ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

রাশিয়ায় তিন দিনের ভোট দেখা
মুন্নী সাহা

নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল হয়ে গেছে। তিন দিনের ভোট। ১৫, ১৬, ১৭ মার্চ, ২০২৪। রাশিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম। তিন দিন ধরে ভোট। প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন।

আমরা তো শুনিই-নি, অনেক রাশান মনে করতে পারলেন না, আগে কখনো এমনটা হয়েছে কি-না। গুগল করলেই জানা যায়। তবুও মানুষের কাছে সরাসরি জানতে চাওয়ার সুযোগ যখন থাকে, তখন যন্ত্রের চেয়ে মানুষ বড়। তথ্য নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন, তারা অবশ্য নিশ্চিত ডিজিট যেখানে আছে, তাতেই ভরসা রাখতে বলেন। কিন্তু মাঠের সাংবাদিক হিসেবে আমার বরাবরই মানুষেই ভরসা। তাই ভোটকেন্দ্রে যখনই গেছি, তিন দিনে- সাধারণ ভোটারের কাছে জানতে চেয়েছি, “তিন দিন ধরে ভোট!! কেন? আগে হয়েছে? কেমন লাগছে? কি মনে করেন এ ব্যাপারে”?

রাশান জানি না। তাই সঙ্গী জান্নাতুল মিলা। ‘দোব্রেমির’ অনলাইন চ্যানেলের কর্ণধার তাতিয়ানা আলেকসান্দ্রোভনার স্বামী মামুন আহমেদের এর ভাগ্নী। মিলা কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছে। নিয়ম অনুযায়ী রাশিয়ার পড়তে গেলে ভাষাটা পড়তে হয় এক বছর। মিলা রাশান মিডিয়ামেই ওর গ্রাজুয়েশন শেষ করছে। চটপট মেয়ে। মিশুক ভীষণ। আমার বাংলা প্রশ্নের অনুবাদ করতে গিয়ে সাংবাদিকের বডি ল্যাংগুয়েজও প্রায় অনুবাদ করে। ফলে, সাধারণ মানুষ- যাদের কাছে প্রশ্ন রেখেছি সবাই অসাধারণ আন্তরিকতায় জড়িয়ে ধরেছেন, গল্প জুড়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। কেন- কীভাবে তারা ভøাদিমির পুতিনকে ভালোবাসেন। ভোট দিতে আসা মানে তাঁকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ, সেটা বলছেন আমার ক্যামেরার সামনে। ১৫ মার্চ সকাল ১০টার দিকে মস্কো শহরের কোনায় খিমকির একটা স্কুলের ভোটকেন্দ্রে যখন অনেক লোকসমাগম দেখলাম, প্রায় সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি — “মাইনাস ৫ ডিগ্রির শীতের সকালে তো অনেক ভোটার তোমরা এসেছ, কেউ কাজ থেকে-কেউ কাজে যাওয়ার পথে... চাইলে তো আগের মতো এক দিনেই ভোট হতে পারত! কেন তিন দিন?

কোনো মারপ্যাচ না বোঝা সাধারণ মানুষ অঙ্গভঙ্গি করে বুঝিয়েছেন- কী জানি বাপু! আমার ভোট দেওয়ার, আমি ভোট দিতে এসেছি।

সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের তো খবর রাখতেই হয় কোথায় কী হয়। তবে রাশিয়া-চীন নিয়ে আমরা সহজে যেটুকু পাই, তা খানিকটা একপেশে।

যেমন রাশিয়ার রাজনীতি বা ভøাদিমির পুতিনের শাসন নিয়ে আমাদের সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, পুতিন ডিক্টেটর- নানান ছলে-বলে ক্ষমতায় আছেন টানা ২২ বছর। আবারো ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য যে ভোট হচ্ছে তা তো একপেশেই, বা ভয়ডর দেখিয়ে ভোট নিয়ে নেওয়া হবে।

বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার এই পারসেপশনই মাথায়। ফলে- প্রশ্ন করতে গিয়ে এই পারসেপশনের ইঙ্গিতই তো থাকবে, এর বাইরে ভাবার সুযোগ কই?

তবে সশরীরে খোদ স্পটে গেছি বলে, আমার ‘দেখা-শোনা-বোঝা’ একটু অন্য সিগন্যাল দেয়। ভোটের আগের রাতের ভাষণে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, রাশিয়ার জনগণের জন্য বেছে নেওয়ার সময় এটি। আপনারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন, ভোট দেবেন, বেছে নেবেন।

ঢাকায় বসে রাশিয়া টিভি RT বা বিবিসি-সিএনএন-এ এই ভাষণ আর এই লাইন দেখতাম তাহলে নির্ঘাত হাসাহাসি করতাম কলিগরা মিলে। কার থেকে কাকে বেছে নেবে? নির্বাচনে আর প্রার্থীই কই? বা দল কই! ! পুতিন-পুতিন এবং পুতিনই তো সব!

কিন্তু আমি এ ভাষণ শুনছি মস্কোতে, এয়ারপোর্টে। লাগেজ বেল্টের সামনে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার সময়ে। আমার চারদিকে রুশ নাগরিক। টিভির দিকে তাকিয়ে, তাদের দেখাটার মধ্যেই কত শ্রদ্ধা, তা লক্ষ্য করছিলাম।

পরে দোব্রেমির এর তানিয়া, ওর ঘরের টিভিটা চালিয়ে দিয়ে বলল, তুমি RT এর টকশোগুলো দেখো।

“RUSSIA TO CHOOSE” বোল্ড হরফে টিভি স্ক্রিনের ওপর ‘ট্যাগ লাইন’ লেখা। ওই ট্যাগ লাইনে সব টকশো আলোচনা।

ভ্লাদিমির পুতিন আর কি বললেন, কোথায় গেলেন? ভোটের আগের দিনে প্রেসিডেন্টের মুড কেমন... সবই দেখানো হচ্ছে। তবে ব্রডকাস্ট মিডিয়ায় দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের রাজনীতি-মিডিয়াগুলোর নিজস্ব রাজনীতির মারপ্যাচের ভেতর-বাহির জানার অভিজ্ঞতার চোখ আমার যেন অন্য কিছু দেখে...

জোর করে বলানো-করানো এবং নিজের বিশ্বাস থেকে বলা বা করার পার্থক্যটা বোঝা যায়।

প্রতিটি প্রেজেন্টার-হোস্টের চোখে-মুখে এক ধরনের কনফিডেন্স, আবার শংকাও। তাদের প্রেসিডেন্ট যোগ্য প্রার্থী- তাঁকে নিয়ে, তার জেতা নিয়ে শংকা নেই।

তাহলে, ‘ রাশিয়া টু চুজ’ কেন? ভোট তো হচ্ছেই, পুতিন তো জিতবেনই? প্রশ্ন রাখি আমার হোস্ট (পরবর্তীতে বন্ধু হয়ে যাই আমরা) তানিয়ার কাছে।

ও বলল, হ্যাঁ আমরা সবাই পুতিনের ভক্ত। তোমরা বাংলাদেশ থেকে কী শোনো - দেখ জানি না। তবে আমরা মানে, রাশানরা তাঁকে মন থেকে পছন্দ করি। কী রাশিয়াকে উনি কোথায় নিয়ে গেছেন। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে, পাল্লা দেওয়ার মতো লিডারশিপ তাঁর আছে। ইউক্রেন যুদ্ধের নামে আমেরিকা এবং বিশ্ব সংস্থাগুলো আমাদের ওপর এক হাজারের বেশি স্যাংশন দিয়েছে, তবু কিছু কী করতে পেরেছে রাশিয়াকে?

এই disguise কে পুতিনই blessings এ পরিণত করেছেন।

আমার হোস্ট তাতালিয়ানা মানে, তানিয়ার কাছে জানতে চাই, তাহলে ভয় কী? “না, ভয় কিছু না... দেখো না, পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের ভোট নিয়ে কেমন নেগেটিভ প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে” -ও বলল।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হিসেবে যখনই যার যে দেশেই যাওয়ার সুযোগ হয়, সে দেশের ভালো জিনিসের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করি, আর মুখে “ইশ... ইশ” শব্দ করি।

এদেশে সদ্য নির্বাচন দেখার অভিজ্ঞতায় মনে মনে আমি ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ক্যাম্পেইন, টিভিশো, ‘go vote’ “শেখ হাসিনায় আস্থা”... ইত্যাদি নানান ক্যাম্পেইনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজটা রিভিউ করে নিলাম। মিলিয়ে নিলাম ওদের সঙ্গে। মনে মনে তুলনা করার একটা খেলা নিয়ে, নিজেই নিজেকে বললাম- ওকে মুন্নী সাহা- দেখি, কাল থেকে তো ভোট!

ভোটের তিন দিন মস্কোর মেট্রো চড়ে অনেক ভোটকেন্দ্রে গেছি। সবখানেই একই চিত্র। আধাঘণ্টা কি ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে ভিডিও ইন্টারভিউ নিতে নিতে গড়ে অন্তত ১৫/২০ জন দেখেছেই। হয়তো আমি lucky... কারণ রাশান মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স আমাদের যে ওয়েবসাইট দিয়েছে, সেখানে তালিকা- ভোটকেন্দ্র গুনতে আমার দুই দিন লাগত। আমি বলতে চাইছি, ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা, এত্ত এত্ত!

তারপর তিন দিন ধরে মস্কোর নানান মেট্রো স্টেশন দেখতে দেখতে আমি ‘এক টাকার খবরের ‘জন্য নিউজ করলাম মস্কোর কোনায় কোনায় ভোটকেন্দ্র।

নিজেই নিজের খটকা খুলি- হুম, রীতিমতো রাজনীতির নায়ক পুতিন সাহেব সম্ভবত আমার জন্যই এ কায়দা করেছেন... মেট্রো দেখে ভোট কাভার করার! হা হা হা।

ফ্রিডম অব স্পিচ নেই, সারাক্ষণ গোয়েন্দাগিরি, হাতের ডিভাইস থেকে AI দিয়ে ট্র্যাক করা... এমন নানা গল্প শুনি, শুনে গেছি এখান থেকে। পুতিনবিরোধী নেতা নাভালনির মৃত্যু নিয়ে নানান ভয়ার্ত গল্প। কিন্তু আমি আমাদের এক টাকার খবরের নিউজে, যা দেখেছি তাই বলেছি, স্বভাবসুলভ ঠাট্টা-খোঁচার কথাও কম বলিনি। আমার অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড গলায়, রাশিয়ার অ্যাম্বাসেডর নিয়মিত ফলো করেন আমাদের চ্যানেলটি... তবুও কখনো আমি কি বলব, কি বলব না... এমন কোনো রেস্ট্রিকটশনে পড়িনি।

তিন দিনের ভোট দেখার অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক অবজার্ভারদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য সংবাদ সংস্থা ‘তাস’-এর সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলাম। বিভিন্ন দেশ থেকে নির্বাচন কাভার করতে আসা সাংবাদিকদের সামনে, পর্যবেক্ষকদের ওটাই একমাত্র প্রেস কনফারেন্স।

পর্যবেক্ষক দলের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বললেন, দ্রিমিত্রি লারতকিপানিজ, পেদ্রো মউরিনা, মুন ছজউন ইল, রসিও ইমিলিয়েত মেখনিবার তেখাদা এবং অন্দ্রেই ঝুরানকভ।

এ দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সিনথিয়া এন ম্যাকিন্নি। সিনথিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন পার্টির প্রার্থী হয়ে ২০০৮ এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

প্রায় এক ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা কত ভোটকেন্দ্রে গেছেন, কী কী দেখেছেন, ভোটের আগে থেকে তাদের টিম এখানে কী কী পর্যবেক্ষণ করেছেন, সে বর্ণনা দিলেন।

পর্যবেক্ষকদের ওপরও মার্কিন চাপ এসেছে, ভোট ভালো হয়নি... এ কথা বলার।

পর্যবেক্ষকরা বলেন, আমরা পরোয়া করিনি, বরং বলতে চাই “এটি একটি ঐতিহাসিক ম্যান্ডেট- জেনুইন ভোট”।

বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আমি প্রশ্ন করি, জনগণ যাতে ভোট দিতে না যায়, সেটা নিয়ে কি ইন্টারন্যাশনাল ইনফ্লুুয়েন্স লক্ষ্য করেছেন?

আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন দলনেতা, সিনথিয়া ম্যাকিন্নি।

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে ফেইক নিউজ, অপপ্রচার, ভয় দেখানো সবই চলেছে রাশিয়ায়, তোমার বাংলাদেশেও এটা হয়েছে এবারে। তবে পার্থক্য হলো, রাশানরা-মার্কিন বা মার্কিন মদদপুষ্ট কোনো এনজিও, সংস্থা বা বুদ্ধিজীবীদের এই ‘ভোট দিও না’ থিউরি খায়নি। তোমার দেশের মানুষ সহজে লুফে নিয়েছে। বিশেষ করে এই ভোটের প্রতি অনাস্থা অনীহা তৈরি করার ক্যাম্পেইন বাংলাদেশ বা এশিয়ার দেশগুলোর তরুণদেরই মাথাটা গুলিয়ে দিয়েছে।

তোমরা তো মনে কর, এখন ভোট না দেওয়া মানে স্মার্টনেস, রাশানরা মনে করে ভোটই একমাত্র সুযোগ যোগ্য নেতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার।

সংবাদ সম্মেলন শেষে সামনে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন সিনথিয়া। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাস নেন তিনি। তাই বাংলাদেশের তরুণদের চেখে ভোট দেখেছেন। তাঁর মুখস্থ এদেশের কোন দল, কোন নেতা কে কী সবই। রাশিয়ার রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের ভোটের সঙ্গে তুলনা করে আড্ডা দেওয়ার এমন মোক্ষমজন পেয়ে যাব ভাবিনি। রাশিয়ার ঠান্ডায় বাংলাদেশের বুটিক ‘খূত’-এর একটা স্কার্ফ তাঁকে উষ্ণতা দেয়, এ কথা বলতে বলতে তাঁর চোখে মুখে আনন্দ।

চান্স পেয়ে বললাম, তুমি তো জানো এখন ঢাকার রাস্তায় যদি পাঁচজনের সঙ্গে ধাক্কা খাও, তাহলে তা সাড়ে পাঁচজনই ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোনো নেতা। বাংলাদেশ বিরোধী-খাঁটি এন্টি-আওয়ামী লীগ চেতনার সব কর্মী এবার বুকে নৌকা নিয়ে ঘুরঘুর করেছে। ইলেকশন ব্যবসা করেছে।

নেতারা তো জেনেশুনেই তাদের এভাবে ম্যানেজ করেছে? তাইলে “NO VOTE” ক্যাম্পেইন পেল কারা? করলই বা কেমনে?

সিনথিয়া বলেন, NO VOTE, YES VOTE ক্যাম্পেইনে সব একই গ্রুপ। তোমরা নিশ্চয়ই বোঝ। yes vote বলতে গিয়ে তারা NO VOTE সফল করতে পারেনি??? বলো, তুমিই বলো?

কত পার্সেন্ট ভোট পড়েছে এবার বলো? শীত কি এখানকার চেয়ে বেশি ছিল?

আমি হাসতে হাসতে ওর যুক্তি উড়িয়ে দেই। প্রসঙ্গ পাল্টানো সাংবাদিকদের কাজ। বললাম আমার ছোট্ট একটা নিউজ প্ল্যাটফরম আছে, একটা ইন্টারভিউ দেবে?

ইয়েস!! বলে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন তিনি, সঙ্গে আমিও।

সিনথিয়ার কাছে জানতে চাই, আমি কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করেছি পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল। আপনি কি পর্যবেক্ষক হিসেবে এমন কিছু খুঁজে পেয়েছেন? আমি একটা আর্টিকেল পড়েছি, সেখানে লেখা ছিল, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার জনগণকে ভোট না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করছিল। এর পেছনের কারণ কী?

জবাবে সিনথিয়া বলেন, আমি মনে করি নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় মার্কিন হস্তক্ষেপ সম্পর্কে বাংলাদেশিরা খুব সচেতন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে এবং তারা রাশিয়ায়ও এমন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার মতে, এই ধরনের চেষ্টা একটা বিপরীত প্রভাব তৈরি করে। কিন্তু রাশিয়ায় ভোটারের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু যিনি বেশি ভোট পান, তিনি-ই জয়ী হন। এটা মেজরিটির রুল। ৫০+১ হলেই সরকার গঠন করা যায়; এটা কোনো ম্যান্ডেট নয়। কিন্তু রাশিয়ায় প্রথম দিনে ভোট ছিল ৩০ শতাংশের মতো।

