ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

জাতীয় শিশু দিবসের প্রত‍্যাশা
শিশুরা বেড়ে উঠুক মুক্ত পরিবেশে
কৃষিবিদ বশিরুল ইসলাম
বশিরুল ইসলাম

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজ যারা শিশু, কাল তারাই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। আজ যারা বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, একদিন তারাও শিশু ছিল। তেমনি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও সায়ারা খাতুনের ঘর আলোকিত করে এদেশে জন্ম নিলে একটি ফুটফুটে শিশু। বাবা-মা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’। নানা শেখ আবদুল মজিদ নাতির নাম রাখলেন শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়া থেকে শুরু করে সারা দেশের প্রতিটি আনাচা-কানাচে ঘুরে, খোকার বাড়ি হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। আর খোকা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু এবং সব শেষে জাতির জনক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি।

বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা, নিকটজন ও বিভিন্ন লেখকের ভাষ্যে বঙ্গবন্ধুর শিশুপ্রীতির কথা আমরা জানতে পারি। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি যখন সবার বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন তখনও তিনি শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। শিশুদের কোনো সমাবেশে গেলে কিংবা শিশুরা গণভবনে তার কাছে আসলে, তিনি শিশুর মতো তাদের সঙ্গে মিশে যেতেন, মজা করতেন। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৭ মার্চ জন্মদিনকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করা হয়। 

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, গভীর ভালোবাসায় শিশু বান্ধব পরিবেশে আগামী প্রজন্মকে সুশিক্ষিত করতে পারলেই গড়া যাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। কিন্তু শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন পূরণে আমাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আমার লেখনি মাধ্যমে চেষ্টা করব উত্তর খুজতে। 

টুঙ্গিপাড়ার সাধারণ এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা যেমন বর্ণিল, তেমনি চমকপ্রদ ছিল। বঙ্গন্ধুর তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভাল অবস্থান ছিল।” ‘হাডুডু’র ভাল খেলোয়াড় শেখ মুজিব’ এই এক নামে টুঙ্গিপাড়ায় তার খুব পরিচিতি ছিল। 

বঙ্গবন্ধু শৈশব যেমন ছিল উন্মুক্ত ; তেমনি আমাদের প্রজন্মের শৈশবও ছিল উন্মুক্ত। স্কুলব্যাগ কী জিনিস, চিনতাম না। গুটিকয়েক বই বগলদাবা করেই স্কুলে যেতাম। বৃষ্টি নামলে গায়ের শার্ট খুলে কিংবা পলিথিন ব‍্যাগে বইগুলো পেচিয়ে বুকে ধরে বাড়িতে ফিরতাম। এভাবে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বড় হয়েছি দেখেই সহজে জ্বর হতো না আমাদের। শুধু জ্বর নয়, অন্য অসুখ-বিসুখও কম হতো। কিন্তু সামান্য রোদ-বৃষ্টিতেই জ্বর-সর্দি বাঁধিয়ে ফেলে আমাদের সন্তানেরা। এর কারণ, বাইরের মুক্ত পরিবেশে তাদের খেলাধূলা করার সুযোগ আমরা করে দিতে পারছি না। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ‍্য কন্যা শেখ হাসিনার এক লেখায় বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তার ভালো লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তার কথামতো যা বলতেন তাই করত।’

বতর্মান যুগের শিশুরা বিশেষ করে রাজধানীর ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে ঠিক উল্টো পথে।আধুনিক অনেক সুযোগ-সুবিধা পেলেও তারা আসলে নানা দিক থেকে বঞ্চিত। জন্মের পর চার দেয়ালে বন্দী তাদের জীবন। স্কুল শুরু হলে সেখানেও ঘেরা কংক্রিটের দেয়াল। যেন বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার একটা শূন্যতা। কিন্তু এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সন্তানরা বেছে নিচ্ছে প্রযুক্তি পণ্য। কম্পিউটার-মোবাইল গেমস আর টেলিভিশনের কার্টুন কেড়ে নিচ্ছে খোলা পরিবেশে বেড়ে ওঠার মানসিক বিকাশের সুযোগ। 

