ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

অমর্ত্যলোকে মর্ত্যবিষয়ক সম্মেলন
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।

উদ্যোগটা নেন অলরাউন্ডার অ্যারিস্টটল সাহেব নিজেই। গ্রিসের এ পণ্ডিতপ্রবর তাঁর অন্যতম মেন্টর প্লেটোর সঙ্গে সেদিন অমরাবতির তীরে অবকাশ যাপনকালে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জানতে পারেন মর্ত্যরে অনেক লোকালয়ে, জনপদে ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, রাষ্ট্র্র ও সরকার, সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক উৎকোচ এমনকি দুর্নীতি নিয়ে তিনি বা তাঁর শিষ্য সাগরেদরা যেসব মহাজন বাক্যাবলি, ধ্যান-ধারণা, নীতি-নৈতিকতা ও চিন্তাচেতনা রেখে এসেছিলেন অনুসরণের অনুধাবনের জন্য তা বিকৃত হয়ে মনগড়া পথ ও পন্থা জন্ম নিচ্ছে। সেখানকার অনেক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের কল্যাণের নামে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতিপূর্ণ পদক্ষেপ পথ পরিক্রমার জন্য খোদ জনগণই কষ্ট পাচ্ছে। 

অ্যারিস্টটলের এক বীর শিষ্য আলেকজান্ডার মাঝে তাঁকে দূরাভাষে জানান যে, তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না মর্ত্যরে রাজন্যবর্গের ও যুদ্ধবাজদের আদিখেত্যা দেখে। সেখানে সবাই ছলেবলে কৌশলে টিকে থাকতে যত প্রকার ফন্দি ফিকির আছে তা তারা এঁটে চলেন। আলেকজান্ডার তাঁর গুরু অ্যারিস্টটলের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করছিলেন তিনি আরেকবার মর্ত্যে যেতে চান- এসব স্বৈরাচার ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের কিছুটা উপযুক্ত তালিম দিয়ে আসতে। অ্যারিস্টটল সাহেব তাকে নাকি জানিয়েছিলেন, ‘তুমি নিজেও দেখি স্বৈরাচারী আচরণে নিষ্ঠ হচ্ছ। মর্ত্যরে বর্তমানদের বর্তমানের মতো করে চলতে দাও এবং তাদেরকেই মোকাবিলা করতে দাও তাদেরই পরিণতি’। 

তিনি আলেকজান্ডারকে আরও স্মরণ করিয়ে দেন, “তোমার সুনাম-দুর্নাম তুমি নিজে জানতে না- জানতে চাইতে না। দেশের পর দেশ ও জনপদ দখল করে বেড়িয়েছ কিন্তু একটা সাম্রাজ্যে পা রাখতে পারে নাই। শিষ্য সেলুকাশের কাছে ‘সত্যিই বিচিত্র এ দেশ’ বলে ফিরে এসেছিলে। মনে আছে তোমার নিশ্চয়ই, ওই রাতে তোমাকে স্বপ্নযোগে আমি জানিয়েছিলাম- ওখানে ঢুকো না, সেখানে স্বয়ং ভগবানও ভূত বনে যান। আমার ধারণা আমার সে কথায় কান দিয়ে তুমি আর এগোওনি। তুমি সে জনপদে যাওনি এটা জেনে আমি খুশি হয়েছিলাম এটা বড় কথা নয়, তুমি তোমার আদি সুনাম নিয়ে ফিরতে পেরেছিলে এটাই আসল। তোমাকে আমি বলিনি? দেখ একজন নয়টি ভালো কাজ করার পর একটা ভুল বা খারাপ সিদ্ধান্ত নিলে তার আগের নয়টি ভালো কাজ ভেস্তে যায়, শেষের ভুলটি তার জন্য কাল হয়ে যায়। অকৃতজ্ঞ সমাজ ও সময় শুধু ভেদ বুদ্ধি ও স্বার্থ বোধের কারণে চোখ উল্টিয়ে ফেলে, সাদাকে কালো আর কালোকে সাদা করতে সময় নেয় না।” এ পর্যায়ে গুরু-শিষ্য একমত হন যে, মর্ত্যরে বিদ্যমান বিষয়-আশয় নিয়ে অমর্ত্যলোকে বরং একটা গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করা যেতে পারে।

অ্যারিস্টটল প্লেটো ও সক্রেটিসের সঙ্গে অমর্ত্যরে গোলটেবিল বৈঠকের উদ্দেশ্য বিধেয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। মর্ত্যরে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যবস্থার বিবরে এসব বিষয়ে যিনি বা যারা এক সময় তাত্ত্বিক ধারণা, ঘোষণা কিংবা ‘ফতোয়া’ দিয়েছিলেন তারা এ সম্মেলনে তাদের ধ্যান-ধারণার আধুনিক ব্যাখ্যা দেবেন এবং কীভাবে সে সব ধারণা তাদের পূর্বেকার ঘোষণা উপদেশ, নির্দেশনা ও মতামতকে সংস্কার কিংবা পরিবর্তন করা যাবে কিংবা যাবে না তার একটা উপসংহার টানবেন। উপসংহারগুলো সংকলন করা হবে এবং তার সারসংক্ষেপ স্বপ্ন কিংবা কুরিয়ারযোগে মর্ত্যলোকে পাঠানো হবে। গোলটেবিল বৈঠকের বিষয় শিরোনাম হবে ‘মরতে বসেছে গণতন্ত্র’ (ইংরেজি ভার্সনে পড়ুয়াদের জন্য ‘ডেমোক্র্যাসি ইজ ডাইং’)। অন্যত্র অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য সক্রেটিস উপস্থিত থাকতে পারবেন না বিধায় স্বাগত ভাষণ দেবেন অ্যারিস্টটল। এরপর উদ্বোধনী সংগীত (বেশি প্যাঁচালে পর্যদুস্ত ভাষাভাষীদের দেশের) মশহুর গায়ক জগন্ময় মিত্র, যিনি তাঁর চিরজীবী একটি গানের প্যারোডি গাইবেন ‘(গণতন্ত্র)...তুমি আজ কতদূরে’। পাছে এ গানের সুর ও বাণী নিয়ে মর্ত্যে আবার কোনো কলমযুদ্ধ যাতে শুরু না হয়ে যায় সে জন্য এর কথা সুর সংযোগ তদারকি করবেন বিটোফেন, তানসেন ও কাজী নজরুল ইসলাম। অর্কেস্ট্রাতে সত্য সাহা ও আলাউদ্দীন আলী। মর্ত্যে (নিরপেক্ষতার খাতিরে গোলটেবিল বৈঠকে কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের নাম উচ্চারিত হবে না) গণতন্ত্রের হালহকিকত নিয়ে একটি নির্বাহী সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করবেন মর্ত্যরে একটি মশহুর পত্রিকার সাবটাইটেল (‘ডেমোক্র্যাসি ইজ ডাইং’) যিনি প্রথম দিয়েছিলেন সেই ক্যাথরিন গ্রাহাম। 

উপস্থাপনাকে কেন্দ্র করে তিনজন প্যানেলিস্ট তাদের মতামত ও পরামর্শ রাখবেন, তারা হলেন (১) আব্রাহাম লিংকন, যিনি গণতন্ত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা দিয়েছিলেন (২) মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি অহিংস আন্দোলনের রোলমডেল হয়েও সহিংসতায় সংহারের শিকার হয়েছিলেন এবং (৩) প্রথম দুজন প্যানেলিস্টের ভাব শিষ্য- মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। মাস্টার অব শিরোমণি হবেন শিনজো আবে, যিনি মাত্র কিছুদিন আগে অমর্ত্যলোকের সম্মানিত সারথী হিসেবে যোগ দিয়েছেন। ইতিহাস, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, পদার্থবিদ্যা, কূটনীতি, চিকিৎসা শাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞান ও গণিত এ ১০টি বিষয়ে অমর্ত্যবাসী প্রজ্ঞাজনদের মুক্ত আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হবে। মর্ত্যরে প্রায় সব প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে এবং সব কালের প্রতিনিধিত্ব করবেন তারা। বৈঠকে রাজনীতির ওপর অর্থনীতির প্রাধান্য পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকায় সঞ্চালনায় থাকবেন এডাম স্মিথ ও কার্ল মার্কস। বৈঠকে পৌরাহিত্য করবেন চানক্য পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত অর্থশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ কৌটিল্য মহাশয়। বৈঠক শেষে প্লেটো নিজে ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন।

বৈঠকে মুখ্য আলোচক আব্রাহাম লিংকন দুঃখ ও পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করেন মর্ত্যরে অমিত সম্ভাবনাময় একটি দেশ প্রকৃতির বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট হয়েও ইপ্সিত উন্নয়নের পথে যেতে পারছে না। মাথায় উত্তরের বিশাল পর্বতমালা এবং পদপ্রান্তে দক্ষিণে উপসাগর থাকায় কর্কটক্রান্তি রেখায় অবস্থানকারী হয়েও দেশটি মরুভূমি না হয়ে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার বদৌলতে সুজলা সুফলা। অমর্ত্যলোকের অ্যারিস্টটল প্লেটো পিথোগোরাস গংদের কাছে তাই আগ্রহের বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে দেশটি। বিশেষ মূল্যায়নে তারা এটা দেখে উদ্বিগ্ন ও বিব্রতবোধ করছেন যে সেখানে এ পর্যন্ত যতগুলো কর্তৃপক্ষ এসেছে সব সাফল্যকে তারা নিজেদের একক সাফল্য বলে প্রচারে মগ্ন থেকেছে। তাদের মনের মধ্যে সব বয়ানের মধ্যে ‘আমরাই’ সব। আর যে বা যারা যখনই ক্ষমতাবান হয়েছে তারা বৃত্যাবদ্ধ স্বৈরাচারী মনোভাবের শিকলে আটকা পড়েছে। সেদেশের সব মানুষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করলেও ইতোমধ্যে তারা সেখানে পক্ষ-বিপক্ষ নাম দিয়ে নিজেদের নিজেরাই বিভক্ত করে ফেলেছে এবং এটা যেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ‘আমরাই আমাদের শত্রু’। এরা দোষারোপে সিদ্ধহস্ত, নিজের দোষ-ত্রুটির দিকে তাকানোয় নিমরাজি। এখানে ক্ষমতাসীনরা নিজের দোষ দেখতে পায় না আর নাশকতার যত দোষ তাদের বিরোধী পক্ষের। দ্বিতীয় মুখ্য আলোচক করমচাঁদ গান্ধী ঔপনিবেশিক সরকারের আমলের শব্দ ‘নাশকতা’র সংজ্ঞা ও পরিধি চৌহদ্দি পুনঃপর্যালোচনা প্রয়োজন মনে করেন। 

কোনো ব্যক্তি সরাসরি কিংবা হুকুমদাতা হিসেবে রাষ্ট্রের সম্পদ, সম্মানহানিকর কাজ করলে তাকে নাশকতা বলা হবে আর যিনি বা যারা লক্ষ কোটি সহায় সম্পদ পাচার করে দুর্নীতি দ্বারা দেশ ও সমাজকে, দেশের মর্যাদাকে অসম্মানজনক করে তোলেন সে ভূমিকাকেও নাশকতা বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। সভাপতি চানক্য পণ্ডিত এ বিষয়ে সহমত পোষণ করে বলেন, তিনি তার অর্থশাস্ত্রে সাংকেতিকভাবে হলেও এমনটি ইঙ্গিত করেছেন। তৃতীয় মুখ্য আলোচক মার্টিন লুথার কিং আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি তুলে ধরেন- মর্ত্যরে আঁতেলরা, প্রভাবশালী মিডিয়া বুদ্ধি প্রতিবন্ধিত্ববরণ করে যেন তৃপ্তি পায়। আজ যিনি তার গৌরবময় ভূমিকার জন্য নমস্য তার কোনো একটা বেফাঁস মন্তব্যে মুহূর্তের মধ্যে তিনি আস্তাকুঁড়ে নিমজ্জিত হন। চরিত্র হনন মর্ত্য সমাজে নিত্য ঘটনা। আশঙ্কা এই যে, দিনবদলে তাদেরও যে এক সময় এ ধরনের হেনস্তার শিকার হতে হবে সেটা অনেক দেশের অনেকেরই কর্ণকুহরে পৌঁছানো যাচ্ছে না।

এ পর্যায়ে সভাপতির অনুমতি নিয়ে একজন ইতিহাস দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বেত্তা মুক্ত আলোচনার সময় প্রস্তাব রাখেন, মুখ্য আলোচক আব্রাহাম লিংকনের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উক্তি- জনগণের দ্বারা (নির্বাচিত), জনগণের জন্য জনগণের সরকার (ইংরেজি ভার্সনে পড়ুয়াদের বোধগম্যতার জন্য’ গভর্নমেন্ট বাই দ্য পিপল, অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল) গঠনে অনেক দেশে যে বেহাল অবস্থা দেখা যাচ্ছে, যেখানে ভিন্ন মতকে উপেক্ষা করে নিজেরা নিজেদের অবস্থানকে প্রলম্বিত করতে নিজেদের যেভাবে সশস্ত্র সক্ষম করে তুলছে, সেখানে নির্বাচন খেলার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা থাকে না, মহামারি ও বাইরের বড় বড় যুদ্ধের প্রভাবে সেসব দেশে অর্থনৈতিক সংকট দারুণভাবে বাড়ছে বাড়বে সেখানে নির্বাচনের ব্যয়টা সাশ্রয় করে, নিজেদের অন্তঃকলহকে বাড়িয়ে সহায় সম্পদের ক্ষতিসাধনের আত্মঘাতী ক্ষয়ক্ষতি থেকে এবং ভূরাজনীতির দাবা খেলায় নিজেদের মর্যাদা মানসম্মান বিকিকিনির সর্বনাশা থাবা থেকে সবাইকে বাঁচানো সম্ভব হবে। এ সময় দর্শক সারিতে বসা ক্ষমতাধর কয়েকটি দেশের অমর্ত্যবাসী বিদ্বজনেরা (রিচার্ড নিক্সন, উইন্সটন চার্চিল, গর্বাচেভ, চৌ এন লাই এবং সর্দার প্যাটেল প্রমুখ) বিব্রতবোধ করছিলেন। মুক্ত আলোচক তার নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন এ জন্য যে, তার এ প্রস্তাবের জন্য মর্ত্যরে ক্ষমতাধরদের দ্বারা মর্ত্যবাসী তার তস্য আত্মীয়স্বজন সন্তানসন্ততিরা হেনস্তার শিকার হতে পারেন। গোলটেবিল বৈঠকের ঘোষণাপত্রে প্লেটো এ প্রস্তাবটি ভেবে দেখার মতো বলে ছেড়ে দেন।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ



এই পাতার আরো খবর