ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আমির খানের জীবন খোলা একটা বই
কুলদীপ নায়ার

ভারতের শীর্ষস্থানীয় অভিনেতা আমির খান এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে, তার স্ত্রী তার কাছে জানতে চেয়েছেন, সুস্থ পরিবেশে সন্তানদের লালনের জন্য তাদের অন্য কোনো দেশে চলে যেতে হবে কি-না। ওই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। আমিরের কণ্ঠে কোনো ক্ষোভ-রুষ্টতা ছিল না, ছিল একটু বিষণ্নতা। তবুও তার কথাগুলো আমায় ঝাঁকুনি দেয়। সমগ্র দেশও এতে অবশ্যই নড়ে উঠেছে। এর আগে বিষয়টি আমি উপলব্ধি করিনি : অবস্থা এতটাই অবনত হয়ে গেছে যে, আমির খানের মতো মানুষও ভাবছেন, তারা ভিন্ন দেশে চলে যাবেন কি-না। বোঝা যায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা আমিরের চেয়ে কম মর্যাদার তারা সন্ত্রস্ত হয়েই রয়েছেন। অসহিষ্ণু পরিবেশদৃষ্টে ত্যক্ত-বিরক্ত প্রায় ৫০০ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন, কত দুঃখে দিলেন বোঝা যায়। ওই বর্জনটা তাদের বেদনা প্রকাশের হাতিয়ার।  ওরকম যারা পারছেন না, তারাও তাদের অসহায়ত্ববোধ ভাগাভাগি করে চলেছেন। আমির খানের মন্তব্য জানার পর সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট ব্যক্তিদের বিচলিত হয়ে ভাবতে বসা উচিত ছিল, কেন সংখ্যালঘুদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এমনকি সংখ্যালঘুদের মধ্যে খুবই প্রতিভাদীপ্ত ও পরিশীলিতদের অন্যতম আমির খানও নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। কারণ কী? ভাবনাচিন্তা তো করলই না। উল্টো ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আমিরের ওপর হামলে পড়ল এবং শাব্দিক অর্থে তাকে অপমানই করল। তারা বলল, ‘আমির খানকে বানিয়েছে ভারত, ওটা তিনি ভুলে গেছেন। তিনি অকৃতজ্ঞ।’ আসল ব্যাপার হচ্ছে, কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে গড়ে তুলেছেন আমির খান। তার অভিনয় প্রতিভার জন্যই ভারত তাকে বরণ করে নিয়েছে।

নতুন তেমন কিছু ঘটেনি যে ‘দেশ ছাড়ার চিন্তা’ প্রকাশ করতে হবে, এটা আমি স্বীকার করি। তবে আমির যা বোধ করেছেন তা-ই বলেছেন। তার অনুভূতিকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমির খানের মতো মানুষ, ভারতব্যাপী ভক্তরা যাকে ভালোবাসে, তিনি কেন অমন কথা বললেন, তা আমাদের সবাইকে খতিয়ে দেখতে হবে। যা তিনি বলেছেন, তাতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে, তা জেনেবুঝেই তিনি কথাগুলো বলেছেন নিশ্চয়। তিনি বোধতাড়িত ব্যক্তিত্ব। অবশ্যই তার এমনটা মনে হয়েছে যে, অসহিষ্ণুতার মনোভাব দেশময় এতটাই তীব্র করে তোলা হচ্ছে যে, তাতে করে তার মতো মানুষও অবাঞ্ছিত হয়ে যেতে পারেন। ধর্মনিরপেক্ষ বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে তার পরিচিতি সন্দেহাতীত। তার গোটা জীবন তো খোলা একটি বই।

