বিভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত ভারতবর্ষের পাকিস্তান অংশের প্রথম রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত চলা পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন। দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি হচ্ছে ছয় দফা আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ৬ দফাকে কেন্দ্র করেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সের মাঠে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় অর্জন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ইতিহাসে এই প্রথম ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্রের মালিকানা লাভ করল। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি তার রাষ্ট্রের মালিকানা হারিয়ে ফেলে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পরে যা অবশিষ্ট থাকল সেটাকে কোনোভাবেই আর বাংলাদেশ বলা যাবে না। দেশটাকে পূর্ব পাকিস্তানে রূপান্তর করা হয়েছিল।
একটা ঘটনা উল্লেখ করলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে- স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, তারিখ ৭ মার্চ; শুধু সালটা ১৯৭৬। যেই রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যেখানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, ঠিক সেখানটাতেই সিরাত সম্মেলনে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ছয় দফা ঘোষণা করলেন। দফার সংখ্যা, স্থান এবং তারিখ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দফার বিরুদ্ধে দফাকে দাঁড় করানো হয়েছিল। অত্যন্ত হিসাব-নিকাশ করেই এমনটি করা হয়েছিল।
স্বাধীনতাবিরোধীরা মনে করত মুসলমান এবং পাকিস্তান সমার্থক। মুসলমানের পরাজয় হতে পারে না। মুসলমানের পরাজয়ের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলতেই জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের জায়গাটিতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শিশু পার্ক তৈরি করেছিলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়: “... এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,/... জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে/ হয়েছে উদ্যত কালো হাত। / তাই দেখি কবিহীন বিমুখ প্রান্তরে আজ/ কবির বিরুদ্ধে কবি,/ মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,/ বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, / উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,/ মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...”।
সীরাত সম্মেলনে ঘোষিত ছয় দফার প্রথম দফাই ছিল ‘বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।’ অন্যান্য দফার মধ্যে ছিল পতাকা বদলাতে হবে, শহীদ মিনার ভাঙতে হবে ইত্যাদি (অবশ্য এই রেসকোর্স ময়দানেই ১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’)। ওই সীরাত সম্মেলনে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব জিয়াউর রহমান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সীরাতে উপস্থিত পাকিস্তানের সমর্থক গোষ্ঠী স্লোগান তুলেছিল ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই, চাঁদ-তারা পতাকা চাই’। এমন একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছিল বঙ্গবন্ধুর নামটিও কেউ মুখে নিতে পারত না।
৪ আগস্ট ১৯৭৬, তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক জিয়াউর রহমান পিপিআর ঘোষণা করে। তাতে বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি বিশেষের প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারে এমন কোনো নাম দল গঠনের প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকতে পারবে না।’ ৪ নভেম্বর ১৯৭৬, জিয়াউর রহমান সরকার বঙ্গবন্ধুর নাম কেটে দিয়ে আওয়ামী লীগকে দল করার অনুমতি নিতে বাধ্য করে। ৩১ আগস্ট ১৯৭৬, খাঁন আতা ও আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা জেনারেল জিয়ার সাথে দেখা করতে গেলে সিনেমা থেকে শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলার প্রস্তাব আসে। তৎকালীন তথ্য সচিব এবিএম গোলাম মোস্তফা তা দ্রুত কার্যকরের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি ও নামের ওপর কালি লেপনের নির্দেশনা জারি করেন।