একটু শুধরে দিয়ে আমি বললাম, প্রথম দিনে ৩৭ শতাংশ ভোট পড়েছে।

বলার পর সিনথিয়া বলেন, ‘আমি জানি না, আমি আসলে পরিসংখ্যান নিয়ে অবগত ছিলাম না। আমি ঘুরে ঘুরে যা দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলেছি। আমি জানি না ফাইনালি কত পার্সেন্ট পর্যন্ত ভোট হয়, তবে এটা ৮৮ শতাংশের মতো হবে।’

এ সময় মোট ৮৮ শতাংশ ভোটের মধ্যে পুতিন ৮৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, এটুকু যোগ করি আমি।

যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে সিনথিয়া বলেন, ‘আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের এখান থেকে শেখার আছে। রাশিয়া জাদুর মতো কাজ করেছে। তাদের জনগণের ভোট দিতে কোনো ভোগান্তি বা সময় লাগেনি। জনগণ তাদের ব্যবহৃত ডিভাইসের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। আমি মনে করি, এটাই হওয়া উচিত।’

“ইলেকট্রনিক ডিভাইসের কারসাজি তাহলে আছে? আবারও আমার প্রশ্ন।

দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা যখন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ভোট দিই, তখন কারচুপি, জাল ভোটসহ অনেক কিছু ঘটে ডিভাইসের মধ্যে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো। তাহলে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন যে রাশিয়ার নির্বাচনে কোনো কারচুপি বা জাল-জালিয়াতি হয়নি?’

সিনথিয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ফ্লোরিডায় আটকে গিয়েছিল। ফ্লোরিডার ফলাফলের ওপর সিদ্ধান্ত হচ্ছিল বুশ অথবা আল গোর হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন। নানা নাটকীয়তার পর বুশ হোয়াইট হাউসে যান। আল গোর পরাজয় মেনে নেন।

তিনি আরও বলেন, ফ্লোরিডায় আমার এক বন্ধু আছে, সেখানে সে ভোটিং মেশিনগুলো সরবরাহ করেছিল। তখন যা ঘটেছিল তা হলো, ভোটিং মেশিনগুলোর মধ্যে একটি, যেটি পরে সর্বজনীন করা হয়েছিল, মেশিনটি মাইনাস ১৬ হাজার ৯০০ থেকে শুরু হয়েছিল। যার অর্থ হলো, মেশিনটি শূন্যে যাওয়ার আগেই ১৭ হাজার লোককে ভোট দিতে হয়েছিল। সুতরাং জর্জ বুশ জয়ী হননি। অথচ তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে আট বছর পার করেছেন।

পর্যবেক্ষক দলের প্রধান সিনথিয়া বলতে থাকেন... ‘তারপর যখন ট্রাম্প এসেছে এবং এই জালিয়াতি সম্পর্কে বলেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এই সম্পর্কে জেনেছে। এটা শুধু আমি নই, অনেকেই বলেছেন, এই সিস্টেমে কারচুপি হয়। তারপর ট্রাম্প ২০২০ সালে নির্বাচনে জিতেছেন, তিনি তরুণদের আকৃষ্ট করেছেন, তরুণরাও তাকে ভোট দিয়েছেন, কিন্তু সেখানেও কিছু জালিয়াতি ছিল। আমি কংগ্রেসে জো বাইডেনের নির্বাচনি প্রচারণার সময়ও কাজ করেছি। তিনিও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট হননি, জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছেন।’

আমি মোটামুটি ভয় পেয়ে গেলাম! ওম্মাগো কি কয়! মনে মনে আওড়াই, আর মুখে বলি- ‘এটা খুব শক্ত বিবৃতি এবং সত্য সব সময় শক্তিশালী’। জানি না কী হবে প্রচার করলে!

উত্তরে সিনথিয়া-‘আমার মাথার ওপরে যে হেমার পড়বে, তা-ও খুব শক্তিশালী’ আমাকে আমার দেশ আমেরিকা ঢুকতে দেবে তো!!! বলে, হেসে দেন।

জনগণের নেতা সম্পর্কে সিনথিয়ার মতামত কী, জানতে চাইলে সিনথিয়া বলেন, ‘ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ জনগণের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। যিনি এক যুগের বেশি সময় ধরে দোর্দন্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছেন। পশ্চিমাদের নিরন্তর চাপ আর বিরোধীদের টালবাহানাও সামান্য টলাতে পারেনি তাকে।

কারণ তার কাছে জনগণের ভালোবাসা ছিল, জনপ্রিয়তা ছিল এবং তিনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তিনি ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন। আমি তার শেষকৃত্যে ছিলাম। আমি দেখেছি, লাখ লাখ মানুষ কান্না করেছিল তার জন্য। আমি বিশ্বাস করি যদি একজন নেতা তার জনগণকে ভালোবাসেন, তাহলে জনগণও তাকে ভালোবাসবেন। আমি তার ওপর নিবন্ধ লিখেছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম কেন তিনি জনগণের কাছে প্রিয়? এর মূল কারণ ছিল তিনি নিজেকে জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, যদি আপনি নিজেকে জনগণের কাছে নিয়ে যান, আপনি অবশ্যই জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন। এ জন্য আপনাকে আর কারচুপি বা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হবে না। আপনি তাদের কাছ থেকে পুরস্কৃত হবেন, যারা আপনাকে ভালোবাসে।

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪২ শতাংশ কমবেশি লোক ভোট দিয়েছেন। রাশিয়ায় ৮৮ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। তো এই দুই দেশের জনগণকে, ভোটারকে এবং দুই দেশের নেতৃত্বকে আপনি কীভাবে তুলনা করবেন?

এমন প্রশ্নের জবাবে সিনথিয়া বলেন, ‘আমি দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ খুবই কঠোর পরিশ্রমী। আমার মতে তারা অর্থনৈতিকভাবেও সফল। আমি বাংলাদেশে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলাম, কারণ আমি সেখানে শিক্ষকতা করেছি।’ তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এ আইনটির কারণে মানুষকে অনেক বেশি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। আইনটি সংশোধন করার প্রয়োজন আছে।’

বাংলাদেশের মানুষদের উদ্দেশে সিনথিয়া বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে শিক্ষকতা করেছি। আমি জানি বাংলাদেশের মানুষের ইউরো-কেন্দ্রিক মনোভাব আছে। আমার মনে হয়, যদি তারা এটা (ইউরো-কেন্দ্রিক) সেরা মনে করেন, তাহলে তা ভুল। বাংলাদেশের হাজার বছরের একটা সভ্যতা আছে এবং এটা নিয়ে তাদের গর্বিত হওয়া উচিত।

ক্যামেরার সামনে আর বাতচিত বাড়ালাম না। ছবি তোলা, হাসাহাসি আড্ডার সামান্য সময়ও পেলাম দুজনে। সেই আলাপ থেকেই মিলিয়ে নিলাম, আসলে

RT বা রাশান অন্য টিভিগুলোর ট্যাগ লাইনটা কেন Russia to chose?

কেনই বা তিন দিনের ভোট। গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়া চাই, জনগণেরই যে যোগ্য নেতার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা আছে। ৮৮% মানুষ সব বৈরিতা উপেক্ষা করে ব্যালটে বলেছেন, এগিয়ে যাও যোগ্য নেতা, আমরা আছি সুশাসনের পক্ষে”।

সিনথিয়া বললেন, যদি কম মানুষ ভোট দিতো তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অ্যান্টি রাশান জোট নির্বাচন নিয়ে, পুতিনের বৈধতা নিয়ে সহজে প্রশ্ন তুলতো। ভোট কম পড়লে তো প্রমাণিত হতো, ওরা যে সব এনজিওর মাধ্যমে টাকা ঢেলেছে, তাতে সফল হয়েছে। রুশ যুবকরা এন্টি পুতিন হচ্ছে। ফলে রাশিয়াকে বিপদে ফেলার জন্য রাশানদের মাধ্যমে সহজেই ঢুকে যেত...

কম ভোট কাস্টিং, সেটার বৈধতা দিত। এখন তা সম্ভব না।

তবে অন্যভাবে যে সে চেষ্টা হচ্ছে না... তা আমরা কি কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারি?

আসলে ভোট দিয়েই রাশিয়া ‘নো ভোট’ শিক্ষা দিয়েছে।

Russia to choose, এ রাশিয়া বেছে নিল, সবাই মিলে শক্ত-শক্তির রাশিয়া।

লেখক : চিফ এডিটর, এক টাকার খবর



এই পাতার আরো খবর