তার মন্তব্যকে ঘিরে যে বিতর্ক পয়দা করা হলো তা সুস্থ বিতর্ক নয়। এটা দুর্ভাগ্য। আমির খানের মন্তব্যের কারণ কী তা নির্ণয়ের চেষ্টা না করে, হৈচৈ শুরু করে দেওয়া হয়। বলা হয়, তার এত স্পর্ধা! অসুস্থ বিতর্কের ফলে, আবারও সেই হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের প্রশ্নগুলো সামনে উঠে এলো। প্রত্যেকটি জিনিস গালিচার নিচে চাপা দেওয়ার প্রবণতা সুফল দেয় না। অতীতে ওরকম করা হয়েছে। জাতিকে সামগ্রিকভাবেই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা চালাতে হবে। ‘নিরাপদে আছি’— এই বোধ সঞ্চারণ করতে হবে সংখ্যালঘুদের মনে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মন্তব্য নয়, সংখ্যালঘিষ্ঠরা কী বলছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত বিভক্তির ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক হলেও প্রাসঙ্গিক বিষয়। দেশ বিভক্তি বাস্তবতা বটে। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী জওহরলাল নেহরু ও সরদার প্যাটেল দেশ বিভক্তির ফর্মুলা মেনে নিয়েছিলেন। বিভক্তি তারা চাননি, এটা সত্য। যখন বুঝলেন ব্রিটিশ শাসন অবসানের আর কোনো উপায় নেই, তখন ভারত খণ্ডনের ফর্মুলায় সম্মতি দিলেন।

ভারত বিভক্তি-ফর্মুলা গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন উত্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে তার কামরা থেকে ওয়াকআউট করেন মহাত্মা গান্ধী। এই ফর্মুলাকে পাত্তা দেননি তিনি। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি যখন বললেন, ‘কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐকমত্য হোক বা না হোক ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবেই’ তখন নেহরু ও প্যাটেল বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হূদয়ে দেশ বিভক্তিতে রাজি হলেন।  ধর্মের ভিত্তিতে রেখা টেনে দুটি রাষ্ট্র হওয়ায় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় একে অন্যের দিকে মারমুখী হয়ে রইল। এটা দৃশ্যত, জনগণ ব্রিটিশদের চলে যেতে বাধ্য করার খেসারত। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হলো শুধু নামেই। শান্তি-সম্প্রীতির আশ্বাস দিয়েছিলেন নেতারা। তাই, নিজ নিজ সম্প্রদায়ের দেশে স্থিত হওয়ার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে রওনা দেয় দুই পক্ষের মানুষ। এ সময় যে রক্তপাত হয়, ইতিহাসে আগে তা কখনোই হয়নি। দুই সম্প্রদায়ের প্রায় ১ কোটি মানুষের প্রাণ যায়। এর চেয়েও বেশি মানুষ বিতাড়িত হয় বাড়িঘর থেকে। সেই যে ক্ষত, তা আজ অবধি সারল না। উপরন্তু, দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান তিন-তিনটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। স্থায়ী শান্তির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ১৫ কোটিরও বেশি, তবু তারা এ দেশে গুরুত্ব হারিয়েছে। পাকিস্তানে জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম হিন্দু। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার ঘোষণা দেয়, সে অনুযায়ী সংবিধানও রচনা করে। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে চাইল। জনসংখ্যার দিক থেকে ৮০ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুরা সংবিধান দ্বারা শাসিত হওয়ার পথ বেছে নেয়। সংবিধানে বলা হয়, ‘আইনের চোখে সবাই সমান। ধর্মের ভিত্তিতে কোনো ভারতীয় নাগরিককে অবহেলা করা যাবে না।’ এই ব্যবস্থা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে মুসলমানদের গুরুত্ব খুবই সামান্য। দেশ বিভাগের আগে ছিল পৃথক নির্বাচন। স্বাধীন ভারতে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতির কারণে মুসলিম সম্প্রদায় কিছুটা সুবিধা পায়। তবে সেটা ভোট গ্রহণ পর্যন্তই। নির্বাচন পার হলে অন্যান্য ঝামেলার দাপট শুরু হয়, মুসলমানরা অবহেলিত হতে থাকে। ভোটের আগেকার হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ফের মাথাচাড়া দেয়। ভারত এই অবস্থাটা বয়েই চলেছে।



এই পাতার আরো খবর