ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

কীভাবে এল রক্তের গ্রুপ?
অনলাইন ডেস্ক
প্রতীকী ছবি

রক্তের গ্রুপ হল রক্তের লোহিত কণিকায় অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি। এটি বংশগতভাবে নির্দিষ্ট করা থাকে। অ্যান্টিজেনের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে রক্তের বিভিন্ন ধরনের গ্রুপিং সিস্টেম করা হয়েছে।

রক্ত গ্রুপিং পদ্ধতি প্রথম আবিষ্কার করেন অস্ট্রিয়ান শরীরতত্ত্ববিদ কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার। তখন তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজিকাল-অ্যানাটমিক্যাল ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। ১৯০০ সালের দিকে, টেস্টটিউবে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের রক্ত একত্রে মিশ্রিত করে তিনি খেয়াল করলেন, রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। শুধু মানুষই নয়, মানুষের রক্তের সাথে অন্য প্রাণীর রক্ত মেশালেও একই ব্যাপার ঘটে।

এ বিষয়ে তিনি লেখেন-  ‘সুস্থ মানুষের রক্ত থেকে নেওয়া সিরাম কেবল অন্য প্রাণীর রক্তকেই জমাট বাঁধিয়ে দেয়, তা নয়। অন্য ব্যক্তির রক্তও জমাট বাঁধিয়ে দেয়। প্রতিটা মানুষ জন্মগতভাবে আলাদা হওয়ার কারণে এমনটা হয়, নাকি কোনো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হয়, তা খতিয়ে দেখার দরকার।’

পরের বছর, তিনি খেয়াল করেন, একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির রক্ত কেবল নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধাচ্ছে।

এই পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে তিনি মানুষের রক্তকে- A, B এবং C নামে তিনটা গ্রুপে ভাগ করেন। তিনি দেখান, A গ্রুপের রক্ত B গ্রুপের রক্ত জমাট বাঁধিয়ে ফেলে। কিন্তু A গ্রুপের রক্ত একই গ্রুপের অন্য ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধায় না। একইভাবে B গ্রুপের রক্ত A গ্রুপের রক্ত জমাট বাঁধায়।

C গ্রুপ খানিকটা আলাদা। A ও B- উভয় গ্রুপের রক্তই C গ্রুপের রক্ত জমাট বাঁধায়। এটাই ছিল ল্যান্ডস্টেইনারের আবিষ্কৃত রক্ত গ্রুপিং পদ্ধতি। এই আবিষ্কারের জন্যে ১৯৩০ সালে মেডিসিনে নোবেলটা তার ঝুলিতেই ওঠে।

পরে C গ্রুপের নাম জার্মান অনা (Ohne) শব্দের প্রথম বর্ণ অনুসারে O রাখা হয়।

জার্মান অনা (Ohne) মানে ‘কিছুই নয়’ কিংবা ‘শূন্য’। এরপর ল্যান্ডস্টেইনারের দুই ছাত্র আদ্রিয়ানো স্টারলি এবং আলফ্রেড ফন ডেকাস্টেলো চতুর্থ আরেকটি রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার করেন। তারা এর কোনো নাম দেননি। তাদের মতে, এই গ্রুপ কোনো নির্দিষ্ট ধরনের রক্তের গ্রুপের মধ্যে পড়ে না। আরও পরে এর নাম রাখা হয় AB। 

১৯০৭ সালে, চেক সেরোলজিস্ট জান জানস্কি সর্বপ্রথম মানুষের রক্তের চারটা ধরণ শনাক্ত করেন। স্থানীয় একটা জার্নালে প্রকাশিত হওয়া একটা গবেষণাপত্রে তিনি রোমান হরফ I, II, III ও IV দিয়ে চার ধরনের রক্তকে নির্দেশ করেন। এখানে I, II, III ও IV যথাক্রমে  ল্যান্ডস্টেইনারের  O, A, B, এবং AB-কে নির্দেশ করছে। 

১৯১০ সালে আমেরিকান শরীরতত্ত্ববিদ উইলিয়াম এল মস প্রায় জানস্কি’র একই উপায়ে রক্তের শ্রেণীকরণ করেন। ভদ্রলোক জানস্কি’র পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু তার শ্রেণীকরণে জানস্কির IV এবং I উল্টে I এবং IV হয়ে গেছে। এখানেই বাঁধে বিপত্তি। রক্তের দুটো ভিন্ন শ্রেণিকরণ তৈরি সংশয়। মসের পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রে। অন্যদিকে জানস্কি’র পদ্ধতি প্রচলিত হয়ইউরোপের দেশগুলোতে আর পাশাপাশি আমেরিকার কিছু দেশে। 

রক্তের শ্রেণিকরণ করার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীজুড়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে একটা শৃঙ্খলা আনা। কিন্তু এখানে শৃঙ্খলার পরিবর্তে উল্টে তৈরি হল বিশৃঙ্খলা। ১৯২১ সালে সংশয় দূর করতে এগিয়ে আসে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ইমিউনোলজিস্ট, সোসাইটি অব আমেরিকান ব্যাকটিরিওলজিস্ট এবং অ্যাসোসিয়েশন অব প্যাথলজিস্ট এবং ব্যাকটিরিওলজিস্ট- নামের তিন সংগঠন। জানস্কি’র পদ্ধতিটাকেই প্রাধান্য দেবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তারপরেও সমস্যা রয়ে গেল। যেসব দেশে মসের পদ্ধতি প্রচলিত, তারা জানস্কি’র পদ্ধতি অনুসরণ করেনি।

ছয় বছর পর ল্যান্ডস্টেইনার, জানস্কি আর মসের পদ্ধতির পরিবর্তে  O, A, B, এবং AB ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় O গ্রুপ নিয়ে। আগেই বলেছি, এই গ্রুপের নামকরণ করেছিলেন ল্যান্ডস্টেইনার নিজেই। কিন্তু এই নাম দিয়ে আসলে কি ‘শূন্য সংখ্যা’ নাকি ‘কিছুই না’ বোঝানো হচ্ছে সেটা পরিষ্কার ছিল না। ১৯২৮ সালে দ্য পারমানেন্ট কমিশন অন বায়োলজিক্যাল স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন ল্যান্ডস্টেইনারের প্রস্তাব অনুযায়ী জানস্কি’র I, II, III, IV কে 0, A, B, AB আর মসের IV, III, II, I-কে O, A, B, AB দিয়ে প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই শ্রেণিকরণ পুরো বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। 

১৯২৮ সালে ল্যান্ডস্টেইনার এবং ফিলিপ লেভিন একসঙ্গে, এমএন সিস্টেম, পিএন সিস্টেম নামে আরও দুটো রক্ত গ্রুপিং পদ্ধতির প্রচলন করেন। সেপ্টেম্বর ২০২২ অবধি, তেতাল্লিশ রকমের রক্ত গ্রুপিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সবগুলোর মধ্যে ল্যান্ডস্টেইনারের এবিও (ABO) ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেমই সবচাইতে বেশি প্রচলিত। 

মানুষের রক্তের লোহিত রক্তকণিকা কোষের পর্দায় থাকে বিভিন্ন রকম শর্করা। এই শর্করাগুলোই মূলত অ্যান্টিজেন হিসেবে কাজ করে। আর এই অ্যান্টিজেনের ধরনের উপর ভিত্তি করেই ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম কাজ করে। 

ABO ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেমের পেছনেও আছে লোহিত রক্তকণিকায় থাকা এরকম তিন ধরনের শর্করা অণু। প্রতিটার গঠনেই বিভিন্ন মনোস্যাকারাইড জোড়া লেগে তৈরি হওয়া স্যুগার চেইন থাকে। ভিন্ন ভিন্ন রক্তের গ্রুপে স্যুগার চেইনের শুরুতে থাকা মনোস্যাকারাইড গ্রুপটা ভিন্নরকম। A গ্রুপের স্যুগার চেইন এর শুরুতে থাকে এন-এসিটাইলগাল্যাক্টোসামিন (N-acetylgalactosamine-GalNAc)। B গ্রুপে সেটা গ্যালাক্টোজ  (Galactose-Gal)। অন্যদিকে O গ্রুপের ক্ষেত্রে স্যুগার চেইনের শুরুতে কিছুই থাকে না। আর যাদের রক্তের গ্রুপ AB, তাদের রক্তে টাইপ A এবং টাইপ B উভয় রকমেরই স্যুগার চেইন থাকে।

প্রশ্ন হল, ভিন্নভিন্ন রক্তের গ্রুপের স্যুগার চেইনের প্রথম গ্রুপটা ভিন্ন হওয়ার কারণ কি? এর পেছনে আছে একটা এনজাইম এর কারসাজি। এর নাম গ্লাইকোসাইলট্রান্সফারেজ। লোহিত রক্ত কনিকার স্যুগার চেইনের মাথায় মনোস্যাকারাইড যুক্ত করার কাজটা করে এই এনজাইম। এই এনজাইম তৈরি হয় নির্দিষ্ট কিছু জিন থেকে। গ্লাইকোসাইলট্রান্সফারেজ এনজাইম তৈরির জিনের অবস্থান মানুষের ৯ নং ক্রোমোজোমে। এই জিনের তিনটা ভিন্ন ভিন্ন ধরণ রয়েছে- A, B, O।

রক্তের গ্রুপিং নির্ভর করে মূলত গ্লাইকোসাইলট্রান্সফারেজ এনজাইম এর জন্যে দায়ী জিনগুলোর ওপর। কার রক্তের গ্রুপ কী হবে সেটা নির্ভর করছে ব্যক্তির ক্রোমোজোমে উপস্থিত গ্লাইকোসাইলট্রান্সফারেজ এনজাইমের জিনের ধরনের ওপর। জিনের ধরনই ঠিক করে দেয় এই এনজাইম লোহিত রক্তকণিকার স্যুগার চেইনে কোন শর্করা যোগ করবে। 

আগেই বলেছি, O গ্রুপের রক্তে স্যুগার চেইন এর শুরুতে কিছুই থাকে না। তাহলে কি এই গ্রুপের ব্যক্তির দেহে গ্লাইকোসাইলট্রান্সফারেজ এনজাইম থাকে না? 

বিষয়টা মোটেও তা নয়। এদের শরীরেও এই এনজাইম তৈরি হয়। সমস্যাটা মূলত এনজাইম তৈরির জিনে। বিবর্তনের ধারায় এদের গ্লাইকোসাইলট্রান্সফারেজ এনজাইম তৈরির জিনে মিউটেশন ঘটেছে। ফলে এনজাইমের গঠন পরিবর্তিত হয়ে যায়। যে কারণে এনজাইমটা ঠিকঠাক মতন কাজ করতে পারে না। তথ্যসূত্র: এনসিবিআই

বিডি প্রতিদিন/আজাদ



এই পাতার আরো খবর