ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

স্মৃতিতে একজন প্রাকৃতমনস্ক সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান!
সোহেল সানি
পীর হাবিবুর রহমান

পীর হাবিবুর রহমান, নিশ্চিত করেই জানিয়ে গেছেন, আর ফিরছেন না তিনি। অচেনার আরশে তার অধিষ্ঠান যে অনন্তকালের।পাঁচ ফেব্রুয়ারি ছিলো তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। প্রফুল্লচিত্তের মানুষটির বিদেহী আত্মার প্রতি বিষাদের শ্রদ্ধা, কী অদ্ভুত নিয়তি! আসলে জীবনটাই অস্বাভাবিক বরং মৃত্যুটাই স্বাভাবিক। মৃত্যুই হচ্ছে জীবনের প্রকৃত বন্ধু - প্রাকৃতমনস্ক অবলম্বন। 

পীর হাবিবুর রহমান সাংবাদিকতার কর্মযজ্ঞে অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ সরল ও প্রকাশিত মানুষ। যা বলতেন তা-ই লিখতেন। তিনি অধিকার করেছিলেন, মানবিক ও বীরোচিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।এতোটা অগ্রসরমান ছিলেন যে, সমসাময়িক অনেকের মধ্যেই তা পরিলক্ষিত হতো না।ইতিহাস ও সংবাদ চর্চার মাধ্যমে মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। অসাধারণ এক দূর দৃষ্টিকে অধিকার করে একজন মনস্তাত্ত্বিক লেখক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পাঠকের মনকে জয় করেছিলেন এমনভাবে যে, পাঠকই উন্মুখ হয়ে থাকতেন পীরের পরবর্তী কলামের জন্য।কাছ থেকে দেখে যতোটুকু তাঁকে উপলব্ধি করতে পেরেছি, তাতে সঙ্কোচহীন বলতে পারি- পীর হাবিবুর রহমানের জ্ঞান আহরণেই ছিলো আনন্দ এবং ইতিহাস-চর্চাতেই ছিলো উল্লাস ও আর তা বিতরণেই ছিলো তার শান্তি।

পীর হাবিবুর রহমানের জ্ঞান-চর্চায় আসক্তির কথা উপলব্ধি করতে গিয়ে আমার খুব করে মনে পড়ছে, ড. এনামুল হকের একটি উক্তি। তিনি বলেছেন,"জ্ঞান-তীর্থে স্নাত হলে পুণ্য অর্জিত হয় কিনা বলা যায়না, তবে মন যে মুক্ত, প্রাণ যে উদার, হৃদয় যে বিশাল আর মস্তিষ্ক যে জ্ঞানগর্ভ হয়ে ওঠে, তাতে অপরের না হোক, অন্ততঃ আমার কোনো সন্দেহ নেই।" পীর হাবিবুর রহমানের ক্ষেত্রে এ উক্তিটিই যথার্থ। 

পীর হাবিবুর রহমান নিজেকে 'আপাদমস্তক সাংবাদিক' দাবি করতেন। নিশ্চয়ই তার লেখনীতেই এই দাবিটি সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি ছিলেন সত্যাসত্যই অপ্রতিরোধ্য, 'অকাল মৃত্যু' তাঁকে প্রতিরোধ করেছে। তিনি পরিপূর্ণ নামের আড়াল করে আমাদের বয়োকনিষ্ঠদের কাছে 'পীর ভাই' হয়ে উঠেছিলেন। নব্বই দশকের সাড়াজাগানো দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর উত্থান। তিনি সুখ্যাতির শিখরে পৌঁছেন দৈনিক যুগান্তর, সর্বোপরি বাংলাদেশ প্রতিদিনে অবিরাম কলাম লেখক হিসাবে। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সারথি’তে অবশ্যই আমাদের মধ্যে পূর্ব পরিচয় ছিলো। বর্তমান মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী সম্পাদক থাকা অবস্থায় অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের মুখে পড়েছিলো বাংলাবাজার পত্রিকা। ওই ক্রান্তিলগ্নে দৈনিক সংবাদের তেজস্বী সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় জাফর ওয়াজেদের (বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক) পরামর্শে পীর হাবিবুর রহমান কর্তৃক ডাক পড়েছিলো আমার এবং শাবান মাহামুদের। দৈনিক লালসবুজের পাশাপাশি আমরা তখন সুপ্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ছুটিতে কর্মরত। আমরা দু'জনই তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে অধিষ্ঠিত। ১৯৯৬ সালে আমরা বাংলাবাজার পত্রিকায় যোগদান করলাম। স্মরণ করতেই হয়, সেদিন আমাদের সঙ্গে যোগদান করেছিলো,বন্ধু আবুল বাশার নূরু ও শামীম সিদ্দিকী। 

নুরুও অকালে মৃত্যুকে বরণ করেছে। শামীম সিদ্দিকী বেশ আছে- দৈনিক ইনকিলাব ছেড়ে আলোকিত বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।শাবান মাহমুদ দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রেস মিনিস্টার। শাবান মাহামুদ বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব থাকাকালীন ওই নিয়োগ লাভ করে। পীর ভাই'র অতিভক্ত ছিলো আবুল বাশার নূরু।পীর ভাই'র মৃত্যুতে অঝোরে কাঁদার মিছিলে আমাদের সঙ্গে আবুল বাশার নূরুও ছিলো। দু'বছর আগের কথা - ১৫ মার্চ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। আমি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে শয্যাশায়ী। ছুটে এলো নূরু। আমার হাত ধরে সান্ত্বনার একগাদা বানী শোনালো। বিদায়বেলা অশ্রু সংবরণ করতে পারলো না। আমি কাল আসবো- কোনো চিন্তা করিস না'। বন্ধু নুরুর কথা ফলে গেলো কিন্তু সবটা ফললো না। নুরু আর এলো না। পরদিনই খবর এলো আবুল বাশার নুরু আর নেই। আমি বড়ই দুর্ভাগা, আমি হাসপাতালে চিৎকার করে কাঁদতে গিয়ে চিকিৎসকদের বাধার সম্মুখীন হয়েছি। ওরা প্রাণভরে কাঁদতে দেয়নি আমায়। তারা আমার হৃদক্রীয়া যন্ত্র বিকল হওয়ার ভয় প্রদর্শন করে। বন্ধু নুরুর নামাজে জানাযায় অংশ নেয়ার সুযোগ হয়নি আমার। 

মনে পড়ে, পীর হাবিবুর রহমানের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠানে নুরু ভীষণ করে কেঁদেছিলো। আমিও চোখের জলে ভিজেছিলাম। পীর ভাই'র প্রতি আমার শ্রদ্ধা চিরন্তন। তার দেয়া একটি অ্যাসাইনমেন্টের সুবাদে পেশাগতভাবে আমি একটি বিশেষ সুখ্যাতিলাভ করি। এ জন্য চিরকৃতজ্ঞ।

বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ১৯৯৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ থেকে আজীবন বহিষ্কার হন। ফলে তার সংসদ সদস্য পদও শূন্য হয়ে যায়। এই বহিষ্কারের মূলে ছিলো আমাকে দেয়া বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর একটি সাক্ষাতকার। যেটি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো লিড নিউজ হিসাবে 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তির চু্ক্তির মাধ্যমে দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন' শীর্ষক শিরোনামে। এই অ্যাসাইনমেন্টটি পীর ভাই আমাকে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ বিটের সহযোগী হিসেবে। 

পীর হাবিবুর রহমানের অকাল মৃত্যু ভক্ত অনুসারী ও শুভানুধ্যায়ীদের শোকের সাগরে ভাসিয়েছিলো। রাজনীতিবিদসহ সকল পেশাজীবী বিদগ্ধজনের কাছে অতিপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, লেখনীতে মেধা ও প্রতিভার প্রদীপ্তি ছড়িয়ে। পীর হাবিবুর রহমানের জানাযায় যে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো, তা কোনদিন বিস্মৃতির আড়াল হওয়ার নয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন যেন ভাই হারানোর শোকে চোখে এক নদী জল নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মাইক্রোফোনে পীর হাবিবুর রহমানের আত্মার শান্তি কামনায় কতক স্মৃতি রোমান্থন করছিলেন- আর তখনই অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিলো, অগণিত চোখ। যে চোখের মধ্যে ছিলো, পীর হাবিবুর রহমানের অতিশয় প্রিয় বন্ধু- বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক গুণিমান্য নঈম নিজামের চোখ। 

নঈম নিজাম ও পীর হাবিবুর রহমানের বন্ধুত্ব ছিলো ঈর্ষণীয়।একজন সম্পাদক আরেকজন নির্বাহী সম্পাদক।যেনো পরস্পরের মধ্যে গৌরব - মর্যাদা ও সুখ-দুঃখের বন্টন করে নিয়েছিলেন। আমি ভুলতে পারিনি আজো - সেদিন বাংলাদেশ প্রতিদিন কার্যালয় থেকে সুনামগঞ্জের  উদ্দেশ্য ছেড়ে গেলো বন্ধুর কফিন ভর্তি গাড়িটি। আর কান্নায় সাঁতার কাটা প্রিয়তম বন্ধু নঈম নিজামের দুটো চোখ  অবিরাম অপলক তাকিয়ে থাকলো- নিশ্চয়ই বন্ধুর প্রতি বন্ধুর এ নিদর্শন সেদিন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কোটিপাঠকের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। আমাদের মধ্যে এই বন্ধুত্বের সুমহান মর্যাদা সমুন্নত থাকুক অনন্তকাল।

লেখক: সহকারি সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ



এই পাতার আরো খবর