ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি
হরিদাস ঠাকুর
হরিদাস ঠাকুর

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এটি বাঙালির প্রতি চরমতম নিষ্ঠুরতার এক কালো অধ্যায়। ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে হলোকাস্ট’র পর ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিশ্বমানবতার নৈতিক ও আইনি দায়বদ্ধতায় এ ইতিহাসের যথাযথ স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।

গণহত্যা ও নৃশংসতা সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধ এবং বাংলাদেশ নিজের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকেই তার সাক্ষী। একাত্তরে বাঙালিদের ওপর যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, খুন, ধর্ষণ করা হয়েছিল, তা ১৯১৫ সালে অটোমান তুর্কিদের হাতে আর্মেনীয়, ১৯৭৫ সালের কম্বোডিয়ার গণহত্যা, ১৯৯২ সালের বসনিয়া ও ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় তুতসি জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যার চেয়ে কম ছিল না। এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে ইউরোপে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যাকাণ্ডের চেয়েও ভয়াবহ ছিল মাত্র ৮ মাস ২০ দিনে ৩০ লাখ বাঙালিকে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনা।

১৯৭১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মানবসভ্যতার ইতিহাসে যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার বিপরীতে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ হাজার পাঁচশতেরও বেশি বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, যা গণহত্যার ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড।

১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি এইড শানবার্গ যুদ্ধের পরপর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন, যা ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রকাশ হয়েছিল। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘Bengalis’ Land a Vast Cemetery, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘বাঙালির ভূখণ্ড এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র’।

প্রতিবেদনের শিরোনাম দেখে গণহত্যার ব্যাপকতা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। জাতিসংঘ ‘গণহত্যাবিষয়ক সনদ’-এ যে বিবরণ রয়েছে, তার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতার পুরোপুরি মিল রয়েছে। জাতিসংঘ সনদে বলা হয়েছে, গণহত্যা বলতে বোঝাবে কোনো জাতি বা জাতিসত্তা, বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্যদের অংশবিশেষ বা পুরোপুরি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর মানসিক বা শারীরিক ক্ষতিসাধন করা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাতি বা গোষ্ঠীর ওপর এমন এক জীবনযাত্রা আরোপ করা, যা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে গোষ্ঠীর ধ্বংস ডেকে আনে এবং জাতি বা গোষ্ঠীকে জোর করে অন্য জাতি বা গোষ্ঠীতে রূপান্তর করা।

সনদে আরও বলা হয়েছে, ওপরের যে কোনো একটি অপরাধ সংঘটিত হলেই তা গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। আর তাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের বাংলাদেশীয় দোসরদের হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতেই হবে। ১৯৭১ সালের গণহত্যার ঘটনাগুলো স্পষ্টভাবে নথিভুক্ত, তবু আজও জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়নি। আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের মতো অতীতের ট্র্যাজেডিগুলো যদি অস্বীকৃত থেকে যায়, তাহলে গণহত্যা প্রতিরোধের জন্য জাতিসংঘের প্রচেষ্টা অসম্পূর্ণ থাকবে।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর মাধ্যমে ৩০ লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয় এবং দুই লাখ নারী ধর্ষিত হয়; এক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২৫ মার্চের গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও এর আকাঙ্ক্ষাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার ভয়াবহতা বিষয়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে চাই ১৯৭১ সালের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। সেমুয়েল রোজম্যান ছিলেন একজন পোলিশ একাউন্ট্যান্ট। হিটলারের জার্মান নাৎসী বাহিনী পরিচালিত ট্রেবলিংকা গ্যাস চেম্বারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ এর নুরেমবার্গ ট্রাইবুন্যালে রোজম্যান তাঁর সাক্ষ্য দেন। তিনি সাক্ষ্যে জানান যে, ১৯৪২ এর আগস্ট মাসে, ওয়ারশ ঘেঁটু থেকে তাদের ট্রেনে তোলা হয়। মানুষ ছিল আট হাজার। ট্রেনের কয়েকটি কামরায় তোলা হয় তাদের। গন্তব্যে পৌঁছার পর তাদের নগ্ন করা হয়, তারপর সামান্য জায়গা হাঁটিয়ে ঢোকানো হয় গ্যাস চেম্বারে। হেঁটে যাওয়ার ওই জায়গাটুকুর নাম জার্মান দিয়েছিল- Himmelfahrt Strasse - স্বর্গের পথ। গ্যাস চেম্বারে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে পরিচিত একজন রোজম্যানকে সরিয়ে নিয়ে আসে। কারণ, জার্মানদের একজন অনুবাদক দরকার ছিল। রোজম্যান বেঁচে গেলেন। দুদিন পর দেখলেন আরেক ট্রেনে করে আরো কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে আসা হয়েছে-এদের মধ্যে তাঁর মা, ভাই, বোন, স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে।

