ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

মুক্তিযুদ্ধের সেই বিজয়
ড. মো. মতিউর রহমান
ড. মো. মতিউর রহমান

দেখতে দেখতে কেটে গেল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অর্ধ-শতাব্দী। এক বছর আগে ১৬ ডিসেম্বরে বিপুল উৎসাহ- উদ্দীপনার মধ্যে দেশে পালিত হয় বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী। যেহেতু ১৯৭১ সালের এই দিনটিতেই হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। ফলশ্রুতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয় এবং বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের। যদিও বিজয়ের মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি।

১৬ ডিসেম্বর মানেই বাঙালি জাতির কাছে বিজয়ের দিন। অর্ধ-শতাব্দী আগে কীভাবে এই বিজয় অর্জিত হয়েছিল তা হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া অনেকের কাছেই অজানা। এ নিয়ে আছে তাদের মধ্যে কৌতুহল। তারচেয়েও বড় কথা, মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বড় গৌরব ও শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেম ও মহৎ আদর্শে উজ্জীবিত হতে চিরকাল শিক্ষা দেবে। 

মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান যিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ‘ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল’ পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিবেদন লিখে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তিনি ঢাকাতেই অবস্থান করেছিলেন। তাঁর ‘ঢাকা ডায়েরি, ১৬ ডিসেম্বর’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনী ঢাকাকে অবরোধ করে রেখেছিল। এমন কী ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় তেজগাঁও বিমানবন্দরও সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় পিটার আর কান জানান, সেদিন সোয়া দশটার দিকেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করছে। ঢাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তার মুখে এই সংবাদ শোনার পর কয়েকজন সাংবাদিক ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটলেন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা রাও ফরমান আলীর কাছে। কেননা এই পাকিস্তানি মেজর জেনারেল ছিলেন, হানাদার বাহিনীর অন্যতম রণকৌশল নির্ধারক। ক্যান্টনমেন্টের গেটে গিয়ে বিদেশি সাংবাদিকরা দেখতে পান, পাকিস্তানি সেনারা বাস, ট্রাক, গাড়ি, এমনকি রিকশাতে চড়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। শুধু তাই নয়, বেসামরিক পাকিস্তানি-বিহারীরাও ক্যান্টনমেন্টে ঢুকছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। দুপুর পৌনে একটার দিকে ঢাকা বিমানবন্দরে ভারতীয় হেলিকপ্টার অবতরণ করে। সেখানে দেখা গেল, ভারতীয় জেনারেল নাগরা এবং ব্রিগেডিয়ার ক্লেরকে। শেষোক্ত সেনানায়ক সেদিন সকালে উত্তর দিক থেকে ঢাকা শহরে প্রবেশ করা মিত্র বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিকেলে ভারতীয় জেনারেল নাগরা এবং পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেতে দেখা যায়। তারপর শেষবেলায় রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় সেই ঐতেহাসিক ঘটনা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। সাংবাদিক পিটার আর কান তাঁর রির্পোটে উল্লেখ করেছেন, “আত্মসমর্পণের দলিল চার দফায় স্বাক্ষরিত হয়। কিছুটা সময় লাগল, কারণ জেনারেল নিয়াজি সব দলিল পড়লেন, এমনভাবে যেন প্রথমবারের মতো পড়ছেন।”

অর্ধ-শতাব্দী আগে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের মাথায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। কোন প্রেক্ষাপটে হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, সেটা এবার দেখা যাক। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। পৌনে ৬টায় পাকিস্তান বিমানবাহিনী হঠাৎ ভারতের বিমানবাহিনীর স্থাপনাসমূহ ও বিমানবন্দরগুলোতে বোমা বর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ। নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে গঠিত মুক্তিপৌজের ক্ষুদ্র বিমানবাহিনী সক্রিয় করা হয়। মধ্যরাত ঢাকার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় বিমানের তেল সংরক্ষণাগারে আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে বিমান যুদ্ধের সূচনা করে মুক্তিফৌজ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেদিন দিল্লী পৌঁছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, পাকিস্তান আজ ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। এই আক্রমণ ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিহত করতে হবে। তিনি দেশবাসীকে চরম ত্যাগ স্বীকারে তৈরি হওয়ার আহ্বান জানান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী হলো মিত্রবাহিনী। গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। রাতে যশোর, চট্টগ্রাম, তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলায় মিত্রবাহিনী বিমান হামলা শুরু করে। এভাবেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব।

ভারত-বাংলাদেশ বাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি অবস্থানগুলোকে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টায় সীমান্তের ৭টি এলাকা দিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করে। ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সব রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অভিযানে হানাদার বাহিনী সর্বত্র পিছু হটে। ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ভারতীয় বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, করাচী, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। প্রথম রাতের আক্রমণেই পাকিস্তান বিমান বহরে প্রায় অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর মিত্রশক্তির বিমানবাহিনী ঢাকার আকাশ পুরোপুরি দখল করে নেয়। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর প্রায় সব বিমান বিধ্বস্ত হয়ে যায়। সারাদিন ধরে ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো অবাধে আকাশে উড়ে হানাদারদের ঘাঁটিগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো।

বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘গাজী’ ধ্বংস হয়। ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। শত্রুবাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মাইলফলক। এদিন সকালে ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে তারবার্তা দেন। পরদিন মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হানাদার বাহিনী সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পালাতে থাকে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির মধ্যে ভারত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। 

লোকসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ সরকারের বার বার অনুরোধের ভিত্তিতে ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” অন্যদিকে আমেরিকা উত্তর ভিয়েতনামে যুদ্ধরত দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত মার্কিন ৭ম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ দেয়। রণাঙ্গনে ততক্ষণে পাকিস্তানিরা পালাতে শুরু করে। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবহিনী অবরোধ সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে অবস্থানরত সোভিয়েত ইউনিয়নের রণতরী বহর তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। জেনারেল নিয়াজী যুদ্ধ পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে গোপন বার্তা পাঠান। ৮ ডিসেম্বর হানাদারবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণভাবে বিছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে আশ্বাস দেন, আত্মসমর্পণ করলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। জেনারেল মানেকশের এই আহ্বান আকাশবানী থেকে নানা ভাষায় বারবার প্রচার করা হয়। ৯ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী দেশের অধিকাংশ জেলায় বিজয়কেতন উড়িয়ে ঢাকা দখলের জন্য অগ্রসর হয়। মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “আমরা এখন বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। আর আমাদের পিটি-৬৭ জলচর ট্যাঙ্কগুলো নদী পেরিয়ে যেতে পারবে।” মিত্রবাহিনী দ্রুত ঢাকা পৌঁছাবার লক্ষ্য নিয়ে চারদিকে থেকে অগ্রসর হয়। ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকা ছাড়া দেশের বেশিরভাগ জেলা শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। ঢাকায় কারফিউ আর ব্ল্যাক আউটের মধ্যে চূড়ান্ত হামলা চালিয়ে শত্রুদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার লক্ষ্যে যৌথবাহিনী এগুতে থাকে। মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো ঢাকা বেতার কেন্দ্র এবং কুর্মিটোলার ওপর বার বার রকেট হামলা অব্যাহত রেখে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি জাহাজভর্তি পাকিস্তানি সেনা বঙ্গোপসাগর হয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে।

১১ ডিসেম্বর সকাল থেকে ঢাকায় প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। রাতে ঢাকার চারপাশের নির্দিষ্ট এলাকায় মিত্রবাহিনী ছত্রীসেনা অবতরণ করায়। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর প্রেরণের প্রতিবাদে মুক্তিবাহিনী গেরিলা ইউনিট ক্র্যাক প্লাটুন সকাল ১০টায় তোপখানা রোডের আমেরিকান কালচারাল সেন্টার এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ১২ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের আরও একটি ইউনিট ডেমরা ঘাট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এসে হাজির হয়। জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাশ্যূট ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামায়। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কাদেরিয়া বাহিনী। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। ফলে ঢাকার দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যায় মিত্রবাহিনী।

১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে মধুমতি নদী অতিক্রম করে। দ্রুত ঢাকা পৌঁছানার জন্য মিত্রবাহিনী দুটি ব্রিগেড শত্রুর অবস্থান এড়িয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়ে নদী পার হয়। মিত্রবাহিনী পারাপারের জন্য শত শত নৌকার বন্দোবস্ত করে। সারারাত ধরে তাদের নদী পার করে। ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন ৭ম নৌবহরকে মোকাবিলা করার জন্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর মার্কিন রণতরী ৭ম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। অসংখ্য নদীনালা, খালবিলসহ নানা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলায় অবরুদ্ধ ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় ক্রমাগতভাবে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একের পর এক বোমাবর্ষণ ও স্থলপথে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি আক্রমণে দখলদার বাহিনীতে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। চারদিক থেকে পরাজিত হতে হতে পাকিস্তানি বাহিনী বুঝে পেলে যুদ্ধে তাদের পরাজয় অবধারিত। ফলে সব আশা ছেড়ে দিয়ে শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে বিদেশী দূতাবাসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেন নিয়াজী।

জবাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি কমান্ডারদের শর্তহীন আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে গভীর রাতে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজীকে নির্দেশ দেন যে, ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান আত্মসমর্পণের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য তা মেনে নেওয়া যেতে পারে। জেনারেল নিয়াজী রাত ২ টার মধ্যে বাংলাদেশের সব জায়গায় অবস্থানরত পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তারবার্তা পাঠান। ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টা। ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানের উর্ধতন সেনা কর্মকর্তারা তাদের দফতরে বৈঠক করছিলেন। সে সময় একটি চিরকুট সবাইকে চমকে দেয়। বৈঠকে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল একে নিয়াজী, মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ, ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী, সিদ্দিক সালিক এবং আরও কয়েকজন। সে চিরকুটে লেখা ছিল “প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।” এখানে ‘আব্দুল্লাহ’ বলতে জেনারেল নিয়াজীকে বোঝানো হয়েছিল। এ চিঠি পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা। সকাল আটটা নাগাদ ঢাকার মিরপুর ব্রিজের কাছে মেজর জেনালের নাগরাকে বহনকারী একটি সামরিক জিপ এসে থামে। জেনারেল নাগরা কীভাবে ঢাকায় প্রবেশমুখে এসে পৌছলেন সেটি সবাইকে অবাক করেছিল। এরপর জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠানো হলো। একই সঙ্গে মিরপুর ব্রিজের কাছে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের বলা হলো তারা যেন যুদ্ধবিরতি মেনে চলে এবং জেনারেল নাগরাকে নিরাপদে শহরে ঢুকতে দেয়। সে মুহূর্তটিকে সিদ্দিক সালিক তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে বর্ণনা করেছে এভাবে, “ভারতীয় জেনারেল হাতে গোনা সৈন্য এবং অনেক গর্ব নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করলেন। তখনই কার্যত ঢাকার পতন হয়ে গেল।”

জেনারেল নাগরা যখন ঢাকায় প্রবেশ করলেন তখন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। ঢাকার পতনকে জেনারেল নিয়াজির তৎকালীন সচিব কর্নেল সিদ্দিক সালিক তুলনা করেছেন হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত একজন মানুষের সঙ্গে। শরীরের কোথাও আঘাত না থাকলেও পুরো শরীর অচল হয়ে গেছে। দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়াজীর মধ্যে আত্মসমর্পণ চুক্তি নিয়ে যখন দর কষাকষি চলছে, তখন পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা ছিল আলোচনার একটা বড় বিষয়। বিকেলে পাক বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ ও ভারত মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

শুধুমাত্র কর্নেল সিদ্দিক সালিক নন, তার বস মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রধান লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজীও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার তাদের ভূমিকা নিয়ে বই লিখেছেন। সেই বইয়ে নাম ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান এ এ কে নিয়াজি আত্মপক্ষের সাফাই গেয়েছেন এভাবে, “আমাকে যে দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে, তাতে আমার কোনো হাত অথবা ইচ্ছা ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্ট আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। তখন আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। এক, পশ্চিম পাকিস্তানকে হারোনার ঝুঁকি নেওয়া; অথবা দুই. পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মহান ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেওয়া। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমি শেষোক্ত পথই বেছে নিই। ...

যুদ্ধ জয়ের আনন্দে বাঙালিরা তখন আত্মহারা ছিল। কয়েক ঘণ্টা আগেও তারা আমাদের রক্তের জন্য পিপাসার্ত ছিল। কিন্তু মুহূর্তে তারা বদলে যায়। তাদের দেখে মনে হয়েছে, আমাদের প্রতি তাদের যেমন ঘৃণা রয়েছে, তেমনি রয়েছে মমত্ববোধও। আমি তাদের বললাম, ‘বহু রক্ত ঝরেছে। এখন আর অনুতপ্ত হয়ে লাভ নেই। আমরা আমাদের নেতাদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছি। নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রক্তপাতের পথ বেছে নিয়েছেন। রোমান সম্রাটরা যেভাবে মল্লযোদ্ধাদের লড়াই দেখতেন, আমাদের নেতারা ঠিক সেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে এ রক্তপাত দেখে তৃপ্ত হয়েছেন।”

সেদিন রমনা রেসকোর্স ময়দানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতি তৎকালীন উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। উপস্থিত ছিলেন রণাঙ্গণে যুদ্ধ করতে করতে সেখানে হাজির হওয়া তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান লে. জেনারেল সফিউল্লাহ। নিয়াজির আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ বইতে লিখেছেন, “সম্মিলিত বাহিনী প্রধান লে. জেনারেল অরোরাকে যাঁরা সাদর সম্ভাষন জানাতে এসেছেন, এদের মধ্যে লে. জেনারেল নিয়াজি হচ্ছেন সব দৃষ্টির কেন্দ্র। বিষন্ন এবং অবদমিত তাঁর মুখাবয়ব। পরাজিত একজন সেনাপতিকে প্রত্যক্ষ করার মতো এ হচেছ এক অভিজ্ঞতা, এমন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই শুধু পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করেননি, যাঁর রয়েছে আরও এক লজ্জাকর গণহত্যার সদ্য-অতীত ইতিহাসও।

তাঁর পরাজয় শুধু পরাজয়ই নয়, পরাজয়েও একধরনের দীপ্তি আছে- লে. জেনারেল নিয়াজির তা-ও ছিল না। আমি যখন তাঁর দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তখন তাঁর পুরো অস্তিত্ব অবিন্যস্ত এবং সম্পূর্ণ কালিমালিপ্ত আকারে আমার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে।”

লেখক : সদস্য- টেকনিক্যাল (সিনিয়র কমিশনার) এক্সাইজ ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইবুনালের, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে কাস্টমস সদস্য পরিচালনা পর্ষদ, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড  

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর