ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বৈরী সময়ে সাহিত্য চর্চায় বিশ্ব
প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাস মহামারী পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকেই অবরুদ্ধ করেছে। এক সংক্ষিপ্ত সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই অবরুদ্ধ অবস্থায় মহাদুর্যোগপ্রসূত মানসিক চাপ থেকে কিছুটা পলায়নপর অব্যাহতি লাভের জন্য মানুষ মহামারী বিষয়ক সাহিত্যকর্ম এবং চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কেউ কেউ বর্তমান সময়ের বাস্তব করোনা মহামারীর মতো কল্পিত দৃশ্যগুলি পড়তে বা দেখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে, আবার কেউ কেউ পূর্ববর্তী মহামারীগুলোর সময়কার বাস্তব জীবনের বিবরণ থেকে ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার পথের হদিসের জন্য উন্মুখ হয়ে বাস্তব জ্ঞানের সন্ধান করছে। তবে ইতিহাস এবং কথাসাহিত্য বা ফিকশনের মধ্যে ঘটনার এক বিশাল তফাৎ সমবসময়েই পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে গত মহামারীর সময়কার যে ভয়ঙ্কর ট্রাজেডি এবং সে ট্রাজেডির বর্তমান সময়ের রহস্যোদঘাটনকারী চলচ্চিত্রায়নের মধ্যে যে অভাবিত তফাৎ তা রীতিমতো হতাশাব্যঞ্জক। প্রকৃতপক্ষে, মনোবিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে করোনা মহামারীর এই দুর্যোগের সময় মহামারী সম্পর্কিত বিষয়য়াদিতে বিনোদনের অন্বেষণ অবরুদ্ধ অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই মহামারীর সময়ে সাহিত্যচর্চা বা চলচ্চিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করার পেছনে যুক্তি আছে, যদিও বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ এবং নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভরশীল।

হোমারের ‘ইলিয়াড’ এবং বোকাসিওর ‘দি ডেকামেরন’ থেকে শুরু করে স্টিফেন কিং-এর ‘দ্য স্ট্যান্ড’ এবং লিং মা'র ‘সেভারেন্স’ পর্যন্ত পশ্চিমা সাহিত্যে যে সমস্ত মহামারী সম্পর্কিত গল্প-উপন্যাস-মহাকাব্য রয়েছে – তাতে জনস্বাস্থ্যের সংকটের সময় মাহামারী প্রশমনে মানুষ কীভাবে সাড়া দেয় এবং কীভাবে প্রচণ্ড আবেগকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে সম্পর্কিত বিস্তর নির্দেশনা পাওয়া যায় বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ বা ৮০০ সালে ‘ইলিয়াড’ রচিত হয়েছিল এবং ‘প্লেগ’ শব্দটি ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যেই প্রথম ব্যবহৃত হয়। বলা বাহুল্য, পশ্চিমা সাহিত্য আজো ‘ইলিয়াড’-এর প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি, এর রচনা কৌশল, চরিত্রচিত্রন এবং ঘটনাবলীর উপস্থাপন এমনই বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয় যে তা এককথায় অনবদ্য।

‘ব্লাক ডেথ’ মহামারীর পরপরই ১৩৫১ সালে জিওভানি বোকাসিও রচিত ‘দি ডেকামেরন’ মাস্টারপিসটি ১০০টি গল্পের সংগ্রহ বিশ্বসাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এই গল্পগুলিতে মহামারীর সময়ে ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে ১০ জন অভিজাত নর-নারীর প্লেগ থেকে মুক্তি পেতে পালিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

১৯৪২ সালে আলবার্ট কামু রচিত ‘দি প্লেগ’ উপন্যাস প্লেগের মতো মহামারীতে সামাজিক সমস্যা বিশেষ করে আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্নতা এবং এর প্রতিরোধে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দিকেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। এই উপন্যাসে কামু কঠোর অথচ নিশ্চিত বঞ্চনার সঙ্গে মানুষের অজ্ঞতা যে সমাজকে সবার অজান্তে কোথায় তলিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অংকন করেছে।

১৯৭৮ সালে স্টিফেন কিং রচিত ‘দি স্ট্যান্ড’ উপন্যাসেও কামু রচিত ‘দি প্লেগ’ উপন্যাসের কিছুটা ছায়া পরিলক্ষিত হয় তবে প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই উপন্যাসে আমেরিকান কোন সামরিক ঘাঁটি থেকে ‘প্রজেক্ট ব্লু’ নামের বায়োইঞ্জিনিয়ার্ড সুপারফ্লু ভাইরাস অবমুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এক টুইটার বার্তায় স্টিফেন কিং বলেছেন, করোনা মহামারী অবশ্যই তার কল্পিত মহামারীর মতো গুরুতর নয় তবে সবারই যুক্তিসঙ্গতভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

