ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম বসুন্ধরা কিংস
ইকরামউজ্জমান
ইকরামুজ্জমান

শুধু বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের বিগত প্রায় দুইশত বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম ক্লাব ফুটবল সংস্কৃতিতে নতুন একটি স্মরণীয় এবং গর্ব করার মতো অধ্যায় সংযোজিত হতে যাচ্ছে ২ অক্টোবর ২০২৩। এই অবিস্মরণীয় সংযোজন আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষণায় বসুন্ধরা কিংস তাদের ফিফা এবং এএফসি স্বীকৃত আধুনিক অ্যারেনায় প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্লাব (এএফসি কাপ) ফুটবল ম্যাচ খেলবে ভারতের ওড়িশার বিপক্ষে হোম ম্যাচে হিসেবে। 

কিংস অ্যারেনায় আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবলের যাত্রার দিনটি দেশের সচেতন ফুটবল অনুরাগী, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান যিনি তিনশত বিঘা জমির ওপর বিশাল মাল্টিপারপাস স্পোর্টস কমপ্লেক্স তৈরির জন্য অনুমতি দিয়েছেন, যিনি বসুন্ধরা কিংসের ‘ড্রিমার’ এবং ‘মেইন ড্রাইভিং ফোর্স’- আহমেদ আকবর সোবহান, তাঁর সুযোগ্য ক্রীড়াপিপাসু সন্তান সাদাত সোবহান তানভীর, সাফিয়াত সোবহান সানভীর, সায়েম সোবহান আনভীর (শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের চেয়ারম্যান) এবং সাফওয়ান সোবহান তাসভীর (লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবের সভাপতি এবং ক্রিকেটে রংপুর রাইডার্সের চেয়ারম্যান) বসুন্ধরা গ্রুপের সর্বস্তরের সব কর্মকর্তা এবং কর্মচারী, কিংসের খেলোয়াড়, টিম ম্যানেজমেন্ট এবং ২০১৭ সাল থেকে পেশাদারী মানসিকতা নিয়ে সভাপতি হিসেবে ক্লাব পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ইমরুল হাসান ও তাঁর সহকর্মীদের জন্য শুধু আবেগে মোড়ানো নয়- আবীরে রাঙানোও লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের ফুটবলে দিনটি ঐতিহাসিক এবং পুরো সাউথ এশিয়ার সব ক্লাবগুলোর জন্য অনুকরণীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ক্লাবের সভাপতি ইমরুল হাসান বলেছেন বড় স্বপ্ন সবাই মিলে দেখেছি, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। 

দক্ষিণ এশিয়াতে এই প্রথম একটি প্রাইভেট ক্লাব তার নিজস্ব আধুনিক অ্যারেনায় আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবল খেলবে- এটি তো বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য আনন্দ এবং গর্বের বিষয়। বসুন্ধরা গ্রুপ বিশ্বাস করে বাঙালির ফুটবল আবার জেগে উঠবে, হারানো গৌরব ফিরে পাবে। ফুটবল মাঠগুলো আবার প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর হবে। 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে করপোরেট সংস্কৃতিতে মোড়ানো বড় বড় করপোরেট হাউসের তালিকাটি যথেষ্ট বড়। এর মধ্যে অনেক করপোরেট হাউস সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নিয়মিতভাবে ক্রীড়াঙ্গনে পৃষ্ঠপোষণা করছে। কেউ কেউ খ্যাতনামা ফুটবল ক্লাব ক্রিকেট এবং অন্যান্য খেলার ক্লাবগুলোকে প্রত্যক্ষস এবং পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষণা করে। কিন্তু কোনো করপোরেট হাউস বাংলাদেশের বসুন্ধরা গ্রুপের মতো ক্রীড়াঙ্গনের মানোন্নয়নের জন্য মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্স, ক্লাবের নিজস্ব আধুনিক অ্যারেনা নির্মাণের ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেনি। এখাকেই বসুন্ধরা গ্রুপ অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম।  এশিয়ার ফুটবল রাইটার এবং বিশ্লেষকদের সেমিনারে একজন ইউরোপিয়ান ফুটবল বিশেষজ্ঞ বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষণায় মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণ এবং বসুন্ধরা কিংসকে সুস্থ ক্লাব সংস্কৃতির ধারক হিসেবে ‘সিঙ্গেল আউট’ করেছেন। তাঁর কথা হলো- ‘বাংলাদেশের ফুটবলে এই ক্লাবের দায়বদ্ধতা ও অবদান অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। ইউরোপিয়ান বিশেষজ্ঞ তাঁর উপস্থাপনায় আরো উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ পেশাদার ক্লাব হলো বসুন্ধরা কিংস। ইউরোপের ক্লাবগুলোর আদলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে কিংসের অ্যারেনায়’। 

ক্রীড়াঙ্গনে অতীতের আলাদা গুরুত্ব আছে। কিংসের সভাপতি অনেকবার ক্লাবের পুরনো ইতিহাসের কথা আমাকে বলেছেন। নতুন কিছু শুরু করার ভাবনা থেকে বসুন্ধরা কিংস ক্লাবের শুরু। ২০১৬ সালে পাইওনিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন। এরপর ২০১৮-২০১৯ প্রিমিয়ার লিগে খেলতে নেমেই চ্যাম্পিয়ন। এরপর একনাগাড়ে চার মৌসুমে শিরোপা জয়। যে রেকর্ড এ দেশের ফুটবলে আর কারো নেই। 

এক সময়ের খেলোয়াড়, ক্রীড়া প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান সব সময় দেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে ভাবেন, ক্রীড়াঙ্গনকে ঘিরে তাঁর একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং স্বপ্ন আছে। প্রথববার প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয় কিংসের সভাপতি গ্রুপের চেয়ারম্যানের কাছে ক্লাবের প্র্যাকটিসের জন্য সাত-আট বিঘা জমি চেয়েছিলেন। যেখানে গ্রুপ থেকে দেওয়া হয়েছে তিনশত বিঘা জমি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের জন্য। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান শুধু খেলাধুলা ভালোবাসেন না, বোঝেনও খেলাধুলা তাঁর রক্তে মিশে আছে। তাঁর ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এটি অনেক বড় আশীর্বাদ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য। 

স্পোর্টস কমপ্লেক্সের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৯ সালে। কোনো ধরনের সমস্যা না হলে পুরো কমপ্লেক্সের সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এরপর শুরু হবে স্বপ্নের একাডেমির কার্যক্রম। এই একাডেমিতে ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য ইউরোপের তিনটি বিখ্যাত ক্লাব এরই মধ্যে উৎসাহ দেখিয়েছে। একাডেমির কাজ শুরু করার পর আশা করা যাচ্ছে আট থেকে দশ বছর পর বসুন্ধরা কিংস নিজেদের তৈরি খেলোয়াড় নিয়েই দল গঠন করবে, এমনকি বাড়তি খেলোয়াড়ও বিক্রি করবে অন্য ক্লাবগুলোর কাছে।  ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কিংস অ্যারেনায় প্রথম প্রিমিয়ার লিগের হোম ম্যাচ খেলেছে বসুন্ধরা কিংস। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ পুলিশ এফসিকে পরাজিত করেছে ৩-০ গোলে। বিজয় দিয়েই নিজ অ্যারেনায় কিংসের শুরু। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ফাল্গ-নের অপরাহ্নে (তখন ফিফা এবং এএফসি স্বীকৃতি দেয়নি) প্রথম দিনের খেলায় হাফ টাইমের বিরতির সময় বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার উদ্বোধন করেন গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। এরপর ২০২৩ সালের ২ জুন বসুন্ধরা কিংস ও ঢাকা মোহামেডানের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রিমিয়ার লিগের খেলায় দ্বিতীয়ার্ধে উজ্জ্বল ফ্লাড লাইটে খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় কিংস ঢাকা মোহামেডানকে ২-১ গোলে পরাজিত করে। ফিফা ও এফসির স্বীকৃতির পর বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় দল ও আফগানিস্তানের জাতীয় দলের মধ্যে যথাক্রমে ৩ ও ৭ সেপ্টেম্বর দুইটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। চমৎকার ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত প্রথম খেলা গোলশূন্য আর দ্বিতীয় খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছে। ফুটবল অনুরাগী এবং কিংসের সমর্থক ও ভক্তদের জন্য স্মৃতি রোমান্থন। আর এই স্মৃতি তো আনন্দের। 

দেশের ফুটবলে বসুন্ধরা কিংসের আগমন সময়ের দাবিতে এবং প্রয়োজনে। মাত্র পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে মাঠের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে ফুটবল অনুরাগীদের মধ্যে যেভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে ফুটবলকে চিত্তাকর্ষক করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে এটি উল্লেখ করার মতো।’ বসুন্ধরা কিংস শুধু দেশের ফুটবলের প্রেক্ষাপট এবং ধারা পাল্টে দেয়নি। পাল্টে দিয়েছে ফুটবলের গল্প। বাড়িয়ে দিয়েছে ক্লাব ফুটবলের আকর্ষণ।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন



এই পাতার আরো খবর