ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

দিল্লির চিঠি
খেলা যুদ্ধের বিকল্প নয়, সূক্ষ্ম এক সৌন্দর্য ফোটানোর শিল্প
এম জে আকবর

পচতে থাকা ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটের নিমজ্জন আশঙ্কা রুখে দেওয়ার যৌক্তিক সমাধান একটাই : খেলাটাকে চরম বিরক্তিকর করে দাও, যাতে কেউই আর ওটা নিয়ে মাথা না ঘামায়। দৃষ্টান্ত তো আমাদের আছেই। মানে হকি।

অনেক, অনেক দিন আগে একটা সময় ছিল যখন অলিম্পিক কিংবা এশিয়ান হকির সোনার পদক জেতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত খেলতে নামলে গোটা উপমহাদেশ উত্তেজনায় কাঁপত। প্রথম স্থান অর্জনের পরিবর্তে শেষ স্থান কব্জা করার জন্য উভয় দেশ যে-ই গুঁতোগুঁতি শুরু করল অমনি সব আবেগ উত্তেজনার হাওয়া বেরিয়ে গেল। এখন ক্রিকেট সম্বন্ধীয় বিতর্ক কেন তীব্র হয়ে উঠল আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুচি কুচি যেসব মন্তব্য করা হলো তাকে কেবল ‘সমাজবিরোধী’ বলা যায়। ভারত ও পাকিস্তান হকি খেললে কোনোরকম ফিসফিসানি হয় না। যে-ই বলা হলো ‘ওরা ক্রিকেট খেলবে’, ব্যস অমনি চিল্লাচিল্লি হৈচৈ!

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সমস্যাটা খেলা নয়, সাড়া দেওয়া হলো কীভাবে, এটাই সমস্যা। আগ্রহের বিনাশ ঘটালে বিতর্ক মরে যায়। মুশকিল হলো ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট টিম বিরক্তিকর হতে নারাজ। তারা তাদের পয়মন্ত দিনে বিশ্বের যে কোনো দেশকে পরাস্ত করার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। স্বভাবতই এ দুটি দেশের কোনোটিই খেলার সময় কোনোরকম সঙ্গতি বজায় রাখে না। সঙ্গতি রক্ষা করাটা উপমহাদেশীয় মেজাজমর্জির সঙ্গে বেমানান। আমাদের মাধুর্যের বিপর্যয়কর দিকটি হলো আমরা কী করে বসব তা অনুমান করা অসম্ভব। এতে করে টেনশন তৈরি হয়। জাতীয় স্নায়ুর জন্য টেনশন ভালো নয়। বাস্তব অসুবিধাগুলোর কথা ভাবা যাক, যেগুলোর প্রভাবে পাক-ভারত টেস্ট সিরিজ ক্রিকেট বিঘ্নিত হয়েছিল। দু-একজন পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের অশোভন আচরণের কারণে হকি খেলায় সময়ের যে অপচয় ঘটে, সেই সময়টাশুদ্ধ হিসাব করলেও একটা হকি ম্যাচের অবাঞ্ছিত ব্যাপারগুলো দুই ঘণ্টার মধ্যে বিস্মৃতির মোড়কে রাখা যায়। ক্রিকেট টেস্ট চলে পাঁচ দিন। সিরিজটা যদি ভারতে হয় আমাদের গ্রাউন্ডসম্যানরা জনজীবনে শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য যথাসাধ্য করবেন এবং ম্যাচটা তিন দিনেরও কম সময়ে সাঙ্গ করে ফেলবেন। তবে ভারত যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে তখন ১৮ ঘণ্টার খেলাটাও অনন্তকালের ব্যাপার হয়ে ওঠে। এসব সমস্যার বিপরীতে শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের প্রবল আবেগ-উচ্ছ্বাস বস্তুত তেমন কিছুই নয়। পাকিস্তান পাকিস্তানে খেলতে পারে না কারণ নিরাপত্তার গ্যারান্টি কেউ দেয় না। এদেশটির ‘হোম গ্রাউন্ড’ এখন আউটসোর্সড হয়ে প্রচণ্ড উষ্ণমৃত্তিকার দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে গেছে। তাই বলে কি ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে অন্য কোথাও ক্রিকেট খেললে সেই সন্ত্রাসীরা, যারা পাকিস্তানে ক্রিকেট অসম্ভব করে তুলেছে- অবকাশ উদযাপন করতে যাবে? শুধু খেলার ভেন্যুতে নয়, অন্য কোথাও যদি ‘ওরা হামলা চালায়’ আমরা কী করব? মিডিয়া যে-ই কোনো বিষয়ে ‘গেল গেল’ রোয়াব তুলবে আর সরকারগুলো তোষণদোষে অভিযুক্ত হবে, অমনি আমরা ওই কাজ পরিত্যাগ করব? ইংল্যান্ডে একটা সিরিজ খেলার আয়োজন সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি কথা উঠেছে। প্যারিসের (সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার) পর লর্ডসের মাঠে ওই খেলার ব্যবস্থাপনায় এমসিসি এবং এম-সিক্সটিন (ব্রিটিশ নিরাপত্তা সংস্থা) আগ্রহী হবে কি-না আমার সন্দেহ আছে। ধাক্কা মারার জন্য আকস্মিক ঘটনা যে অপেক্ষা করছে তা একটু মনোযোগ দিলেই ধরা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমার মনে পড়ে, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গত টি-২০ বিশ্বকাপের আগের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলোর কথা। আধুনিক ক্রিকেটের তীব্র অশালীন দিকগুলোর অন্যতম হচ্ছে দর্শক আকৃষ্ট করে রাজস্ব আহরণের মতলবে জজবা তোলা। ওই টুর্নামেন্টের আগে ভারতীয় টেলিভিশনে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনগুলোর বেশ কয়েকটি ছিল উসকানিমূলক, আপত্তিকর, রুচিহীন ও (অযৌক্তিকভাবে নিজ দেশকে সেরা বলে জাহির করার) গোঁড়ামিতে ভরা। এসব বিজ্ঞাপন ভারতের বিরুদ্ধে অসংখ্য দর্শকের মনে বৈরিতা সঞ্চারণের জন্য যথেষ্ট। ওই ক্ষতিটা এখনো বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ভারতীয় ক্রিকেটের কথিত অভিভাবক বিসিসিআই (বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া) তখন ব্যাপারটির পরোয়া করেনি, ভবিষ্যতেও করবে মনে হয় না। বিসিসিআইর মনোযোগ শুধু রূপের ঝনঝনানি আর সোনার ধুপধুপানির দিকে।

ঐতিহাসিকভাবে বিতর্ক-উদ্দীপক বিষয় আম্পায়ারিং। তাকাই সেদিকে। প্রযুক্তির প্রতি ভারত এখনো লাডাইট (ইংল্যান্ডের শ্রমিক সংঘ ‘লাডাইট’ ১৮১১ থেকে ১৮১৬ সাল পর্যন্ত বেকারত্বের আশঙ্কায় নতুন যন্ত্র ধ্বংস করতে উদ্যোগী হয়েছিল) এই যুক্তিতে যে, ভুল যদি করতে হয়ই তবে তা মানবিক হওয়াই ভালো। এই মনোভঙ্গি, কেউ কেউ বলে, সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির উত্তরাধিকার। খুব একটা সাধারণ ব্যাপারকে আমাদের ক্রিকেটের মহাবুদ্ধিমানরা কেন সরাসরি দেখেন না? ভুল করলে যন্ত্রকে লোকে ক্ষমা করে, মানুষকে করে না। দুর্নীতির সংক্রমণে নগদ-টাকায়-ভারি ক্রিকেট আর বাজি ধরার তামাশা, বাতাস পুঁতিগন্ধময় হয়ে উঠেছে। আম্পায়াররা অসৎ- এমন অভিযোগ অবশ্যই করি না। তারা দুর্নীতি থেকে অনেক দূরে। তারা নিজেরাই নিজেদের সব সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করছেন। কিন্তু সন্দেহ আর গুঞ্জন তো খাঁটি সত্যে আগ্রহী নয়। ভারত যদি কখনো পাকিস্তানের সঙ্গে খেলে তবে তা হতে হবে ক্যামেরার প্রতি সন্দেহ প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার একাÍ হওয়ার পর।

আমি ক্রিকেট ভালোবাসি এমন কি তা যখন একঘেয়ে হয়ে পড়ে, তখনও। একটা টিভি সেট যে কিনলাম তার একমাত্র কারণ ক্রিকেট ও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল দেখা। ভারত-পাকিস্তান সিরিজ দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি আনন্দের বিষয় তো সামান্যই। ক্রিকেট যদি উৎসবের না-ই হয়, তবে কি তাকে হতে হবে ঝুঁকি? খেলাধুলা আনন্দের জন্য। আনন্দের না হলে তা কিছুই নয়। খেলা যুদ্ধের কোনো বিকল্প নয়। খেলা হচ্ছে সূক্ষ্ম সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার শিল্প। সুন্দরতম হয়ে উঠলে তাকে নাটকের সঙ্গে তুলনা করা যায় যেখানে প্রতিভাদীপ্ত নর-নারী তাদের সর্বস্ব ঢেলে অভিনয় করেন। এদের মধ্যে কারও কারও কাছে রয়েছে জাদু প্রতিভার ছোঁয়া। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই এবং তা দীর্ঘকাল ধরেই চলতে পারে। তাই বলে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন  কোনো খেলোয়াড় বিষয়টিকে বৈরিতার দিকে টেনে নেন না। যদি নেন, তা হয়ে যায় খেলার মৌলিক নীতির অবমাননা। আমরা যা দেখি তা যদি উপভোগ করতে না পারি তবে তা কোনো খেলা-ই নয়।

এই শীতে কি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের খেলা উচিত? প্রশ্নটির জবাব যাদের দিতেই হবে আমার আন্তরিক সহানুভূতি তাদের জন্যই।

বিডি-প্রতিদিন/ ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৫/ রশিদা



এই পাতার আরো খবর