ঢাকা, বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

দ্রুত এই রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার করতে হবে
আলী হাবিব
আলী হাবিব

চলতি মাসের শুরু থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্য দূর করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি এক পর্যায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে গড়ায়। যখন একটি সমাধানের পথ বেরিয়ে আসছিল, ঠিক তখনই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিনতাই হয়ে যায়। একটি চিহ্নিত রাজনৈতিক অপশক্তি এই আন্দোলন ছিনতাই করে নিয়ে যায়।

কোটা বৈষম্য দূর করার আন্দোলনকে তারা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। এই অপশক্তি কারা? গত সোমবার শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তাদের নাম বলে দিয়েছেন। তারা জামায়াত-শিবির-বিএনপির সন্ত্রাসী। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘২০১৩ ও ২০১৪ সালে যারা অগ্নিসন্ত্রাস করেছে, তাদের অনেককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

আবার জেল থেকে সবাই এসেছে। এবারও যারা করেছে, একই চেহারার। তবে এবার অত সহজে ছাড়া হবে না। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে দেশকে শেষ করছে, আর অনবরত বিদেশে আজেবাজে রিপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।’

আমরা গত এক সপ্তাহের ঘটনাগুলোর দিকে একটু ফিরে তাকাই। কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। একই সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে গত শুক্রবার দুর্বৃত্তরা নরসিংদী জেলা কারাগারের ফটক ভেঙে ৮২৬ জন কয়েদি ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাইয়ের সময় ৮৫টি অস্ত্রও লুট হয়েছে।

দিন যত গেছে, কোটা সংস্কার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সংঘাত পরিস্থিতিতে জীবনহানির পাশাপাশি দেশে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা ক্রমেই ভারী হয়েছে। সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আবার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় অনেক ব্যাবসায়িক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ইন্টারনেটসেবা বন্ধ থাকায় ই-কমার্স খাতের পণ্য বেচাকেনা পুরোপুরি বন্ধ থাকে। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ এবং এ বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রবাহ বন্ধ রয়েছে। মোবাইলভিত্তিক অর্থ লেনদেন এবং মোবাইল ফোনে টাকা ‘লোড’ করা ব্যাহত হচ্ছে। সংঘাতের কারণে স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম এবং শিল্পের উত্পাদনও।   ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বিশেষ করে সেতু ভবন, বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়াম, হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, এক্সপ্রেসওয়ে টোল প্লাজা, মেট্রো রেল স্টেশন, বিভিন্ন থানা, পুলিশ বক্স ও যানবাহনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। মিরপুরে বিআরটিএ ভবন পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। তবে এসবে মোট কত ক্ষতি হয়েছে, তা তাত্ক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের বাইরেও দেশের মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত বৃহস্পতিবার বিটিভি ভবনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর ফলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনটির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে পড়ে।

চলমান কোটাকেন্দ্রিক আন্দোলনে সংবাদের তথ্য সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুরে দুই সাংবাদিকের মৃত্যু হয়। নারায়ণগঞ্জে এক নারী সাংবাদিক মারধর ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আরো দুই নারী সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আক্রমণকারীরা টার্গেট করেছিল নিরীহ মানুষকে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পাঁচতলার ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এভাবে জঙ্গি কায়দায়, নির্বিচারে, অমানবিক প্রতিটি হত্যা প্রমাণ করে এগুলো পরিকল্পিত। সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় যখন পুলিশ-বিজিবি পাঠানো হয়েছে, তখন আক্রমণকারীদের ঠেকাতে গিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। এই হতাহতের দায় কার?

রাজনীতির বড় পরিচয় হচ্ছে জনসংশ্লিষ্টতা। জনগণ কখনো আইনবহির্ভূত কিংবা পেশিশক্তিকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই তাঁরা জনগণের কাছে যাবেন—এটাই কাম্য। কিন্তু আজ আবার দেশের বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে ‘অপরাজনীতি’। কোনোভাবেই এই কাঁটা উপড়ে ফেলা যাচ্ছে না। আর এমন একসময়ে সমস্যা নতুন করে দেখা দিতে চাইছে, যখন বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশ ‘বিনিয়োগ-স্বর্গ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সূচকে সম্মানজনক একটি অবস্থান যখন তৈরি হয়েছে, তখনই আবার দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা চলছে। এই অপশক্তি আজ আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিতে চায়। কী চায় তারা?

পৃথিবী এগিয়ে চলছে। সমকালীন পৃথিবীর সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের এই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে চায় কারা? কারা গণতান্ত্রিক দেশকে আলোর পথ থেকে নিয়ে যেতে চায় অন্ধকারের দিকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথাই যদি ধরি, তাহলে দেখা যাবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সঠিক ছিল—এ কথা বাংলাদেশের জামায়াত-শিবির প্রকাশ্যে এখনো স্বীকার করে না এবং একাত্তরের পক্ষে আজ পর্যন্ত তারা একটি কথাও বলেনি। আমাদের জাতীয় গৌরবের অর্জনগুলো মুছে ফেলতে চায় তারা। বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় যোজন যোজন দূরে, যেখানে সভ্যতার আলো পৌঁছেনি—এমন এক অবস্থানে।

এই রাজনৈতিক অপশক্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ যে আজকের অগ্রগতির ধারায় থাকবে না সেটা স্পষ্ট। রাষ্ট্রদ্রোহী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সবারই আদর্শ ও উদ্দেশ্য এক, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা দেশের ক্ষমতায় যেতে চায়। এটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলি বলে দিচ্ছে এই অপশক্তি  জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। শুধুই কি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি! পাশাপাশি এটা তো সামাজিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। তারা বাংলাদেশকে একটি পশ্চাত্পদ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।

অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে দেশের মানুষকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে গিয়ে গত ৫৩ বছরে অনেক রক্ত ঝরেছে দেশে। সেই রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর সবার আগে উপড়ে ফেলতে হবে রাজনৈতিক অপশক্তির কাঁটা। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন মোটিভেশন। জনগণকে প্রাণিত করতে হবে। জনপ্রতিরোধের চেয়ে বড় কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। এ এক নতুন আন্দোলন, যে আন্দোলনের সূচনা করতে হবে সরকারকে। সেই আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। 

অনেক সমস্যা আমাদের। সমস্যার পাহাড় ডিঙিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি যখন উজ্জ্বল হচ্ছে, তখনই দেশের বিভিন্ন স্থানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে চিহ্নিত রাজনৈতিক অপশক্তি। সরকার এরই মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তিনি এরই মধ্যে কার্যভার গ্রহণ করেছেন।

এক সপ্তাহ ধরে একটি চিহ্নিত অপশক্তি যে কাজ করেছে, সেটা দেশের বিরুদ্ধে লড়াই। সরাসরি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তারা বেছে বেছে সেই সব স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, যেগুলো আমাদের উন্নয়নের প্রতীক। মেট্রো রেলের মিরপুর ও কাজীপাড়া স্টেশন আবার ব্যবহার উপযোগী করতে এক বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। এই দেশবিরোধী রাষ্ট্রদ্রোহী দুর্বত্তরা কি জানে যে একটি পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করতে রাষ্ট্রের কত টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব স্থাপনা নির্মাণে নেতৃত্বের ভিশন লাগে। ভিশনারি নেতৃত্বের মিশনারি সংকল্পই পারে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এই দেশদ্রোহী তথা রাষ্ট্রদ্রোহী রাজনৈতিক অপশক্তির অপতত্পরতা রুখতে তাদের বিচার করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

habib.alihabib@gmail.com

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত



এই পাতার আরো খবর