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিদেশে অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় রূপান্তরিত পূর্বপাকিস্তানকে আবার বাংলাদেশের ধারায় ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। বাঙালির বুকে আশার সঞ্চার হয় বাংলাদেশকে আবার ফিরে পাওয়ার। এর মধ্যেই সহস্রাধিক সেনা সদস্যকে সামরিক বিচারিক প্রহসনের মাধ্যমে হত্যাকারী জিয়াউর রহমান একদল সেনা সদস্য কর্তৃক চট্টগ্রামে নিহত হন। কয়েকদিন ধানাই-পানাই করে বিচারপতি সাত্তারকে তাড়িয়ে ক্ষমতা দখল করেন অপর স্বৈরশাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। শুধু পীর বদল হয়- ‘শর্ষিনা থেকে আটরশি’, বাকি সবই আগের মতো। ‘সাফারি- সানগ্লাস -খাল কাটার’ জায়গায় চলে এলো ‘মেরি (লেডি)-হেলিকপ্টার-গতরাতে স্বপ্ন দেখা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায়।’ এরশাদ এক ধাপ এগিয়ে রাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে চিরতরে বিতাড়িত করার জন্য রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সামনে নিয়ে আসলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচন। কিন্তু ১৯৯১ এর নির্বাচনে গণতন্ত্র মুক্তি পেল না। সামরিক শাসক জিয়া এরশাদের মতোই গণতন্ত্র অবরুদ্ধ থাকলো ক্যান্টনমেন্টে। শহীদ নূর হোসেনের বুকে লেখা গণতন্ত্র পুরোপুরি মুক্তি পেল না। গণতন্ত্র থেকে গেল সেনানিবাসেই। সেনানিবাসে থেকে গেলেন আমাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। রয়ে গেল পাকিস্তানি ভাবধারা।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ৮ জানুয়ারি ১৯৯৩, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আফিস নওয়াজ জানজুয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে নজিরবিহীন শোকবাণী পাঠান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। জানজুয়া ১৯৭১ সালে হানাদার হিসেবে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনা করেন। স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলেও গণতন্ত্র মুক্তি পেল না।
বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে এদেশের মানুষ দীর্ঘ দেড় দশক পর গণতন্ত্রের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেও কুশীলবদের সূক্ষ্ম কারচুপির কারণে গণতন্ত্র ক্যান্টনমেন্টেই থেকে গেল। সেনানিবাস থেকেই গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দেশ শাসন করতে লাগলেন। সামরিক গোয়েন্দাদের খবরদারি থেকে গেল সরকার ব্যবস্থায়। পরবর্তী সময়ে আরও দুটি নির্বাচনে ১৯৯৬ এ আওয়ামী লীগ ও পরে ২০০১ এ বিএনপি ক্ষমতায় এলেও বিরোধীদলের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সেনানিবাসে থেকে গেলেন। পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক গোয়েন্দারা সবকিছুতেই খবরদারি করছিল। এই সময়ে ঘটে ইতিহাসের আরেকটি নিশংস হত্যার ঘটনা, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে, সকল গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশে তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে সদলবলে হত্যায়ই ছিল এই গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য। নারীনেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত-আহত হন এই গ্রেনেড হামলায়। আল্লাহর অসীম কৃপায় বেঁচে গেলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ক্যান্টনমেন্টে বসে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরাই দেশ চালাতেন তার প্রমাণ মেলে ১/১১ এর ষড়যন্ত্রের সময়ও। প্রকাশ পেতে থাকে ব্রিগেডিয়ার আমিন-বারীদের হাতেই বন্দী ছিল গণতন্ত্র। সেনানিবাসের মইনুদ্দিনরাই জোগাড় করেছিল ফকরুদ্দিনদের। এদেশের গণতন্ত্র বিনাশী ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সেনানিবাসে জন্মগ্রহণ ও নেতৃত্বের সেনানিবাসে অবস্থানকারী রাজনৈতিক দলটির সম্পৃক্ততা সন্দেহাতীত।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একটি টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে ২০০৯ সালের পরবর্তী সময়ে দেশের সেনানিবাসে জন্মানো রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বকে আইনসম্মতভাবে সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে আসা। এখানে আমি বাংলাদেশের রাজনীতির একটি স্থায়ী ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। এখন ‘সংসদে -রাজপথে-মিডিয়ায়’ যেভাবে গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হতে পারে; কিন্তু আজ থেকে ১০ বছর আগেও কিছু হলেই যেমনটি শোনা যেত, ‘উত্তর পাড়ার (সেনানিবাসের) খবর কি’ ?, এখন আর তেমনটি শোনা যায় না। একসময় একজন পান বিক্রেতা, রিকশাওয়ালাও সেনাবাহিনী প্রধান, পরবর্তী এবং তার পরবর্তী প্রধানের নাম পর্যন্ত জানতো। এমনকি সাভার সেনানিবাসের জিওসি কে, ট্যাংক রেজিমেন্টের দায়িত্বে কে ইত্যাদি খবর সাধারণ মানুষের মুখে মুখে থাকতো। এখন সেদিন আর নেই (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশে পলাতক কিছু সাংবাদিক এবং সাজাপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তার ইউটিউব সংলাপকে দেশের মানুষ পাগলের প্রলাপ হিসেবেই গণ্য করে)। আর সেটা সম্ভব হয়েছে সেনানিবাসে অবস্থানকারী দলটির নেত্রীকে সেনানিবাস থেকে বের করে আনার মধ্য দিয়ে।
এর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি ভাবধারায় যে দেশ চলছিল তার আর একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ২০০৫ সালের ৩ মে মৃত্যুবরণ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সেসময় বেগম খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করেই প্রধানমন্ত্রিত্ব চালাচ্ছিলেন। যার নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী কোনো শোক বার্তা দেননি, এর বিপরীতটাই করেছিলেন জানজুয়ার ক্ষেত্রে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যভিত্তিক মানবিক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। আর সেটার নেতৃত্ব অবশ্যই দিচ্ছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। যে দেশটি অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে পড়েছিল, ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষের দারিদ্র্য নিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী উত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রের ধারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটাই আজকে বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। ১৯৭২-৭৩ থেকে শুরু করে ২০০৬-৭ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর সময় লেগেছিল মাথাপিছু আয় ৫৩২ ডলারে আসতে। ২০০৭-৮ থেকে ২০১৯-২০ এসে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২০৬৪ ডলারে। ১১ বছরে প্রায় চারগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২২২৭ ডলার। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে নেতৃত্তের দূরদর্শিতা।
নেতৃত্বের দূরদর্শিতা কীভাবে একটা জাতিকে উন্নয়নের পথ দেখায় তা বুঝার জন্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে গেলেন। নেত্রীর অগ্রগামী দল হিসেবে আমরা যারা যুবলীগের নেতৃত্বে ছিলাম আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। বিকেলে সবাই যখন চা খাচ্ছিলাম তখন প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ করেই বলে বসলেন, ‘ভারতের দার্জিলিংয়ে যদি চা চাষ হতে পারে, তাহলে পঞ্চগড়ে কেন হবে না’। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রবিউল হোসেন। সম্ভাবনা যাচাই করতে তিনি মৌলভীবাজার থেকে চারা সংগ্রহ করে টবে লাগালেন। ২৫ বছর পর এখন পঞ্চগড়ে প্রায় ৩০০০ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ২০১৭ সালে উৎপাদন ছিল ৫৫ লাখ কেজি। বছরে তিন কোটি কেজি চা উৎপাদন সম্ভব।
শেখ হাসিনার মনোবল কত দৃঢ় এবং সিদ্ধান্তে কতটা অবিচল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। দেশি-বিদেশি সকল চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি ছিলেন আপসহীন। এ ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে মুখের ওপর গ্যাস রপ্তানির সুযোগ নাকচ করে দিয়েও তার অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যখন অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ালো তখন কালবিলম্ব না করে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন পদ্মা সেতু হবে নিজস্ব অর্থায়নে এবং হয়েছেও তাই। পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরে কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না’। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তির স্থাপত্য রূপ হচ্ছে পদ্মা সেতু। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে একই ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ তোলে ‘সিউল থেকে বুসান’ হাইওয়ে নির্মাণে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্ব ব্যাংক। তখন দক্ষিণ কোরিয়া মহাসড়কটি নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করে দেখিয়ে দেয়, ‘আমরাও পারি’। এরপর থেকে বিশ্বব্যাংকের নির্ভরতা কমিয়ে আনে। ১৯৯৬ সালের পরে দক্ষিণ কোরিয়া আর বিশ্বব্যাংকের কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সততা এবং দুর্নীতিমুক্ত থাকার কারণে বিশ্ব দরবারে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। সম্প্রতি ইউরোপের একটি গবেষণা সংস্থা ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ বিশ্বের ৫ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের কোনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। তাদের বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো সম্পদও নেই। ১৭৩ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে স্কোর করা হয়। এই তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, তার স্কোর ৯০। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং , স্কোর ৮৮। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮৭ স্কোর পেয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলবার্গ এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেন, তাদের স্কোর ছিল যথাক্রমে ৮৫ এবং ৮১। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের ৭৮ শতাংশ মানুষ মনে করে শেখ হাসিনা দুর্নীতিমুক্ত এবং লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। ছোটখাটো দুর্নীতিও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুর সমস্ত মানবিক গুণাবলিকে উত্তরাধিকার হিসেবে নিয়ে আত্মমানবতার সেবায় নিবেদিত হতে। ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় নিজ হাতে বন্যার্তদের জন্য রুটি বানাতে আমরা দেখেছি। একইভাবে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে পরিবারের সকল সদস্যদের হারানো তিন কন্যাকে নিজের কন্যা হিসেবে গ্রহণ করে তাদের বিয়ের আয়োজন করতে দেখেছি। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে, যার মধ্য দিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনার মানবিকতার পরিস্ফুটন ঘটেছে। চলমান করোনা মহামারীর গত এক বছরেও সারাদেশে ৫০ লাখ পরিবারকে আর্থিক মানবিক সহায়তার নতুন রেকর্ড তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল। পূর্ব থেকেই আরও ৫০ লাখ পরিবারের দুই কোটি সদস্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ছিল। এর আওতায় ভিজিএফ কার্ড, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তাদের জন্য ভাতা ইত্যাদি চালু করে একটি উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আদর্শ মডেল হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই স্থান করে নিয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বশেষ মাইলফলক উদাহরণ হচ্ছে গৃহহীনদের গৃহদান। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এই মুজিববর্ষে সাড়ে ৮ লাখ গৃহহীন মানুষকে পাকা ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন। দুস্থদের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে খুব সম্ভবত এটাই সবচেয়ে বড় গৃহায়ন প্রকল্প।
বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা মানবিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। জাতিসংঘের চলতি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যে মানবতা দেখিয়েছেন তা মনে রাখবে বিশ্ববাসী’। জাতিসংঘের কার্যক্রমে বিশ্ব শান্তি রক্ষায়, জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসা করেন জাতিসংঘের মহাসচিব।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কতটা মানবিক এর একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ প্রধানমন্ত্রী উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান। সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশে আশ্রয়গ্রহণকারী নির্যাতিত নারী ও শিশুর মুখে নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও বর্বরোচিত অত্যাচারের কথা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। এই রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের ওপর একটি সংবাদচিত্র লন্ডনের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘চ্যানেল ফোর’ কর্তৃক প্রচারিত হয়। চ্যানেলটির এশিয়ান করেসপন্ডেন্ট জনাথান মিলার তার প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মমত্ববোধ, মানবিকতা, মহানুভবতা ও উদারনৈতিক মানসিকতার জন্য ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ অভিধায় অভিহিত করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা চারবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন জনসাধারণের ক্ষমতায়ন ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে যুগান্তকারী পরিবর্তনের পাশাপাশি বিশ্ব জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বের বহু খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে এবং পদকে ভূষিত করেছে। এই ধারাবাহিকতায় এ বছর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সংক্রান্ত নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘জুয়েল ইন দি ক্রাউন অব দি ডে’ (মুকুট মণি) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সাফল্য দেশ ও জাতির জন্য বয়ে এনেছে গৌরব, আমরা হয়েছি মর্যাদাবান।
লেখক : অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা