ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

লাভ-ক্ষতির হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর
হাসান ইবনে হামিদ
শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি (ফাইল ছবি)

সমালোচনা ও অপপ্রচার ছাড়া আজ নাগাদ কোন ভারত সফর হয়নি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে ভারত সফর বিনা বাক্যে হয়ে যাবে সেটার কোন সম্ভাবনাও আপাতত দেখা যাচ্ছে না। দেশবিক্রির ধোঁয়া এখন আর মানুষকে আচ্ছন্ন করতে পারে না তাই নতুন সব অভিনব পন্থায় বিরোধীরা চালায় অপপ্রচার।

গত ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত যান। ভারতের মাটিতে পা রাখা মাত্রই বিমানবন্দরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনা নিয়ে একদল বাংলাদেশি সোশাল মিডিয়ায় শুরু করে হট্টগোল! ভারতের প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে আসার মাধ্যমে নাকি ভারত বাংলাদেশকে অপমান করেছে! এরপর আবার দেখলাম কলকাতায় ভারতীয় একদল রাস্তায় আন্দোলন করছে এই বলে যে, ‘নরেন্দ্র মোদির বিজেপি নাকি বাংলাদেশের দালাল, তারা নাকি বাংলাদেশকে কতোকিছু দিয়ে দিচ্ছে!’ তো অবস্থা যখন দুই দেশেই এমন তখন লাভ ক্ষতির হিসেবে এবারের ভারত সফরে শেখ হাসিনার অর্জনকে একটু পোস্টমর্টেম করতেই হচ্ছে।

যেকোন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আন্তর্জাতিক শর্ত মেনে দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা রেখেই করা হয়। লাভ ক্ষতির ধারণাটা এসব চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকের ক্ষেত্রে আপেক্ষিক। এবারের ভারত সফরে ভারত বা বাংলাদেশ কি পেলো তার হিসেব নিকেশের আগে একটু বলা দরকার শুরুর অপপ্রচারটা নিয়ে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গেলে গত ৫ সেপ্টেম্বর সোমবার তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন দেশটির রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম জারদোশ। এই অভ্যর্থনার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে অনেকেই বলছেন, নরেন্দ্র মোদি বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা না জানানো নাকি বাংলাদেশের অপমান! এই মান অপমান শব্দ চয়নের আগে আমাদের জানতে হবে ‘ডিপ্লোম্যাটিক প্রটোকল’ নিয়ে।

কূটনৈতিক প্রটোকলের ক্ষেত্রে একেক রাষ্ট্রের নিয়ম একেক রকম। ভারতের ডি ফ্যাক্টো আইন অনুযায়ী বিদেশি কোন রাষ্ট্র প্রধানকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে অভ্যর্থনা জানানোর তেমন কোন নিয়ম নেই। তবে এই পর্যন্ত যারা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন, তারা অনেক সময় তাদের রাজনৈতিক এবং জাতীয় স্বার্থে প্রচলিত প্রথা ভেঙ্গে অনেক বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের বিমানবন্দরে অভ্যর্থনাও জানিয়েছেন। ভারতের সরকার প্রধান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আজকে বিমানবন্দরে গিয়ে অভ্যর্থনা না জানালেও পূর্বে দুইবার নরেন্দ্র মোদি সশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ডের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের বেলাতেও আমরা এমনটা হতে দেখেছি। তাই বাংলাদেশকে অপমানের যে প্রসঙ্গটা আসছে তা সম্পূর্ণরূপে অতীতের ভারতবিরোধী প্রচারণার একটা অংশ মাত্র। অপপ্রচারকারী গোষ্ঠী যে সর্বদা সক্রিয় তার প্রমাণ এবারের ভারত সফরের শুরুর মুহূর্তটিতেই তারা দিয়েছে। 

৬ সেপ্টেম্বর দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যাশিতভাবেই সাতটি 'এমওইউ' বা সমঝোতাপত্র সেখানে স্বাক্ষরিত হয়েছে। যেসব বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, সেগুলো হলো অভিন্ন নদী কুশিয়ারা থেকে পানি প্রত্যাহার, ভারতে বাংলাদেশের রেলকর্মীদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ রেলওয়ের আইটি সিস্টেমে ভারতের সহযোগিতা, ভারতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল অফিসারদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি কর্মসূচি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে ভারতের কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) ও বাংলাদেশের কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (বিসিএসআইআর) মধ্যে সমঝোতা, মহাকাশপ্রযুক্তিতে সহযোগিতা এবং প্রসার ভারতী ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মধ্যে সম্প্রচার সহযোগিতা। 

এই সমঝোতা স্মারকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল কুশিয়ারা নদীর রহিমপুর পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশকে ১৫৩ কিউসেক জল প্রত্যাহার করতে দিতে ভারতের রাজি হওয়া। কেননা ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির পর এই প্রথম ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগিতে রাজি হল। গত মাসে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে কুশিয়ারার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিল। এই কমিশনের বৈঠক হয়েছিল প্রায় বারো বছর পর। কুশিয়ারা নদীর পানি কতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা অনেকেই অনুধাবন করতে পারছি না। তবে সিলেটবাসী ঠিকই জানে কুশিয়ারা নদীর পানি কিভাবে তাদের প্রতিটি মুহূর্তের সাথে জড়িয়ে আছে। আঞ্চলিকতার হিসেবে সিলেটের কুশিয়ারার পানির তাৎপর্য অনেক বেশি।

কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে সিলেটের জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৫৪ হেক্টর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন সুবিধাসহ প্রায় ১০ হাজার ৬শ হেক্টর ভূমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। এই চুক্তির গুরুত্ব যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। ২০১০ সালে খাদ্য নিরাপত্তার অংশ হিসেবে অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আনতে সিলেটের জকিগঞ্জে রহিমপুর খালে পাম্প হাউস নির্মাণের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পের সুবিধার্থে ২০০৯ সালে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে খালের উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ধারণা এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জেলার তিনটি উপজেলার প্রায় ১০ হাজার ৬শ হেক্টর ভূমি বোরো ধান চাষ ও মৌসুমি ফসলের আওতায় আসবে।

পাউবোর আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের অধীনে এর ব্যয় ধরা হয় তিনশ কোটি টাকা। খনন করা হয় বেশ কয়েকটি খাল। মূল প্রকল্প পাম্প হাউস ও রহিমপুর খাল খনন প্রকল্প শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০১৬ সালে সেচ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। কুশিয়ারা নদীর সাথে সংযোগ স্থলের বাঁধের ৪১০ মিটারের মধ্যে ৩২৫ মিটার সম্পন্ন হয়। এরপর নদী হতে খালটির সংযোগস্থলে বাঁধ কাটতে গিয়ে বিএসএফের বাধার মুখে পড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানির উৎসমুখ বন্ধ থাকায় দীর্ঘ রহিমপুর খালটি মরাখালে পরিণত হয়। তালনদী, চিকানালা ও সদাখালে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারেনি রহিমপুর খাল। মুখথুবড়ে পড়ে শত কোটি টাকার প্রকল্প, এবং বঞ্চিত হয় তিন উপজেলা। তাই কুশিয়ারা নদীর পানিবন্টন চুক্তি অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ। 

৫৪টি যৌথ নদীর পানি বণ্টনের প্রসঙ্গে এলে তিস্তা সবসময় গুরুত্ব পায়। এটি এই দুই দেশের অমীমাংসিত অনেক পুরনো একটি ইস্যু। কিন্তু এবার তিস্তা নদীর চাইতে কুশিয়ারাই প্রাধান্য পেয়েছে এবং সেই প্রাধান্য পাবার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। 

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে বিদ্যুৎ সঙ্কট চলছে, তার পটভূমিতে দু'দেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত রামপাল মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রর আসন্ন কমিশনিং খুব ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে–হায়দ্রাবাদ হাউসে দুই প্রধানমন্ত্রীর সামনেই বাজিয়ে শোনানো হয় সেই রামপাল প্রকল্পের লঞ্চিং প্রোমো। গত মাসেই এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়টি বাংলাদেশের পাওয়ার গ্রিডের সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করা হয়েছে এবং ভারত এটিকে দু'দেশের জ্বালানি সহযোগিতার ক্ষেত্রে খুব বড় পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছে। ভারত থেকে বাংলাদেশ যাতে সরাসরি পরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনতে পারে, তা নিয়েও আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা হয়েছে। ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেডকে বাংলাদেশ একটি জি-টু-জি সাপ্লায়ার, অর্থাৎ এক সরকার থেকে আরেক সরকারের কাছে সরবরাহকারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ফলে বাংলাদেশে তেল বিক্রির প্রস্তাব সক্রিয় বিবেচনায় আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে "ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন ও বাণিজ্য সহযোগী" বলে বর্ণনা করেছেন, শেখ হাসিনাও জানিয়েছেন, এই দুই বন্ধু দেশ যে কোনও অমীমাংসিত বিষয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মেটাতে সক্ষম।

দ্বিপক্ষীয় শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই অমীমাংসিত সমস্যা সমাধান করবে দুই দেশ। কিন্তু যেকোন সফরকে মূল্যহীন বলে সার্টিফিকেট দেয়া গোষ্ঠীর বক্তব্য শুনলে মনে হবে বাংলাদেশ বা ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা বুঝি পিকনিক করতে এক দেশ থেকে আরেক দেশে সফরে যায়! গত কয়েকদিন ধরে অনেক গণমাধ্যমে যে উপায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে, যেভাবে এই সফরকে গুরুত্বহীন বলে বর্ণণা করার চেষ্টা চলছে তা এককথায় নজিরবিহীন! যে মানুষটি আজমির শরিফে গিয়েও শুধুই এদেশের মানুষের মঙ্গল কামনা করে এসেছেন সেই মানুষটিকে নিয়েই কতোশতো অপপ্রচার করছে দেশবিরোধী শক্তি! তবে এতোকিছুর মাঝেও দিনশেষে একমাত্র শেখ হাসিনাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রকৃত মাত্রাটা বুঝেন, আর বুঝেন বলেই গত একযুগের শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নিয়ে গিয়েছেন ভিন্ন উচ্চতায়। 

লেখক : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন



এই পাতার আরো খবর