২০১৮ সালে ঔপন্যাসিক লিং মা তার ‘সেভারেন্স’ উপন্যাসে কাল্পনিক ‘শেন ফিভার’ নিয়ে মহামারী আক্রান্ত নিউইয়র্ক সিটিকে কেন্দ্র করে অনেকটা বাস্তবসম্মত সমস্যার সফল চিত্রায়ন করেছেন। এখানে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত মানুষটির অটোম্যাটনের পুনরুজ্জীবন হতেই থাকে এবং উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ক্যাণ্ডাসি নিউইয়র্ক সিটিতে তার কাজের জায়গায় ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নোবেল বিজয়ী কলাম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর ‘লাভ ইন দি টাইম অফ কলেরা’ একটি কালজয়ী প্রেমের উপন্যাস। বিশ্বের অন্যতম খ্যাতিমান লেখকের ১৯৮৫ সালের এই ক্লাসিক প্রেমের উপন্যাসটি গভীর প্রেমের পাশাপাশি হতভাগ্য প্রেমিকাদেরকেও চিত্রিত করে। উপন্যাসটিতে কলেরাকে মহামারী হিসেবে না দেখিয়ে এটিকে রূপকার্থে ব্যবহার করা হয়েছে কারণ স্পেনিশ ভাষায় অসুস্থতাকে আবার ভাবাবেগও বলা হয়, যা এই উপন্যাসের মূল ভাষা। নিউইয়র্ক টাইমস্ এটিকে “একটি আলোকোজ্জ্বল ও হৃদয়বিদারক উপন্যাস হিসেবে এখন পর্যন্ত বলা সেরা প্রেমের গল্প” হিসেবে অভিহিত করেছে। কিন্তু এই উপন্যাসে মূলত কোন মহামারীর উল্লেখ নেই। কাজেই বইয়ের শিরোনাম অনেক সময় বিভ্রান্তিকরও হতে পারে তবে এটি একটি চমৎকার সাহিত্যকর্ম তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই উপন্যাসের কথা বলতে গিয়ে মার্কেজ নিজে বলেছেন, ‘আমার ফাঁদে না পড়ার জন্য আপনাকে অত্যন্ত সাবধানী হতে হবে’।  উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়নও হয়েছে।

বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, অবরুদ্ধ অবস্থায় সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনে অনেকটা সীমিত পছন্দ নিয়েই খুশি থাকতে হচ্ছে পাঠকদের। এক্ষেত্রে নতুন পাঠকের ক্ষেত্রে সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম, কারণ ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেক ই-বুক বা পিডিএফ সংস্করণ তারা পেয়ে যাচ্ছে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ বা ঝানু পাঠক আগেই পড়েছেন। সমস্যা তাই অভিজ্ঞ পাঠকের একটু বেশি। ইন্টারনেটের যুগে সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে বিনামূল্যে খুব কমই মূল্যবান ও সমসাময়িক সাহিত্য সংকলন বা পুস্তকের দেখা মেলে। একান্ত বাধ্য হয়েই অনেকে আমাজন বা অন্যান্য সোর্স থেকে বই ক্রয় বা রেন্ট করেন যা প্রকারান্তরে পাঠককে আর্থিক চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। অনেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের নির্ভরযোগ্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনে নামমাত্র মাসিক ফি দিয়ে সাবস্ক্রাইব করে বই বা মানসম্মত সারগর্ভ আর্টিকেল পড়ে কিছুটা পুষিয়ে নিচ্ছেন কিন্তু একথা অনস্বীকার্য ভালো সাহিত্যকর্ম এখনো সহজলভ্য নয়। বই ক্রয়ের তেমন বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি।

অন্যদিকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুন লেখকের দেখা মিলছে কারণ অবরুদ্ধ অবস্থায় সৃষ্টিশীলতার দিকে অনেকেই ঝুঁকে পড়ছেন। সেক্ষেত্রে নবীন লেখকের লেখার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে তবে তার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ না জানানোর কোন কারণ নেই। একথাও অনস্বীকার্য সৃষ্টিশীল কাজের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং অন্তহীন রসদের যোগানদার হচ্ছে সাধ্যমত অধ্যয়ন। অধ্যয়নের ক্ষেত্রে কোন শর্টকাট রাস্তা নেই। লেখার ক্ষেত্রে, ইন্টারনেটের এই ডিজিটাল যুগে মনে রাখতে হবে, সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে লেখার প্রচুর রসদ যোগাড় করা যেতে পারে তবে অন্যান্য অগণিত লেখক-পাঠকও কিন্তু একইভাবে লেখার রসদ যোগাড়ে ব্যস্ত। এমনও হতে পারে, যে প্রসঙ্গ নিয়ে লেখার প্রস্তুতি নিয়ে একজন লেখক ভাবছেন, কাকতালীয়ভাবে সেই একই প্রসঙ্গ নিয়ে অন্য আরেকজন লেখকও ঠিক একইভাবে ভাবছেন এবং ইন্টারনেটের বদৌলতে একই সোর্সের উপর নির্ভর করছেন। অর্থাৎ শুধুমাত্র ইন্টারনেটের উপর নির্ভর করে লেখা এখনকার যুগে অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ লেখা এবং গবেষণায় ‘প্লেজারিজম’ অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য। সৃষ্টিশীল কাজের জন্য উপযুক্ত রেফারেন্স ব্যবহার করা সততারই পরিচায়ক এবং তা শিক্ষা ও সাহিত্যের অগ্রগতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

জীবন বিশ্বাস কুইন্স, নিউইয়র্ক

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর