ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে!
হাসান ইবনে হামিদ
ইমরান খান

'আজ আমি ভারতকে স্যালুট জানাই। ভারতের বিদেশ নীতি সবসময়ই একটি স্বাধীন চিন্তা রেখেছে। ভারত কোয়াড অ্যালায়েন্সের সদস্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যতম সদস্য। কিন্তু তবুও ভারত নিজেকে নিরপেক্ষ বলে। নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে ভারত। কারণ ভারতের বিদেশ নীতি সেদেশের জনগণের জন্য।'

উপরোক্ত বক্তব্যটি এমন একজন ব্যক্তি দিয়েছেন যার নাম শুনলে কেউই হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না!  ভারতকে নিজেদের চিরশত্রু ভাবা যে ব্যক্তি সর্বদা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেন, যিনি কিনা মোদি সরকারের কট্টর সমালোচক তেমন একজন ব্যক্তির মুখেই ভারত ও মোদী সরকারের প্রশংসা ফুটে উঠেছে। 

তিনি আর কেউ নন, পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান! পাকিস্তানের খাইবার-পাকতুনখাওয়া প্রদেশে এক জনসভায় ইমরান খান এই বক্তব্য দিয়েছেন। ইমরান খান ওই জনসভায় নিজ দেশের পররাষ্ট্রনীতিরও কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট ছিলো যে, পূর্বে পাকিস্তানের বিদেশ নীতি নিজ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য নেয়া হয়নি, অন্যদেশের সুবিধা বা হুকুম পালনের নিমিত্তে নানা নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ভারতকে নিয়ে এমন স্তুতিমূলক বক্তব্যের পর গোটা রাজনৈতিক মহলে চলছে নানামুখী আলোচনা। কিন্তু সেসব আলোচনায় যাবার আগে ইমরান খান কোন প্রেক্ষিতে ভারতের প্রশংসা করেছেন তা জানা দরকার!

বস্তুত ইমরান খান বা পাকিস্তানের কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের এভাবে খোলাখুলি ভারতের প্রশংসা করাটা একেবারে বিরল! তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়টাতে মোদি সরকার যে দারুণ কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে তা প্রশংসিত হচ্ছে এখন সর্বমহলে। মার্কিন সতর্কতা সত্ত্বেও নিজ দেশের জনগণের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের কোন ধরণের বক্তব্যকে পাত্তা না দিয়ে রাশিয়া থেকে কম দামে বেশি তেল কিনছে ভারত। রাশিয়া থেকে ইতিমধ্যে ২০ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় তেল পরিশোধনকারী সংস্থা হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (এইচপিসিএল)। ইউরোপের জ্বালানি কোম্পানি ভিটল থেকে কেনা এই তেল আগামী মে মাসে ভারতের হাতে পৌঁছাবে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। পাশাপাশি রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস কেনার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য দেশগুলোকেও প্রতিশোধমূলক নিষেধাজ্ঞার বার্তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কিছু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে না। ফলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম দামে তেল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে রাশিয়া। তাই লাভের আশায় মার্কিন হুমকি উপেক্ষা করেই দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে ভারত। 

এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, রাশিয়ার তেল কেনা এড়াতে আমেরিকার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। গত শুক্রবার দেশটি জানায়, জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের নির্ভরতা ‘রাজনীতিকরণ’ করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রও অগত্যা এই যুক্তি মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ, ভারত সরকার তার কূটনৈতিক বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে আমেরিকার মুখও বন্ধ করে দিয়েছে আবার নিজ দেশের জনগণের স্বার্থে কম দামে বেশি তেলও কিনে রাখছে। এমন সাহসী ও বিচক্ষণ পদক্ষেপের জন্য শুধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই না বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকেও মোদী সরকার বাহবা পাচ্ছে। 

হঠাৎ করেই কী এমন ঘটলো যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের ভূয়সী প্রশংসা করছেন! এই প্রশ্ন এখন সবার মনে। যারা পাকিস্তানের রাজনীতির খোঁজ রাখেন তাদের হয়ত জানার কথা, পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনাস্থা প্রস্তাবের মুখে আছেন। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হওয়ার সময় ইমরান খানের এই বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। অনেকদিন ধরেই ইমরান খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিলো, বিরোধী রাজনৈতিক জোট প্রবল আন্দোলনে ইমরান খানের সরকারকে বেহাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। যতো সময় যাচ্ছে ততোই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের। নতুন করে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান খান উত্তীর্ণ হতে পারবেন কিনা সে আলোচনা সর্বমহলে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এবার গদি বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে ৮ মার্চ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয় বিরোধী দলগুলো। এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা ও ভোটাভুটির জন্য অধিবেশন ডাকতে স্পিকার আসাদ কায়সারের প্রতি লিখিত আবেদন জানায় তারা। 

পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, লিখিত আবেদন জমা পড়ার ১৪ দিনের মধ্যে স্পিকারকে আলোচনার জন্য অধিবেশন ডাকতে হবে। তার মানে হলো, ২২ মার্চের মধ্যে অধিবেশন আয়োজন করার কথা। তবে এদিনই আবার জাতীয় পরিষদে শুরু হচ্ছে ওআইসির দুই দিনব্যাপী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। তাই ওআইসির সম্মেলনের কারণে অধিবেশন দুই দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের জন্য ২৫ মার্চ শুক্রবার পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন আহ্বান করেছেন স্পিকার আসাদ কায়সার। এই ভোটাভুটিতে ইমরানের পক্ষে গদি বাঁচানো মুশকিল। এদিকে ৪২ শতাংশ পাকিস্তানি মনে করছেন, এবারের অনাস্থা প্রস্তাবে সফল হবে বিরোধী জোটগুলো। আবার সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রে খবর,গত শুক্রবার জেনারেল বাজওয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইমরান। বৈঠকে অনাস্থা প্রস্তাব থেকে শুরু করে বলোচিস্তানে বিদ্রোহীদের কার্যকলাপ নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে খবর। গণমাধ্যমের দাবী, পাক সেনার চার শীর্ষ পদাধিকারী, যাঁদের মধ্যে অন্যতম সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া, ইমরানকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। 

গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া খবর থেকে পরিষ্কার ইঙ্গিত, ইমরানকে ঘিরে চলতে থাকা লাগাতার বিক্ষোভের ঢেউ যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেখান থেকে আর তাঁর পক্ষে গদি বাঁচানো সম্ভব নয়। সে কথা বুঝে গিয়েছে পাক সেনাও। তাছাড়া ইমরানের প্রতি সেনাও বেজায় ক্ষিপ্ত। বিশেষ করে ইউক্রেন ইস্যুতে যেভাবে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কটাক্ষ করেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী, সেটাও একেবারেই ভালভাবেই নিচ্ছে না তারা। এদিকে মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কায় পাকিস্তানের বেহাল দশার জন্যও তারা কাঠগড়ায় তুলছে ইমরানকেই। সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি, তাতে পাকিস্তানের মসনদে যে আর টিকে থাকা সম্ভব নয় তা সম্ভবত বুঝছেন তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান নিজেও। আর তাই প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি গদি বাঁচাতে নতুন কোনও কৌশল নিচ্ছেন পাক প্রধানমন্ত্রী? কেননা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে ইমরান খান সেই একই জনসভায় বলেছেন, 

'পাকিস্তানের বিদেশ নীতি এমন হবে যাতে দেশের মানুষের উপকার হয়। কারও সামনে কখনও নত হইনি। দেশেরও মাথা নিচু হতে দেব না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সমর্থন চেয়েছিল। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা শুনে পাকিস্তানের কোনও লাভই হবে না। আমরা আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধের অংশ হয়েছি এবং ৮০ হাজার মানুষ এবং ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারিয়েছি।'

পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের জনগণের কথা চিন্তা করছেন ইমরান খান, এমন একটা বক্তব্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে এই অনাস্থা ভোটের আগে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার নতুন ফন্দি ইমরান খান আঁটছে কিনা তাও এখন সর্বমহলে আলোচিত। নাহলে হঠাৎ করেই কি এমন হলো যে ভারত সরকারের বিদেশ নীতির প্রশংসা তাঁকে করতে হচ্ছে! 

মন্থরার মুখের কথা শুনে রাম কতটা বিস্মিত হয়েছিলেন, সেটি মহাভারত যারা পাঠ করেছেন, তাদের না জানলেও চলবে, যারা পাঠ করেননি, সময়-সুযোগ পেলে পড়ে নেবেন এবং গোচরে-অগোচরে পড়ে ফেলবেন। ইমরান খানের এই স্তুতিবাক্য তো পুরাতন সেই লাইনকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে! 

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। 

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর