নতুন বছর ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নানা নাটকীয়তার জন্ম হয়েছিল এ নির্বাচনকে ঘিরে। বিশ্ব মোড়লদের সরবতা দেখে মনে হয়েছিল, সকল দল বিশেষ করে বিএনপি হয়তো এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আর এমন প্রত্যাশা নিয়ে জনগণও আশা করেছিল গণতান্ত্রিকভাবে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে। তবে হ্যামিলনের বাঁশির সুরের মতো কাজ করেনি বিশ্ব মোড়লদের আলাপ আলোচনা। বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। অতএব নির্বাচন হচ্ছে আওয়ামী লীগের নিজেদের ঘরে। যার ফলে আওয়ামী সরকারের অধীনের এ নির্বাচন নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে এক ধরনের দ্বিমুখী-ত্রিমুখী সংকট চলছে। তার কারণ হলো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের ব্যক্তিরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীর লেবাসে আওয়ামী লীগই নির্বাচন করছে। সহজ কথায় বলা যায়, ‘একক চরিত্রে বহুরূপী অভিনয়।’
আর অভিনয়ের কথা বলতে গেলে চোখের সামনে আসে, দেশের বিশেষ কিছু আসনে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা আর খেলোয়াড়দের মুখ। রাজনীতি আর নির্বাচন এখন ধনিক শ্রেণীর বিলাসিতার বস্তু। সাংসদ পদবিটি তাদের দরকার নামের পাশে সমাজের কদর বাড়ানোর জন্য। এখন প্রশ্ন হলো, দেশের রাজনৈতিক দলের ত্যাগী নেতাদের উপেক্ষা করে কেন নির্বাচনে শীতের পাখিদের দিয়ে নির্বাচন করতে হয়? রাজনীতি বলতে এখন একটি মাত্র বড় দল আছে বলেই কি সংসদে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের প্রয়োজন নেই? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে সহজ কথায় বলা যাবে না। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতি পট পরিবর্তনের সাথে সাথে দলগুলোতে ‘জনগণের জন্য রাজনীতি করার’ মানসিকতা হারিয়ে গেছে দলের সত্যিকারের নেতাকর্মীরা। সেখানে জায়গায় করে নিয়েছে বিত্তশালী ক্ষমতাধারী ব্যক্তিরা। আর বর্তমান সময়ে দলের মধ্যে শোবিজের ব্যক্তিদের বিচরণ দেখে মানুষ হতাশ। তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয় সুস্পষ্ট আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের দলের যে ক্ষতি করছে তা বুঝতে হয়তো বা কাঠখড় পোহাতে হবে দীর্ঘ সময় ধরে। নায়িকা-নায়িকা থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তি হয়ে উঠা এতটা সহজলভ্য নয়। আবার তারকাদের দেখলেই মানুষ ভোট দিতে পাগল হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়।
আওয়ামী লীগের ছায়াতলে এসে ধনিক শ্রেণী রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট সাধারণ মানুষের কাছে। তাদের কাছে সাংসদ পদবিটা সুযোগ সুবিধা নেয়ার একটা হাতিয়ার। এর পেছনে যে বিষয়টি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়েছে তা হলো ব্যক্তি স্বার্থের কারণ যারা নির্বাচন করছে তারা জনগণের প্রতিনিধি কোনদিন ছিল না আর আগামীতেও থাকবে না। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে নমিনেশন পেপার কেনার মতো ক্ষমতা দেশের বহু মানুষের আছে, তার প্রমাণ মানুষ পেয়েছে ইতোমধ্যে। সারা দেশ দেখেছে টাকা কিভাবে উড়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর অফিসে। রাজনৈতিক ব্যক্তি সহ সমাজের নানা পেশার লোক গণহারে নির্বাচন প্রার্থী হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে দেশে নৌকা ছাড়া কিছু নেই। সময়ের ব্যবধানে দেখা গেল রাতারাতি ভোল পালটে বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোট পরে নৌকার আত্মজ হয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমেছে অনেকে। শরিক দলগুলোও নৌকা প্রতীক ছাড়া নির্বাচন করতে ভয় পায়। কারণ তারা জানে সঠিকভাবে ভোট যদি জনগণ দেয় তাহলে তাদের পরিণতি কতটা করুণ হবে।
অন্যদিকে ‘যাহা লাউ তাহা কদু’-এমন দশা এখন সারা দেশের নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে। আগামী সংসদে সরকার দল বিরোধী দল বলতে আলাদা আর কিছু যে থাকবে না তা আর বলার পক্ষে রাখে না।আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রকৃত পক্ষে আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী। তাই সাধারণ মানুষ মনে করে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। বরং আওয়ামী লীগের লেবাসে কিছু ব্যক্তি সংসদে আসবে যাদের সাথে জনগণের যোগাযোগ ছিল না কোনকালে। নির্বাচনের প্রচারণাতে এলাকায় যাচ্ছে তারা নতুন রূপে নতুন বেশে। রাজনীতিকে বলা হয়, ‘রাজার খেলা।’ শুধু ভোটের ম্যান্ডেট নিয়ে নৌকার কান্ডারী হলে রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। রাজনৈতিক চিন্তা, ধ্যান ধারণা শুধুমাত্র ভোটের প্রচারণা দিয়ে শিখা যায় না।
কিন্তু বিগত সময়ের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের নতুন কিছু প্রত্যাশা ছিল সাংসদের নিয়ে। উন্নয়নকে চলমান রাখতে হলে আওয়ামী সরকার দরকার। কিন্তু তৃণমূলে নতুন নেতৃত্ব আসবে এ আশা করেছিল মানুষ। কেননা উন্নয়নের সাথে সাথে অনিয়ম দুর্নীতি সহ নানা ক্ষোভ ছিল বিভিন্ন আসনের সাংসদ নিয়ে। তবে এ বিষয়গুলোকে অনেকটাই উপেক্ষা করে প্রার্থী দেয়া হয়েছে দলের নিজের পছন্দমত। বঞ্চিত প্রার্থী নিয়ে হতাশার সুর রয়েছে এলাকাতে। যার কিছুটা আঁচ করা যায় মাঠের রাজনীতিতে। যদিও দল বলছে প্রার্থী যেই হোক কাজ করতে হবে দলের জয়ের জন্য। দলীয় কর্মীদের এ কথা বুঝানো গেলেও জনগণ তা কতটা শুনবে তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। এর কারণ হলো ভোটের সিলের মালিক জনগণ হলেও তাদের মধ্যে ভোট দেবার মানসিকতা নেই। বিশ্বের কাছে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের মানপত্র তৈরি করতে গিয়ে কেবলমাত্র সবাই মিলে ভোটের চড়ুইভাতি খেলা হচ্ছে। শ্রাদ্ধ হবে জনগণের অর্থের। নির্বাচনি প্রচারণার রং বাহারি আয়োজনের সাথে প্রার্থীদের আয়ের উৎস হিসেবে যে হিসাব দিয়েছে তা হাস্যকর বলে প্রতীয়মান। কারণ মানুষ আজকাল সোশাল মিডিয়া সহ গণমাধ্যমের বদৌলতে জানতে পারে প্রার্থীরা কতটা ধনবান । সুতরাং নির্বাচনি ব্যয় দেখে বুঝা যায় কতটা শুভংকরের ফাঁকিতে ভরা এ ভোটের লড়াই।
বিগত নির্বাচনের জের ধরে মানুষ এখনো সুষ্ঠু নির্বাচনের সে আস্থার জায়গাটা পাচ্ছে না। প্রশাসনিক বলয়ে নির্বাচন হবে বলে যে কথাটি বাতাসে উড়ছে তার কিছুটা হলেও প্রমাণ মানুষ পেয়েছে প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের বহু রকমের ঘটনার মধ্যদিয়ে। সার্বিক পরিস্থিতে উন্নয়নের বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ধনিক শ্রেণীর রাজনীতিতে গণতন্ত্র আর জনগণের চাওয়া পাওয়া তেমন করে নেই বলে ভোট নিয়ে হিম হিম শীতের শৈত্যপ্রবাহ প্রতীয়মান এখন পর্যন্ত চলমান। আর এর রেশ ধরে আগামী সংসদে সাংসদরা শক্তিশালী হয়ে জনগণের জন্য যে কথা বলে তার আশা নেই মানুষের কাছে।
জনগণের প্রাত্যহিক জীবনে যে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে তা নিয়ে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশের কাঠামোগত উন্নয়নে উচ্ছ্বসিত হয়ে স্বপ্ন দেখলে গরিবের ঘরে ভাতের যোগান দেয়া যায় না। তাই ধনীদের ভোটের খেলাতে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বরং তারা মনে করে, যার খুশি সে সরকার হোক তাতে কোনো আপত্তি নেই। সরকার শুধু মানুষের জীবন চালানোকে সহনশীল করে দিলেই তারা খুশি। কারণ তাদের কাছে ভোটের অধিকারের চেয়ে ভাতের অধিকারটাই এখন মূল্যবান। অতএব বাজারদর পরিবর্তনটা যে মানুষের মুখে হাসি ফুটাবে তা বুঝতে পারলে উন্নয়নের সরকার সার্থক হবে। অন্য কিছুতে আর চমক আসবে না তা বুঝতে হবে দল ও সরকারকে।
লেখক : কলামিস্ট
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত