ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

হেইলিবারি স্কুলে লাভবান হবে বাংলাদেশ
একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার
একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার

হেইলিবারি কলেজ এক সময়ের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের পাঠশালা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দেশে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলায় সেই হেইলিবারি কলেজের ঐতিহ্য ধারণ করা হেইলিবারি পাবলিক স্কুলের শাখা খোলার ক্ষেত্রে আমি নেতিবাচক কিছু দেখি না। ঢাকার আইএসডি নামের স্কুলের খরচও প্রায় কাছাকাছি। বছরে ৩০/৩৫ লাখ। আইএসডির বয়স তো কয়েক দশক হলো। ভালুকায় হেইলিবারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে বিদেশি ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসবেন। এতে সবদিক থেকে বাংলাদেশ লাভবান হবে।

এতে হয়তো শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের আয়-ব্যয়ের উৎসের ওপর সরকারের নজরদারি থাকতে পারে। কিন্তু, বাংলাদেশ তো মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ। এখানে বড়ো ব্যবসায়ী থাকতেই পারেন, যারা এমন ব্যয় বহনে সক্ষম। তারা বৈধ উপার্জনের অর্থ দিয়ে ছেলেমেয়েদের এখানে পড়ালে অসুবিধা কী?

গত কয়েকদিন ধরে হেইলিবারি পাবলিক স্কুল নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। অনেকে আমাকে পেপার কাটিং পাঠিয়েছেন। আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছেন।

আমিই বাংলাদেশে হেইলিবারি কলেজকে/স্কুলকে প্রথম তুলে ধরি।  আমার আগে কোনো অধ্যাপক, গবেষক, আমলা  অথবা লেখক হেইলিবারি কলেজ সম্পর্কে এতোটা বিস্তারিত লেখেননি। আমার লেখা বইতে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। বইগুলো হলো- ১. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ইতিহাস, প্রকাশকাল ২০১৬, প্রকাশক মুক্তচিন্তা, পৃষ্ঠা ২১১- ২৫৬, ২.  মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিস, প্রকাশকাল ২০১৭, প্রকাশক মুক্তচিন্তা, পৃষ্ঠা ১৭১ -২১৮, ৩. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ইতিহাস, প্রকাশকাল ২০২২, প্রকাশক শোভা প্রকাশ, পৃষ্ঠা ২৪০-২৯৫, ৪. মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিস, প্রকাশকাল ২০২৩, প্রকাশক শোভা প্রকাশ, পৃষ্ঠা  ১৯৩-২৫৩।

অনেকের মতে, শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো ভারত উপমহাদেশের অন্য কোনো বইতে একসাথে এতো তথ্য নেই। এ দাবি কতটুকু সঠিক আমি জানি না। তবে বাংলাদেশের অন্য কোনো বইতে এতো তথ্য কারো নজরে পড়েনি।

আমাদের পত্র-পত্রিকা বর্তমান হেইলিবারি পাবলিক স্কুল নিয়ে মাতামাতি করছে এবং দাবি করছে, এটির বয়স ১৬০ বছর। কথা ঠিক। এখন এটির বয়স ১৬১ বছর। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে। তবে এটি যুক্তরাজ্যের রাজকীয় চার্টার বা সনদ বা স্বীকৃতি লাভ করে ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ আগস্ট। এটি এখন নতুন হেইলিবারি হিসেবে পরিচিত।

নতুন হেইলিবারি একটি স্বতন্ত্র, আবাসিক, দিবা এবং কো-এডুকেশন স্কুল। এখানে এগারো থেকে ১৯ বছরের ছেলে-মেয়েদের পাঠদান করা হয়। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে হেইলিবারি স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৭৫০। এদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক ছিলেন আবাসিক শিক্ষার্থী। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাম্পাসে ১৩টি ভবন ছিল। সেগুলোর ৫টি ছিল গার্লস হাউস বা মেয়েদের আবাসিক ভবন। সেগুলোর নাম- ১. কোলভিন হাউস ২. মেলভিল  হাউস ৩. এলেনবাই হাউস ৪. এলবান্স হাউস ও ৫. হেইলি হাউস।

ছেলেদের ৮টি আবাসিক ভবনের নাম- ১. এডমন্সটোন হাউস ২. লরেন্স হাউস ৩. বার্টলি হাউস ৪. ফ্রেই হাউস ৫. কিপলিং হাউস ৬. বেটেন হাউস ৭. থমার্সন হাউস ও ৮. ট্রেভেলিন হাউস।

হেইলিবারি পাবলিক স্কুলের ডাইনিং রুমটি এখনো পুরো ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ ডাইনিং হল। এখানে একসাথে বসে ৭০০ জন মানুষ আহার করতে পারেন। বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এতো বড় ডাইনিং হল নেই। হেইলিবারি পাবলিক স্কুল যুক্তরাজ্যের একটি নামকরা, ঐতিহ্যবাইী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

আমাদের পত্র-পত্রিকার এবং আমার উপরের আলোচনা হেইলিবারির একটি পর্বের। বাস্তবে হেইলিবারির ইতিহাস তিনটি পর্বে বিভক্ত- ১. প্রথম পর্ব ১৮০৬ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ ২. দ্বিতীয় পর্ব ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ এবং ৩.  তৃতীয় পর্ব ১৮৬২ থেকে বর্তমান।

১৮০৬ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৫২ বছর এটি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ। তখন এটির আরেক নাম ছিলো হেইলিবারি কলেজ। তখন এটি ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের পাঠশালা। তখন এখানে ভর্তি হতেন অনেক মেধাবী মানুষ। দুই বছরের প্রশিক্ষণ ও ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারা কোভেনেন্টেড সিভিল সার্ভেন্ট/আইসিএস অফিসার হিসেবে ভারতে আসতেন।

৫২ বছরের আয়ুষ্কালে হেইলিবারি কলেজে ১৯৮৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তার মধ্যে ১৭৫৪ জন ব্রিটিশ ভারতের সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। হেইলিবারি কলেজ এদের সুশিক্ষিত, সুদক্ষ, সুশৃঙ্খল অফিসার হিসেবে গড়ে তোলে। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি হেইলিবারি কলেজ বিলুপ্ত হয়।

দ্বিতীয় পর্বে এটি ছিল ভারত অভিমুখী ব্রিটিশ সেনাদের ডিপো।

তৃতীয় পর্বে এটি পাবলিক স্কুলে রূপান্তরিত হয়। মূল ক্যাম্পাস হয় যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন থেকে ১২ মাইল দূরে হার্টফোর্ডশেয়ারে। সেখানকার ভবনগুলো ১৮০৫-০৬ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি। ভবনগুলো খুবই দৃষ্টিনন্দন। হেইলিবারি কলেজের/ ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন জন লরেন্স। তিনি ১৬ বছর বয়সে ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজের নামজাদা অধ্যাপক ছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাস। তিনি ১৮০৫ থেকে ১৮৩৪ খিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ কলেজে শিক্ষকতা করেন। তখনো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজের শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বেশি ছিল।

শেষ কথা

হেইলিবারি কলেজের সাথে জড়িয়ে আছে ভারতের ইতিহাস। হেইলিবারি কলেজ থেকে পাস করা আমলাদের বিরুদ্ধে ভারতে শোষণ ও নিপীড়নের অভিযোগ ছিল। আবার তারাই উপমহাদেশে শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করেন। এখন ঢাকার আইএসডি অনেক ব্যয়বহুল। এ অবস্থায়  ভালুকায় হেইলিবারি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। 

লেখক : সাবেক সচিব, লেখক ও গবেষক

বিডি প্রতিদিন/এমআই



এই পাতার আরো খবর