ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

রক্তিম সূর্যে উদ্ভাসিত গৌরবান্বিত বিজয়
মামুনুর রশীদ

“জানি না আবার কখন লিখতে পারবো। আমাকে লিখো না। সোনার বাংলার জন্য সর্বোচ্চ যা পারো করো।.....” দেয়ালে লেখা একটি চিঠি। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন চিঠিটি লিখেছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম রুমী তার মামা কামাল পাশাকে। স্বাধীন দেশে এরকম বেদনা মিশ্রিত মধুর চিঠি আর কখনও লেখা হয়নি। তবে রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন একটি নাম বাংলাদেশ। রুমীর লেখা শেষ লাইন শুধু মামা পাশা’র জন্য ছিল না। এটি মূলত ১৬ কোটি মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে রেখে গেছেন।

তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করতেই এই চিঠির জন্ম। ২৬ মার্চের ভয়াল রাত থেকে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও বাঙালির হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়াকু সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন অনেক আগে থেকেই জাগিয়েছিলেন 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্রের জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিভাবে লড়তে হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেটা তিনি হাতে ধরে শিখিয়েছেন বাঙালিদের।

ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় ক্রমান্বয়ে তাদের দাঁত ভাঙা জবাব দেওয়ার আগে সুহালে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে জাতির জনকের আহ্বানে ছয় দফা থেকে শুরু করে বিজয় পর্যন্ত বাঙালির হৃদয়ে সর্বদা সংগ্রাম কাজ করেছে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তপাত শেষে পাকিস্তানি নরপিশাচদের আত্মসমর্পণে সক্ষম হয়েছি আমরা।

রুমীর লেখা চিঠির শেষ লাইন “সোনার বাংলার জন্য সর্বোচ্চ যা পারো করো”। এই বক্তব্যটি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্ম এভাবে প্রত্যেকের বিবেক নাড়িয়ে যাবে। এ পর্যন্তই কি শেষ? সোনার বাংলার জন্য আমরা কি করেছি। এখনই থমকে দাড়ানোর সময়। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন ভূ-খণ্ড পেয়েছি। সেই পবিত্র রক্তের পবিত্রতা রক্ষা করতে পেরেছি?

স্বাধীনতার ৪৫ বছর হয়ে গেল। নিজের মায়ের জন্য একবার মূল্যবান সময় দিতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের রঙিন করে তাহলে কী লাভ? সোনার বাংলা পেয়েছি, এখনও নিজের মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছি। কবে আমাদের ঘুম ভাঙবে আর কবে আমরা সুন্দর সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়বো। রক্তের দাগ না শুকাতেই আমরা হারিয়েছি আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টাকে। যার ক্ষতি কখনও পূরণ হবার না।

সামরিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক বৈষম্য থেকে উদ্ধার করে দেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশকে দুর্বল ভেবে স্বাধীনতা বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারপরও বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন আমরা দুর্বল নই। আমরাও পারি। পদ্মা সেতুর কাজ আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই হচ্ছে। ৪৫ বছরে এটাই আমাদের প্রাপ্তি। ১১১টি ছিটমহলের জনতা মুক্তির স্বাদ পেয়েছে এটাও আমাদের বিজয়ের আরেক আনন্দ।

সারা দেশেই শহীদদের রক্তে ভেজা মাটিতে পা রাখার জায়গা নেই। শহীদদের রক্তের ঋণ আজও কাধে নিয়ে অপরাধী হয়ে ঘুরি। যে যুদ্ধের পর দেশটির আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল অর্ধশতেরও বেশি দেশের। বছর ঘুরে এলেই আমরা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের আনন্দে মেতে উঠি। লেখকদের লেখায় প্রস্ফুটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্মৃতি চারণে পান্ডিত্যের সাক্ষর রাখে অনেক পন্ডিত ব্যক্তিরা।

মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছে তাদের অনেকে এখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। আবার অনেকে বিদায় নেবে। স্মৃতি রোমান্থন যা করার সবই করছে প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ। এই প্রবীণগণ মারা গেলে স্মৃতি রোমানথন করবে কী আমাদের মত স্বাধীনতা না দেখা নাবালকরা। তাহলে ইতিহাস তার সঠিক ঐতিহ্য হারাবে বৈ কি।

মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বিতরণ করা হয়েছে। দলিলপত্রগুলো বিতরণ পর্যন্তই শেষ কথা নয়। কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই দলিলপত্র পড়ানো হয়। কয়টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে মুক্তিযদ্ধের এই দলিলপত্র নিয়ে পাঠ চক্র হয়। বা ক’জন শিক্ষক দলিলপত্রগুলো খুলে নিজের জ্ঞান সমৃদ্ধ করেন। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই দলিলপত্রগুলো বাক্স বন্দি করাই রয়েছে।

তাহলে দলিলপত্র করে কী লাভ হয়েছে? প্রতিষ্ঠানে এরকম একটি মূল্যবান জিনিস রয়েছে সেটা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জানে না। মুক্তিযুদ্ধ বস্তা বন্দি করে রাখার জিনিস না। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে। আর এই ১৫ খন্ডের দলিলই তার সঠিক স্মৃতিবাহক। প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অমলিন হওয়ার কথা। আজ ঠিক তার উল্টা ঘটছে।

নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। দেখছে রাজাকার আল বদর আশ শামসদের মত ভয়ংকর রক্তপিপাশুদের যুদ্ধাপরাধের বিচার। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করতে হলে এসব বিকারগ্রস্ত ঘাতকদের কথাও উঠে আসে। এই ঘাতকরা হত্যা করেছে একশ বুদ্ধিজীবীকে। পাক বাহিনী দিয়ে ধর্ষণ করেছে আমাদের সম্ভ্রম। অপমান করেছে আমাদের বাঙালির রক্তকে। তারা খুন করেছে একটি জাতিসত্তাকে, জাতি বোঝার শক্তিকে, পথ চলার আলোকে, অনুভব করার শক্তিকে, তারা খুন করেছে বাঙালির বিবেককে।

রাতের আঁধার ছিন্ন করে ভোরের রক্তিম সূর্যের আলোই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার গৌরবান্বিত বিজয়। বঙ্গবন্ধুর রণমন্ত্রে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয় পেয়েছি। যুদ্ধে শহীদদের রক্তের দাগ, বীরঙ্গনাদের মুখগুলো দেখি পতাকায় ভেসে উঠতে। নমিত হৃদয়ে তাদের প্রতি অভিবাদনের প্রত্যয়ের মুষ্টি বিজয় দিবসে। তবে ৪৫ বছর আগের সূর্যের চেয়ে আজ বিজয়ের সূর্য একটু ব্যতিক্রম। লাখো শহীদের রক্তমাখা, ধর্ষিতা মা-বোনেদের সম্ভ্রমের স্পর্শ নিয়েই আজ বিজয়ের সূর্য।

বিজয়ের দিনে আমরা রক্তিম সূর্যে জাতির জনকের মুখোচ্ছবি দেখতে পেয়েছি? আমরা কি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দাগ দেখেছি ঘুমের মাঝে? যদি সেটা না দেখি তাহলে শহীদের রক্ত আত্ম চিৎকার করছে। কেন আমরা এই রক্তের দাগ বহন করছি না। সেই কলঙ্কের দাগ মুছে ফেলার জন্যই ইতিহাসের সাক্ষি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। গঠন করা হয়েছে একাত্তরের অপরাধীদের বিচারে বিশেষ ট্রাইবুন্যাল। যার মাধ্যমে ইতিমধ্যে কলঙ্কমুক্ত হয়েছে সোনার বাংলা।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষে এবারের বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে। এসময় আমাদের অর্জনকে আমরা ভেবে পারি না। যারা এক সময় ‘বোটমলেস বাস্কেট’ বলেছে। আজ তারাই স্বীকার করতে বাধ্য বাংলাদেশ সকল ক্ষেত্রেই অনেক এগিয়েছে। জাতীয় আয়, প্রবৃদ্ধি, গড় আয়, খাদ্যে পর্যাপ্ততা, নারী উন্নয়ন সূচক, ক্ষমতায়নে আমরা আলোচনার শীর্ষে।

আমাদের এখনও পথ অনেক বাকি। দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে। মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে। সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যার কলঙ্ক দূর করতে হলে সবাইকে একত্রে চলতে হবে। কিছু দিন আগে ভারতের কিছু রাজ্য ভ্রমণ করে জানতে পেরেছি আমাদের দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা। পাশাপাশি তাদের ক্ষোভ! কেন তাদের ভাষাকে আমরা আমাদের ভাষা হিসেবে শিখি না। আমরা কেন তাদের উন্নয়নের অংশীদার হই না!

তাদের বক্তব্যের ব্যাখ্যা করেছি, আমাদের ভাষা পেয়েছি কিছু বীর তরুণের রক্তের বিনিময়ে। স্বাধীনতা পেয়েছি ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ১০ লাখ সম্ভ্রমের বিনিময়ে। এরপরও কিভাবে বলেন আপনাদের ভাষাকে আমাদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে? আমার ব্যাখ্যায় সুচতুর ভদ্রলোক চুপসে গিয়ে বিদায় নিলেন। আমরা ভুলিনি আমাদের শহীদদের শপথ। পরস্পরে কাধে কাধ রেখে লক্ষ্যে অগ্রসর হবো। বাংলাদেশ অপরাজেয়, রক্তিম সূর্যের আলোই অমিত তার শক্তি। তরুণ প্রজন্ম জাগবে সেই শক্তিতে, সোনার বাংলা অগ্রসর হবে। এটি আমাদের আত্মপ্রত্যয়। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।   

 

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

বিডি প্রতিদিন/৯ ডিসেম্বর ২০১৬/হিমেল



এই পাতার আরো খবর