রাজম্যান দেখলেন ‘স্বর্গের পথ’ ধরে তাদের গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ। কিছুদিন পর স্ত্রী ও সন্তানের ছবি দেওয়া হলো তাঁকে, শেষ স্মৃতি। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু নৃশংসতার বর্ণনা দিয়েছেন নুরেমবার্গ ট্রাইবুন্যালে প্রদত্ত সাক্ষ্যে। যেমন-(ক) একটি দশ বছরের মেয়েকে ধরে আনা হলো তার ছোট আরেকটি বোনসহ। ছোটটির বয়স দু বছর। দুবছরের বাচ্চাকে ক্রিমাটোরিয়ামের আগুনে নিক্ষেপ করা হলো। আর্তচিৎকাররত বড় বোনকে করা হলো গুলি। (খ) এক বৃদ্ধাকে ধরে আনা হলো তার গর্ভবতী কন্যাসহ। ঘাসের ওপর চিৎ করে ফেলে নবজাতককে বের করে আনা হলো। এবার বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করা হলো- কার মৃত্যু আগে দেখতে চায়। বৃদ্ধা অনুনয় জানালো তাকে আগে মেরে ফেলার জন্য। জার্মানরা ঠিক উল্টো কাজ করলো। প্রথমে নবজাতক, তারপর তরুণী-সবশেষে বৃদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করা হলো। (জেনোসাইড তত্ত্ব তর্ক তথ্য/ হাসান মোরশেদ/ এতিহ্য/রুমি মার্কেট, ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০/ফেব্রুয়ারি ২০১৯/পৃষ্ঠা নং-৬৭)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোজম্যানের সাক্ষ্য থেকে প্রাপ্ত ভয়াবহতার বিপরীতে আমরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার চিত্র তুলে ধরতে পারি। শ্রদ্ধেয় ইমরুল কায়েসের জবানীতে এ ধরনের দুটি ঘটনার তথ্য পাওয়া যায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষে যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত এবং মুক্তধারা প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ নামক গ্রন্থের চতুর্থ সংস্করণে।

