কাশ্মীর উপত্যকায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। কাশ্মীর অতীতে আফগানিস্তানের দ্বারা সংক্ষিপ্তভাবে শাসিত হয়েছে যা কাশ্মীরের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার এবং রক্তাক্ত পর্যায়গুলির মধ্যে একটি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কাশ্মীর উপত্যকায় অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য পাকিস্তান তালেবানদের উপর প্রভাব বিস্তার করে অলস বসে থাকা পশতু তালেবান জঙ্গিদের কাশ্মীরে পাঠাতে পারে। এর আগেও ১৯৯০ এর দশকেও আফগান জিহাদের পর পাকিস্তান এমন অনেক নিষ্ক্রিয় জঙ্গিকে কাশ্মীর উপত্যকায় নিয়ে যায়।
এই ঘটনা কী আবারও ঘটতে পারে?
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কী হতে পারে তা অনুমান করা খুব কঠিন। তবে এটি বলা যায়, আজকের কাশ্মীর ১৯৯০ দশকের কাশ্মীরের মতো নয়। কাশ্মীর উপত্যকার মানুষ ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ বাতিল সহ অনেক ধ্বংস, মৃত্যু এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখেছে। ফলে কাশ্মীরের জনগণ বর্তমানে স্থিতিশীলতা চায়। তাই তাদেরকে গত তিন দশকের আবর্তে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করে কোন ফল হবে না।
লেখক: তরুণ রাজনৈতিক নেতা এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের রাজ্য সম্পাদক।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন