ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

সংকটে সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক সহযাত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব
আরিফুর রহমান দোলন
আরিফুর রহমান দোলন

সাধারণের বেশে তিনি অসাধারণ। গৃহিণী হয়েও যিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে রেখেছিলেন অনেক বড় ভূমিকা। তিনি একজন শাশ্বত নারী। নাম তাঁর ফজিলাতুন নেছা। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

কী যে তাঁর প্রজ্ঞা—কী তাঁর ধৈর্য! বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছ থেকে যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত—তা হলো তাঁর অসীম সাহস, সবাইকে এক করে রাখার গুণ। প্রতিনিয়ত তাঁর বাড়িতে লোক খাচ্ছে, ঘুরছে। গ্রামের কোন মেয়েটি ভালো লেখাপড়া করছে, তাকে ঢাকায় এনে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া, ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া, সব সামলাচ্ছেন। এর মধ্যেই মেয়েদের কোরআন শরীফ পড়ানো; পাশাপাশি সংস্কৃতি শিক্ষা, নাচ-গান-বেহালা, সবকিছু নিজের সিদ্ধান্তে করছেন। কীইবা বয়স ছিল তাঁর তখন?

বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অপরিসীম ধৈর্য ছিল। ছিল সীমাহীন আন্তরিকতা। তাঁর উদারতাও ছিল আকাশচুম্বী। একদিকে সংসারের হাল শক্ত করে ধরেছেন, সেই ক্ষমতা আর দক্ষতা তাঁর ছিল। বাড়িতে যেই আসত তাকে টেবিলে বসাতেন। পরম যত্নে আপ্যায়ন করতেন এবং সবসময় একটি বিষয় খেয়াল রাখতেন যেন বাড়িতে বেশি বেশি রান্নাবান্না হয়। এ কথাটি অনেকেই বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠরা বলেছেন আবার যারা কম ঘনিষ্ঠ তারাও বলেছেন—বঙ্গবন্ধু জাতির জনক হতে পেরেছিলেন বেগম মুজিবের সীমাহীন সমর্থনের কারণে। বেগম মুজিব কখনোই তাঁকে বলেননি—তুমি রাজনীতি করো না, তুমি জেলে গেলে আমাদের কী হবে! বরং বলেছেন উল্টোটাই—‘তুমি দেশের জন্য কাজ করছো, করে যাও। কখনো পরিবারের কথা আমাদের কথা তোমার ভাবতে হবে না। আমরা যেভাবে আছি এই বেশ আছি’।

বেগম ফজিলাতুন নেছা কী শুধুই একজন সাহসী দক্ষ গৃহবধূ। না, তার চেয়েও অনেক বড় কিছু। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তিনি রেখেছেন। তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ইতিহাস নির্ধারণী ভূমিকা তিনি পালন করেছেন।

১৯৬৯ সাল। শেখ মুজিবকে আটকে রাখা হয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে সমস্ত পূর্ব বাংলা। ওইদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে হচ্ছে প্রচণ্ড আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। আইয়ুব খান তখন দিশাহারা। এই অবস্থায় তিনি ঠিক করলেন গোলটেবিল বৈঠক করবেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে লাহোরে।

এ সময় বেগম মুজিব ভেবেচিন্তে দেখলেন প্যারোলে মুক্তি নেওয়া মোটেও ঠিক হবে না। শেখ মুজিব যদি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে যান তাঁকে অবশ্যই নিঃশর্ত মুক্তি অর্জন করে নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ‘কিছু স্মৃতিকথা’ বইয়ে জানাচ্ছেন, ‘ওই সময় প্লেন রেডি, তখন তেজগাঁও এয়ারপোর্টে। আব্বাকে উঠাইয়া নিয়ে যাবে...আওয়ামী লীগের নেতারাও নেমে পড়েছে এবং সব চলে গেছে ক্যান্টনমেন্টে আব্বাকে যেখানে বন্দি করে রেখেছে ওখানে। মার কাছে খবর আসল। আমি ঢাকা ভার্সিটিতে। মা আমাকে খবর পাঠালেন শিগগির আয়...’।

বেগম মুজিব তাঁর বড় মেয়ে আর জামাতা ওয়াজেদ মিয়াকে পাঠালেন ক্যান্টনমেন্টে। চিরকুট দিলেন। শেখ হাসিনা আর ওয়াজেদ সাহেবকে শিখিয়ে দিলেন কী বলতে হবে। বেগম মুজিবের কড়া নির্দেশ জনগণ তোমার সঙ্গে আছে। তুমি কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নেবে না। তোমাকে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে আসতে হবে। শেখ হাসিনা জানাচ্ছেন, পিতার কাছে মায়ের বার্তাটা পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে নেতারা তাঁকে বলেছিলেন ‘তুমি কেমন মেয়ে বাবার মুক্তি চাও না?’ কিন্তু বেগম মুজিবের সেদিনের পরামর্শ সঠিক বলে প্রমাণিত হলো। জান্তা শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। শেখ মুজিব বেরিয়ে এলেন।

৭ই মার্চ। ১৯৭১। সারা বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। মার্চ থেকেই বাংলা কার্যত স্বাধীন। সবকিছু চলছে আওয়ামী লীগের নির্দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করা হয়েছে। ২ মার্চ ছাত্ররা সেই পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে, তুলে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে। এরই মধ্যে ‘অ্যাসেম্বলি স্থগিতের ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা বারুদে অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছে মাত্র। সারা বাংলা জ্বলছে। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চে ভাষণ দেবেন। কী বলবেন তিনি! ছাত্ররা চায় আজই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করুক আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু আমেরিকানদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তারা সমর্থন করবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনুরোধ করেছেন সবকিছু বন্ধ করে দেবেন না। অপারেশন ব্লিজের পরিকল্পনা আঁটা হয়েছে। রেসকোর্স ময়দানে লাখো লাখো মানুষের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কী করবেন?’

শেখ হাসিনা একই বইয়ে জানাচ্ছেন, “বাসায় গিজগিজ করছে মানুষ। বেগম মুজিব সবাইকে তাদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব আর শেখ হাসিনা। তিনি বললেন, ‘তুমি দশটা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও।” শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘আমি মাথার কাছে বসা। মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন মনে রেখ, তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তুমি তাই বলবা, আর কারো পরামর্শ দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারাজীবন কাজ করো। কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ, কারো কথা তোমার শোনার দরকার নাই। এই মানুষগুলোর জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা।’

বঙ্গবন্ধু দশ মিনিট বিশ্রাম করলেন, গাড়িতে উঠলেন, শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো হেঁটে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন এবং শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি—এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’। একইসঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন। অথচ আইনত কেউ তাঁকে আটকাতে পারবে না। সারা পৃথিবী দেখল শেখ মুজিবের সংগ্রাম আইনানুগ অসহযোগ সংগ্রাম, যা কি না মহাত্মা গান্ধী করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে। পৃথিবীর এরকম কঠিন সময়ে এর চেয়ে রাজনৈতিকভাবে সঠিক ভাষণ আর কেউ কোথাও দিয়েছে বলে মনে হয় না।

এর পেছনে ছিলেন সেই মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

১৯৭১ সাল। ২৩ মার্চ। পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বাংলার ঘরে ঘরে উঠেছে বাংলার পতাকা। এদিকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ও শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ওইদিন বঙ্গবন্ধু দুপুরে কারো সঙ্গে কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, এতদিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে তার ফলাফল কী হলো, কিছু তো বলছো না। তবে বলে রাখি তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করো তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধামতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।’ এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, ‘এখনো আলোচনা চলছে। এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না’। এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরতলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলেন, কারো সঙ্গে কথা বললেন না। এই একটি ঘটনাই কি যথেষ্ট নয় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বেগম মুজিবের অবদান কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল!

জনগণ তোমার কাছ থেকে সরে যাবে তখন সামরিক জান্তা তোমাকে মেরে ফেলতে পারে। কাজেই আপস করো না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব নয় তোমার চাই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুও তাই বলেছেন বারবার, এমনকি নির্বাচনের আগেও, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই। আর যে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে, এটা বঙ্গবন্ধু জানতেন। ঢাকাস্থ আমেরিকান কনস্যুলার কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে সেটা তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন।

মাত্র ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের। তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে প্রাথমিকে পড়ছিলেন। তিনি তাঁর মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন শৈশবে, মানুষ হয়েছিলেন শাশুড়ির কাছে। তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল পড়াশোনার প্রতি। বাড়িতে শিক্ষক রেখে বাংলা-ইংরেজি-আরবি পড়েছেন। প্রচুর গল্পের বই পড়তেন, গানও শুনতেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অধিকাংশ সময় জেলেই কাটিয়েছেন। ছেলে-মেয়ে-সংসার একহাতে সবই সামলেছেন বেগম মুজিব। ছেলেমেয়েদের সুরুচি গড়ে উঠেছে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থেকেই। খুব অল্প বয়সে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। সব সামলেছেন, কিন্তু কারোর কাছে মাথানত করেননি। নিজের ব্যক্তিত্ব ঠিক রেখে সীমাহীন প্রজ্ঞা ধৈর্যের সঙ্গে একে একে সব উৎরে নিয়েছেন।

বাংলার নারীর স্নিগ্ধ রূপ আমরা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের মধ্যে দেখতে পাই, কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে তিনি ছিলেন অপরিসীম দৃঢ়। তিনি যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা ভেবে সত্যিই আমাদের আশ্চর্য হতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁকেও হত্যা করা হয়। নারী জাগরণ কিছুটা হলেও ক্ষণিকের জন্যে থমকে যায় সেদিন। ৮ আগস্ট সেই মহীয়সী নারী, মুক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়িনী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন। চিরস্মরণীয় ও অনুকরণীয় বঙ্গমাতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, কৃষক লীগ; চেয়ারম্যান, সমাজসেবামূলক সংস্থা কাঞ্চন মুন্সী ফাউন্ডেশন ও সম্পাদক, ঢাকা টাইমস

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ



এই পাতার আরো খবর