ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

অন্য চোখে
ভয়ে আতঙ্কে আমারও পেট পোড়ে
সামিয়া রহমান

খুব ছোটবেলায় ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য বাসায় একটি মেয়ে এসেছিল। মেয়েটি সারা দিন হাসিমুখে কাজ করত আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই  কাঁদতে বসত। একদিন না পেরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি এত কাঁদো কেন? মেয়েটির উত্তর ছিল, আমার বাড়ির জন্য পেট পুড়ে। আমারও না পেট পোড়ে। আমার দেশের জন্য আমার পেট পোড়ে। ভয়ে পেট পোড়ে, আতঙ্কে পেট পোড়ে। চারদিক থমথমে। একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর হামলা হচ্ছে। গত বত্রিশ মাসে ব্লগার, প্রকাশকসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়েছে। রাতের আঁধারে, দিনের প্রকাশ্য আলোয়। শুধু এ বছরই খুন হয়েছেন পাঁচজন। গণমাধ্যম বলে, গোয়েন্দা সংস্থারও আশঙ্কা আরও মৃত্যু হবে। এই নভেম্বরেই নাকি আরও মৃত্যু দেখব আমরা। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছিল অধ্যাপক লেখক হুমায়ুন আজাদকে। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী সংসদে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বইটি ব্যানের ঘোষণা করে এবং তার ওপর ব্লাসফেমি আইন জারির দাবি করে। ২০০৬ সালে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-এর কমান্ডার র‌্যাবের কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার দায় স্বীকার করে। সেই শুরু। অবশ্য এর শুরু আরও আগে ১৯৭১ সালে। দেশের স্বাধীনতার অস্তিত্বে অবিশ্বাসীরা বারবার আঘাত হেনেছে মুক্তচিন্তার ওপর। অবশ্য ইস্যুটি এখন আর শুধু মুক্তচিন্তায় থেমে থাকেনি। দেশ বিভাজিত হয়ে গেছে আস্তিকতা আর নাস্তিকতায়। একদল ঘোর ধর্মান্ধ, উগ্রপন্থি আর একদল ঘোর অবিশ্বাসী। দুই এর রেষারেষিতে সবাই বিপণ্ন। ব্লগার মানেই নাস্তিক তকমা দিয়ে যাকে তাকে নৃশংস খুন এখন জায়েজ। প্রতিটি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে একটি মামলারও বিচার শেষ হয়নি। এখন পর্যন্ত একাধিক মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। র‌্যাবের মহাপরিচালক বলেন, প্রতিটি মামলার তদন্ত হচ্ছে, কিছুই হচ্ছে না এটি মিডিয়ার বাড়াবাড়ি প্রচার। মিডিয়া সেনসেশন তৈরি করছে। আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা সেনসেশন তৈরি করছি কিনা জানি না। কিন্তু আনসারুউল্লাহ বাংলা টিম আমাদের মতো গণমাধ্যমের নগণ্য নারী কর্মীদেরও হুমকির মধ্যে রেখেছে। আমাদের দোষ আমরা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বলি, আমরা নারী হয়ে বেপর্দা চলি। শিক্ষক হয়ে হুমকির আতঙ্কে থাকি, নারী হয়ে ধুলায় লুটিয়ে পড়ার হুমকিতে থাকি। হুমকি, ধমকি, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা আমাদের ঘরবন্দি করে ফেলছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেন, আইন দিয়ে এই সংকটের সমাধান হবে না। নাগরিক সম্পৃক্ততা দরকার। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংকট আদর্শের, সংকট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। আইনের নয়। কিন্তু অভিযোগ ওঠে বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধীদের এতটাই বেপরোয়া করে দিয়েছে যে, ওরা গোপন থেকে প্রকাশ্যে যে কোনো স্থানে এমনকি ঘরের মধ্যে খুন করে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বলেন, বর্তমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী দিয়ে এই জঙ্গিদের ধরা সম্ভব নয়। এর জন্য বিশেষায়িত বাহিনীর প্রয়োজন। অথচ বিশেষায়িত বাহিনী নামেই ২০০৪ সালে পুলিশের মধ্যে একটি এলিট ফোর্স হিসেবে র‌্যাবের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। র‌্যাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর র‌্যাবের হাতে এ পর্যন্ত একহাজার চৌষট্টি জন জঙ্গি ধরা পড়েছে যার মধ্যে জেএমবির সংখ্যাই ছয়শ’র অধিক। তারপরও হামলা বন্ধ হচ্ছে না, মৃত্যু কমছে না। মৃত্যু শুধু এখন মুক্তচিন্তার মানুষের মধ্যে থেমে থাকেনি। পুলিশও এর শিকার হচ্ছে মর্মান্তিকভাবে। বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ সহিংসতার সময়ে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে বহুবার। তাদের মাথা থেঁতলে দেওয়া থেকে শুরু করে হত্যা করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য থাকা সত্তে¡ও পুলিশের চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে পুলিশকে হত্যা করে পালিয়ে যায় জঙ্গিরা। তিনজন মোটরসাইকেল আরোহীর আক্রমণে পাঁচটি চাইনিজ রাইফেল হাতে থাকা আমাদের পুলিশ সদস্যরা জঙ্গিদের নিবৃত্ত করতে পারে না। পুলিশ হত্যা হয়, আক্রান্ত হয়, পালিয়ে যায় শালবনে। গণমাধ্যমে খবর আসে রাইফেলে গুলিই নাকি ছিল না। সামনে অত্যন্ত প্রভাবশালী দুই যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা মুজাহিদের আপিল বিভাগে রিভিউয়ের রায় হওয়ার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের রায় বানচালের লক্ষ্যে সন্ত্রাসীরা মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে। দুই বিদেশি হত্যা, পুলিশ খুন, তাজিয়া মিছিল প্রস্তুতিস্থলে বোমা হামলা, ব্লগার-প্রকাশক হত্যা- ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লগার হত্যাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করতে চান, কিন্তু তিনি এও বলেছেন, সবকিছুর আদি উৎস জামায়াত। এরা কখনো জেএমবি, কখনো হরকাতুল জিহাদ, কখনো আনসারুউল্লাহ বাংলা টিম নামে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। সরকারের অভিযোগের তীর বিএনপির দিকে আর বিএনপির অভিযোগ বরাবরের মতো আওয়ামী লীগের দিকে। এ দেশে ব্লেম গেমের রাজনীতি দুষ্টচক্রের মতো চলছেই। এই ব্লেম গেমের রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়িতে জঙ্গিবাদ আরও প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে। জঙ্গিবাদের উৎস নিয়ে, প্রসার নিয়ে চায়ের টেবিলে, মাঠে ময়দানে, টকশোর পর্দায় জোর আলোচনা চলছে। দেশে আইএস আছে কি নেই এক ধোঁয়াশার মধ্যে আছি আমরা।

সরকারের বিরুদ্ধে নিষ্পৃহতার অভিযোগ আসে। অভিযোগ আসে অতিকথনের। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করা এই সরকারের যেমন সবচেয়ে বড় সাফল্য, তেমনি প্রশ্ন আসে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে অতি ক্ষমতাবান যুদ্ধাপরাধীরা যে তাণ্ডব শুরু করবে সে ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি কেন ছিল না? সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ব্লগার হত্যায় সরকার কেন নীরব থাকে? জঙ্গিদের বক্তব্য মুক্তমতের নামে ব্লগাররা ধর্মকে অবমাননা করছে। সরকারও ব্লগার বিষয়ে একই ধরনের চিন্তা পোষণ করে কি না সেই প্রশ্ন এখন সবার সামনে। আমার দেশের জন্য আমার পেট পোড়ে। সরকার বলে দেশ স্বাভাবিক আছে। আমি দেখি অদ্ভুত নীরবতা। কিছুটা আতঙ্কে, কিছুটা জীবিত মানুষ হওয়ার তাগিদে মৃত্যু নিয়ে মাঝে মাঝে শোরগোল তুলি। যদিও দিন চলে যাচ্ছে দিনের নিয়মে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। একতরফা বক্তৃতায় ছাত্র-ছাত্রীদের বিভ্রান্ত করি। স্কুলে বাচ্চাদের আনতে যাই। সেখানে নারী বন্ধুরা একটি বাক্যে দেশ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে চলে যায় শাড়ি, গয়না, রান্নার আলাপে। সেই গল্পেও অংশ নেই স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে। দেশ তো স্বাভাবিকই আছে। রাতে টকশো’র টেবিলে জবাবদিহিতার তুমুল ঝড় তুলি। দেশ, সমাজ, জাতি উদ্ধার করে, সরকারকে তুলোধনা করি। কিছুই উদ্ধার হয় না। পেটপুরে ভাতঘুম দিয়ে সুবিধাবাদী নাগরিক জীবনের আরও একটি রাত পার করি। ওদিকে রাতের অন্ধকারে, দিনের প্রকাশ্য আলোয় মরতে থাকে অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, নীল, অনন্ত, দীপনরা, আমাদের রক্ষা করার জন্য পুলিশ সদস্যরা। রাজনীতি বলে এ প্রতিপক্ষের চাল। হুমকিদাতা জঙ্গিরা বলে হিজাব পরে বন্দী হও, মুখে কুলুপ আঁটো। আর কত মুখে কুলুপ আঁটলে, আর কত মৃত্যু, কত হামলা আর নৃশংসতা হলে এই হত্যার উৎসব বন্ধ হবে? আমি এই আতঙ্কের শহরে থাকতে চাই না। পালাতেও চাই না। চাই না স্বেচ্ছায় বন্দী হতে। চাই না মৃত্যু নিয়ে সংবাদের উৎসব করতে। আমার ছোট বাচ্চাটা বলে, মা তুমি আর কাজ করতে যেও না। ওদের বিরুদ্ধে কথা বলো না। বাবা বলেন, কী দরকার আমার টকশো’তে এত খোঁচাখুঁচি করার, এত প্রশ্ন করার? একাত্তর-এর সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুভাই বলেন, ধর্ম নিয়ে যৌক্তিক অযৌক্তিক কোনো প্রসঙ্গই তুলো না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বলে সতর্ক থাকুন। এত না না, এত সতর্কতা, এত নৃশংসতার মধ্যে আমি এবং আমরা কি বেঁচে আছি? আমার বাড়ির সেই মেয়েটির মতোই আমার মন পোড়ে, পেট পোড়ে একটু শান্তির জন্য, স্বস্তির জন্য, দেশ নামক প্রিয় বাড়িটার জন্য।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, একাত্তর টেলিভিশন।

বিডি-প্রতিদিন/০৮ নভেম্বর, ২০১৫/মাহবুব

 



এই পাতার আরো খবর