এরকম পরিবেশ তৈরি হবে না কেন? শহরে যে রয়েছে খেলার মাঠ ও খোলা জায়গার অভাব। শিশুদের নিরাপত্তা ব‍্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা। আর যেটুকু খেলার মাঠ রয়েছে তাও আবার দখল-দূষণে প্রায় পরিত্যক্ত। সম্প্রতি, এ সংক্রান্ত একটি সোশ্যাল মিডিয়া ভিডিওতে এমনই চিত্র ফুটে উঠেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, দুটি শিশু অপরিচ্ছন্ন মাঠে নিজেদের মতো করে খেলাধুলা করছে এবং সেখানে থাকা নোংরা কাগজপত্রকেই খেলার অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই দৃশ্য একজন বিবেকবান মানুষকে নিশ্চয়ই আহত করে। ডেটল-হারপিক পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ এর করা এই বিজ্ঞাপনে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য একটি সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন খোলা পরিবেশের প্রয়োজনীয়তার কথাই উঠে এসেছে।

আমরা গ্রামে বড় হয়েছি। কোথায় খেলতে চলে গেছি বাবা মা ততটা খোঁজও রাখতো না। বিকাল হলে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলতে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া চলে যেতাম।  মাঠ না পেলে কোন কৃষক ধান কেটে জমিটা ফেলে রাখলে সেখানেই খেলা চলতো। আর প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটতো সাঁতার কেটে। চোখ লাল করে বাড়ি ফিরে মায়ের কিছুটা চোখ রাঙানি কতটা মধুর ছিল। আর আজকাল শহরের ছেলেরা সাঁতারতো জানে না। তাহলে শিশুর মাঝে স্বতঃস্ফূর্ততা আসবে কিভাবে? সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার সংস্পর্শে আসার তাদের সুযোগ কোথায়। একটি বদ্ধ খাঁচায় তারা বেড়ে উঠছে। কিভাবে তবে গড়ে উঠবে তাদের উদার ব্যক্তিত্ব আর মানসিকতা।

জাতিসংঘের শিশু সনদে বলা হয়েছে, শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের উপযোগী পরিবেশ রক্ষা ও সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। জাতীয় শিশুনীতি ও শিক্ষানীতিতেও শিশুর বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য অনেক কথা বলা হয়েছে। অথচ বাস্তবে হচ্ছে উল্টোটা। সুযোগ সৃষ্টি তো হচ্ছেই না, যেটুকু সুযোগ আছে, তা-ও রক্ষা করা যাচ্ছে না। না আছে খেলাধুলা বা শরীরচর্চার সুযোগ, না আছে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ। বিদ্যা অর্জন বা বিকশিত হওয়ার জন্য সুস্থ দেহ ও সুন্দর মন দু’টিই জরুরি। তাহলে আমাদের শিশুরা কি সুস্থ ও সুন্দরভাবে বিকশিত হচ্ছে? উত্তর ইতিবাচক হওয়ার অবকাশ খুবই কম। বিশেষ করে নগর-মহানগরের শিশুদের বিকাশ যে কাঙ্খিত পর্যায়ে হচ্ছে না, তা আজ স্বীকৃত সত্য। 

জাতির পিতার দেখানো পথে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে হবে, ভালোবাসতে হবে। তাহলে তারাও ভালোবেসে এ দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শিশু-কিশোরদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুদের মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ (বিশেষ ক্রোড়পত্র, তথ্য মন্ত্রণালয়-১৭ মার্চ ২০১৯)। জাতির পিতা শৈশব-কৈশোর থেকেই হেসে-খেলে, বাঁধনহারা আনন্দে, মুক্ত বাতাসে, মুক্তমনে বেড়ে উঠেছেন। আমাদের শিশুরা যাতে এ ধরনের পরিবেশ পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই।

লেখক: উপ-পরিচালক

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়



এই পাতার আরো খবর