প্রথম ঘটনা হলো: ‘মায়ের সন্তান খোঁজা: পাশের একটি গ্রাম থেকে একটি আধা বয়েসী মহিলা প্রায় ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলেন। অবিন্যস্ত বেশবাস, খালি পা, চোখে এক নিদারুণ হতাশার দৃষ্টি। দলের ভেতরে বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন এক এক করে। কিছুক্ষণ মাত্র। তারপর আবার ফিরে গেলেন অর্ধ-দগ্ধ গ্রামটির দিকে। সেই গ্রামেরই অন্য একজন সীমান্ত যাত্রীর কাছ থেকে ঘটনাটা শুনলাম। আগের দিন বিকালে ঘুম পাড়িয়ে তিনি বাইরে গিয়েছিলেন। হঠাৎ মিলিটারি আসে এবং ঘরে ঘরে ঢুকে তারা লুটপাট অত্যাচার চালাতে থাকে। তিনি একটি ঝোঁপের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন। যখন মিলিটারিরা তাঁর ঘর জ্বালিয়ে দেয়, তখন বোধ হয় ঘুমন্ত ছেলের কথা ভেবে তিনি আর থাকতে পারেননি, সম্ভবত বাইরে আসবার চেষ্টা করেছিলেন। মিলিটারিরা তাঁকে দেখে নারকীয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠে। মর্মান্তিক অত্যাচার হয় তাঁর ওপর। অনেক পরে গ্রামবাসীরা যারা ভয়ে সরে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে সেই ঝোপের ভেতরেই তাঁকে অচৈতন্য অবস্থায় দেখতে পায়। এবং তারাই সেবা-শুশ্রুষা করে তাঁকে একটু সুস্থ করে তুলে। প্রথমেই তিনি জানতে চান তাঁর ছেলের খবর। অনেক ছাই এবং পোড়ামাটি সরানোর পর একটি বালকের বিকৃত অর্ধ-দগ্ধ দেহ পাওয়া গেল। তারপর থেকেই তিনি প্রায় অপ্রকৃতিস্থ। তিনি বিশ্বাস করেননি যে, সেই মৃতদেহ তাঁর ছেলের। এবং সেই থেকে অনবরত তিনি খুঁজছেন ছেলেকে। কখনো ছুটে বেরিয়ে আসেন পথে এবং চলমান যাত্রীদের ভেতরে খোঁজেন কিছুক্ষণ, আবার তারপরেই ফিরে যান নির্জন গ্রামের ভেতরে। শূন্য বাড়িগুলোর আনাচে, ঝোপে-ঝাড়ে খুঁজে দেখেন, ডাকেন ছেলের নাম ধরে, যেন সে কোথাও লুকিয়ে আছে, বেরিয়ে আসবে হঠাৎ কোনো আড়াল থেকে। (পৃষ্ঠা নং: ৮৫-৮৬)।

দ্বিতীয় ঘটনাটিও মর্মান্তিক। ‘ভাইয়ের করুণ মৃত্যু’ শিরোনামের ঘটনায় জানা যায়: ১৩ ই এপ্রিল, ১৯৭১। রাজশাহীর সরদহ অঞ্চলের সীমান্তবর্তী নদীর ভেতরে একটি চর। ভীত গ্রামবাসীরা সপরিবারে চলে আসছেন ভারতের দিকে, ভারত সীমান্ত এখনও কয়েক মাইল দূরে। তাঁরা যে গ্রামে ছিলেন সেটা সরদেহের অন্তর্গত হলেও ভেতরের দিকের একটি গ্রাম এবং সেই জন্যই তাঁরা কিছুটা নিশ্চিত ছিলেন। ভেবেছিলেন, মিলিটারিরা হয়তো সরদেহের ওপর দিয়েই চলে যাবে, ভেতরে আসবে না এবং সেই জন্যই তাঁরা পালাননি, গ্রামেই ছিলেন। কিন্তু মিলিটারি এলো এবং যখন এলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। পালাবার পথ বন্ধ। কারণ, চর এলাকা তখন মিলিটারির দখলে। অবশ্য তাঁরা তখনও সেটা জানতেন না। ভীত চকিত গ্রামবাসীরা, আবালবৃদ্ধবনিতা, চিরকালের ঘরবাড়ি ছেড়ে শুধু প্রাণ হাতে নিয়ে পথে নামলেন। চরের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা শুনতে পেলেন তাঁদের গ্রামের ভেতরে রাইফেলের ইতস্তত আওয়াজ। ততক্ষণে লুটপাট শুরু হয়ে গেছে, হৈ হল্লা আওয়াজ ভেসে আসছে এবং কিছু কিছু ঘরবাড়ি জ্বলছে ইতোমধ্যেই। হঠাৎ চরের ভেতরে একটি মিলিটারি ঘাঁটির সামনে পড়ে গেলেন তাঁরা। এই অসহায় শরণার্থী দলের ওপরে পরপর নির্বিচারে গুলি চলল। লুটিয়ে পড়লেন অগণিত নারী, পুরুষ, বালক, বৃদ্ধ এবং শিশু। এই দলের থেকে একমাত্র জীবিত যিনি আসতে পেরেছিলেন তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি পরে মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছেন। তাঁকে জীবিত দেখে যে লোকটি তাঁর দিকে রাইফেল তুলেছিল, তিনি হঠাৎ তাকে অনুনয় করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দুতে বললেন, দেখ, তোমরা তো আমাদের সবাইকে মেরে ফেললে। আমার বাবা মা ভাই বোন সবাইকে। এখন আমিই আমাদের পরিবারে একমাত্র বেঁচে আছি। আমাকে মেরো না, আমাকে ছেড়ে দাও। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের হাবিলদারের কাছে। সেখানেও তিনি অনুনয়-বিনয় করে বললেন। তারপর গুলিবিদ্ধ দেহগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করতে বলা হলো তাঁকে। লোকগুলো এখনো মরেনি অনেকে। অনেকেই যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। তাঁর একমাত্র ছোট ভাইয়ের দেহ তিনি যখন টেনে নিয়ে যান তখন সে কাতর দৃষ্টিতে চেয়েছিল তাঁর চোখের দিকে। তার পায়ে গুলি লেগেছিল। পেট্রল আনা হলো। দেহগুলো সে একাই টেনে স্তূপীকৃত করল এবং তাদের মতলব বুঝতে পেরে জীবিত ছোট ভাইকে সে রাখল স্তূপের নিচে। তারপর আগুন ধরিয়ে দিয়ে মিলিটারিরা চলে যায়। ছেলেটি ভারতে এসে এপার থেকে কয়েকজন লোক নিয়ে সেই রাত্রেই আবার ফিরে যায় চরে। স্তূপীকৃত দেহগুলোর ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে তার আব্বা, আম্মা এবং ছোট বোনগুলোর দেহ। একটি কবর খুড়ে অর্ধদগ্ধ দেহগুলো সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু সে তার ভাইয়ের দেহ খুঁজে পায়নি! সেখান থেকে অল্প কিছু দূরেই তাদের বাড়ি। ছেলেটি তখন মরিয়া। রাতের অন্ধকারে সে তারপর বাড়িতে ফিরে যায় এবং সেইখানে সে তার ভাইয়ের মৃতদেহ আবিষ্কার করে। ঘরের চৌকাঠের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে দেহটা। অতিরিক্ত রক্তপাতে প্রায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এবং সেখানেই মারা গেছে সে। এই বীভৎস স্মৃতি নিয়ে সে তারপর ফিরে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেয়। (প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা নং: ৮৬-৮৭)।

বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংসতার ঘটনা তদন্তে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের অসহযোগিতার কারণে এই কমিটি তাদের তদন্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ করতে পারেনি। পরে ১৯৭২ সালে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত আইনি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা হয়। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই সময় থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি গণহত্যার স্বীকৃতি শুধু দাবি নয়; এটা বাঙালিদের যৌক্তিক অধিকার; আর বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়িত্ব। ইতোমধ্যে একাত্তরে বাংলাদেশিদের ওপরে পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’, আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’ এবং গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স (আইএজিএস)।

১৯৭১ সালের গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জেনোসাইডের একটি। ১৯৭১ সালে যে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছিল, তা করা হয়েছিল এই জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার সব তথ্য-প্রমাণ আমাদের আছে, সেগুলো জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাওয়ার সকল শর্ত পূরণ করে। সুতরাং এই জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য আমাদের দাবি অযৌক্তিক নয়, বরং সময়ের সবচেয়ে যৌক্তিক দাবি।

লেখক : উপসচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় 



এই পাতার আরো খবর