ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

দিল্লির চিঠি
কুৎসাচার মারণাস্ত্র হিসেবে কখনই ফলপ্রসূ নয়
এম জে আকবর

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই বেসামরিক কর্মকর্তা রাজেন্দ্রকুমারের অফিসে হানা দেওয়ার পর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে হঠাৎ যে প্রচণ্ড ঝড় ওঠালেন তাকে তিনভাবে দেখা যায়। এক. নৈরাশ্যবাদীর আচরণ; দুই. কৌতূহলোদ্দীপক; তিন. দৃষ্টিগ্রাহ্য হওয়ার চেষ্টা। এ তিনের মধ্যে ‘নৈরাশ্য’ কথাটা বেশি খাটে। কারণ, প্রকৃত ঘটনা যখন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলে তখন বিকৃতির আশ্রয়ই সে নিয়ে থাকে। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের একজন এই রাজেন্দ্রকুমার। ইনি সরকারি আমলা। এই ব্যক্তির প্রশ্নবিদ্ধ অতীত রয়েছে। তা সত্ত্বেও কেজরিওয়াল তাকে ক্ষমতাধর একটা পদে বসিয়ে দেন। রটনা আছে, রাজেন্দ্র প্রভাব খাটিয়ে বিশেষ বিশেষ কোম্পানিকে বড় বড় ঠিকাদারি পাইয়ে দিয়েছেন। চাতুরী আর প্রতারণার কৌশলে তিনি কী কী অনাচার করেছেন তা এখন প্রকাশ্যেই বলাবলি হচ্ছে। দুর্নীতি কোথায় কীভাবে হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করে যে ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ তারাও রাজেন্দ্রর কার্যকলাপের বিষয়ে কেজরিওয়ালকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত না করে লোকটাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করলেন কেজরিওয়াল।

রাজেন্দ্রর বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ উঠল সেগুলোর কোনো জবাব না দিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রাচীনতম কৌশল অবলম্বন করলেন : লোকটা যেসব কুকাজ করেছে সেগুলো আড়াল করে রাখবার মতলবে হালকা বাতাসের মধ্যে থেকে ঘূর্ণিঝড় তুললেন। তিনি আক্রমণ করলেন দুই ভাবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গালিগালাজ আর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির বিরুদ্ধে বস্তাপচা ও অত্যন্ত ফালতু কিছু অভিযোগ পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা।

অরুণ জেটলির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ দুই বছরেরও বেশি আগে ‘অনর্থক’ প্রমাণিত হয়েছে। ওসব অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধীর সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স—ইউপিএ) সরকার। অব্যাহতি দেওয়াটা দয়ার দান ছিল না। জেটলিকে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে পারলে ইউপিএ আমোদিতই হতো। ক্রিকেট প্রশাসনে থাকাকালে জেটলি কী ধরনের গুরুতর জালিয়াতি করেছেন তা তদন্ত করতে সিরিয়াস ফ্রডস ইনভেস্টিগেশন অফিসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তদন্ত দ্রুত হোক, এটাই চেয়েছিল ইউপিএ এবং দ্রুতই পেয়ে যায় তদন্ত রিপোর্ট। ২০১৩ সালের ২১ মার্চ তদন্তকারীরা ঘোষণা করেন, ‘কোনো রকম জালিয়াতি হয়নি।’ কেচ্ছা ওখানেই খতম। সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসতে থাকলে জেটলি ক্রিকেট প্রশাসন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ করে রাজনৈতিক সুখ্যাতি অর্জনকারী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ওই সময়টায় এসব অভিযোগকে একবারও ইস্যু করে তোলেননি। আমাদের যে বিষয়টি কৌতূহলী করে তোলে তা হচ্ছে : একজন আমলাকে রক্ষা করার জন্য কেজরিওয়াল কেন একটা বানোয়াট ঝড় তুললেন? এমন নয় যে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে তিনি আবেগাত্মক অঙ্গীকারে আবদ্ধ বলে জান দিয়ে হলেও ওই প্রতিষ্ঠানকে সর্বদা আগলে রাখবেন। রাজেন্দ্রকুমার ঘটনার মাত্র কদিন আগে দিল্লি সরকারের আরেক অসামরিক কর্মকর্তার বাড়িতে তল্লাশি চালায় সিবিআই। কেজরিওয়াল ওই ব্যক্তির পক্ষাবলম্বন করেননি। বরং তড়িঘড়ি ভঙ্গি করেন, এ রকম তল্লাশি তার শাসন পদ্ধতিরই সুফল। তাই, প্রশ্ন উঠেছে : রাজেন্দ্রকুমারের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে কেজরিওয়াল এত বেশি রাজনৈতিক মূলধন কেন খাটাচ্ছেন? আমরা পরিষ্কার জবাব পাই না। তবে প্রশ্নের ভিতরই সন্দেহের রেণু উঁকি মারে। একটা গুঞ্জনও সরব হয়। তাতে করে পুরনো ঘটনা জেগে উঠতে চায়। তা হচ্ছে : দিল্লি বিধানসভায় বিগত নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ২ কোটি টাকার রহস্যময় একটা চেক আম আদমি পার্টির (এএপি) ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যাত্রা করেছিল। স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, এএপি গঠনে যারা সহায়ক শক্তি ছিলেন, যারা দলটির দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে মধ্যমণি হিসেবে অবদান রেখেছেন, যেমন শান্তিভূষণ, প্রশান্তভূষণ ও যোগেন্দ্র যাদবের মতো নেতারা কেজরিওয়ালের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছিন্ন করেন। কারণ তাদের সন্দেহ হচ্ছিল যে কেজরিওয়াল আর নিখাদ নন। একটা ঘটনার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি কোনো কোনো সময় ব্যক্তিবিশেষের চিন্তা প্রক্রিয়ার মজাদার দিকটি তুলে ধরে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তো বৈরিতার ঘাটতি নেই। আবার, দেখা যায়, বৈরিতা ব্যক্তিগত থাকে না। সংসদ সদস্যরা খোশগল্পে মশগুল হওয়ার সময় সংসদ ভবনের আড্ডায় একে অন্যকে বাক্যবাণ হানেন। এতে এক ধরনের তৃপ্তি পান তারা। তাই বলে সীমারেখা বিস্মৃত হওয়া চলে না। কারণ গণতান্ত্রিক জীবনচর্যায় কার কতটা পুষ্টি তা চিহ্নিত হয় অনুসৃত সংযম দ্বারা। কুৎসাচার দিয়ে লক্ষ্যভেদ অসম্ভব। কুৎসাচার মারণাস্ত্র হিসেবে কখনই ফলপ্রসূ নয়। যে এ অস্ত্র ব্যবহার করে তাতে তার নীচতাই পরস্ফুিট হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতি বিষোদগার করবার সময় কেজরিওয়াল সব রকম সংযম হারিয়ে ফেলেছিলেন। যখন বুঝলেন যে গণপ্রতিক্রিয়া নেতিবাচক তখন তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কিছুটা সংশোধিত হতে চাইলেন। ‘আমায় করুণা কর’ ভাব ফুটিয়ে তিনি স্বীকার করলেন তিনি হয়তো দু-একটি শব্দের অপব্যবহার করে ফেলেছিলেন। তার ব্যাখ্যা : হরিয়ানার একটি গ্রামে জন্মেছেন তিনি; কাজেই তার আচরণে গ্রাম্যতা এসে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এ ধরনের মন্তব্যের মধ্যে গ্রামকে হেয় করার সুপ্ত মানসিকতাই ফুটে ওঠে। গ্রামের অধিবাসী হলেই মানুষ অশিষ্ট ভাষায় কথা বলবে? গোঁড়ামি থেকেই সম্ভবত অচেতনভাবে এ রকম মনন চলছে। বিস্ময়কর হলেও এ ধরনের মানসিকতা প্রবল।



এই পাতার আরো খবর