ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

অন্য চোখ
নতুন বাড়ির খোঁজে
মুস্তাফা জামান আব্বাসী

এ বাড়িতে অনেক দিন। এবার নতুন বাড়ির খোঁজ। বন্ধু মোজাম্মেল হক তালুকদার, বয়স ৮৬, মাঝে মধ্যে ফোন করে বলেন, আব্বাসী ভাই, ভালো লাগে আজিমপুর কবরস্থানে মাঝে মাঝে ঘুরে আসতে। সেখানে বাস করেন যারা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করি। কথা বলি মনে মনে। ভালোই লাগে। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন  যারা, তাদের সঙ্গে কি কথা বলা সম্ভব? ফ্রিকোয়েন্সি পেলে— রেডিও ওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি পেলে সবকিছুর সমাধান। ফ্রিকোয়েন্সি পেলে আল্লাহর সঙ্গেও বাতচিৎ সম্ভব। তালুকদার আরও বললেন, সৈয়দ মুজতবা আলি আপনার মামা শ্বশুর? তার কবরে গিয়ে তার বইগুলো নিয়ে আলোচনা করি। কবরটা দেখভাল করি, দু-চারটা ফুল গাছ লাগাই। আমার ইচ্ছা আপনার বাবা-মার কবরটাতেও ভালো করে ফুল গাছ লাগাই, দুয়েকটি বেঞ্চি লাগিয়ে দি, গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলো যেখানে বসে তেলাওয়াত করতে পারেন। বললাম, জায়গা নেই, প্রতি ইঞ্চি জমি লাখ লাখ টাকা। ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’। চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইলে ষোল কোটি মানুষ, ২০২৫ সালে ২০ কোটি, ২০৫০-এ ৪০ কোটি। কবরের জায়গা খোঁজা হবে বঙ্গোপসাগরে।

নতুন বাড়ির অন্বেষণের কথায় চলে যাই পূর্বাচল নতুন রাস্তায়। বসুন্ধরা থেকে পুবে অপূর্ব নতুন রাস্তা চলে গেছে কাঞ্চন হয়ে সিলেটের দিকে। এ রাস্তায় গতকালই প্রথম। চারদিকে নতুন স্থাপনা, নতুন নতুন সাইনবোর্ড, যেন ‘এলেম নতুন দেশে’। ঢাকার অদূরে যে সব নতুন রাস্তা হচ্ছে, সেগুলো আমরা চিনি না। ঢাকা বাইপাস এমনি একটি রাস্তা, যা উত্তরবাংলার সঙ্গে সিলেট-চিটাগাং সংযোগ করবে এখানে। সন্ধানী মানুষরা দুদিকের সব জমি কিনে নিয়েছেন। এখানেও কোথাও ঠাঁই নেই। গরিব মানুষরা জমি বিক্রি করে দিয়েছে। এখন কোটি টাকার সম্পদ। নতুন ঢাকা তৈরি হচ্ছে এ দিকে। ভালো লাগল দেখে।

জমি প্রয়োজন সাড়ে তিন হাত। যেখানে যাচ্ছি শিগগিরই, তারই অন্বেষণ। ভাগ্যবান আমি বটে, নতুন বাড়ির সন্ধান পেয়েছি। চারদিকে নদী আর নদী, এমন নদী যা কেউ দেখেনি। পানি স্বচ্ছ, পান যোগ্য। এত সুগন্ধি, যা সবচেয়ে সুন্দর সুগন্ধকেও হারায় মানায়। তার সুগন্ধ একেক জনের কাছে মনে হবে একেক রকম। যার বেল ফুল পছন্দ, সে পাবে বেল ফুলের গন্ধ। যার হেনা, সে পাবে হেনা। গোলাপে যার অবগাহন, সে পাবে গোলাপ। একই পানি অথচ তার রূপ একেক জনের কাছে একেক রকম। মলয় সমীরণ এমনভাবে বইবে যে, মনে হবে এর চেয়ে সুন্দর সমীরণ আর কখনো পাই নি। ঠিক যেমনটি আমি আমার বাড়ির জানালা খুলে দি, পাখা বন্ধ করে দি, এসি বন্ধ করে দি, আর সকাল বেলার স্নিগ্ধ বেলা সমস্ত অস্তিত্বকে শীতল করে যায়। নদীর কথা কেন বার বার বলা হয়েছে তাই এবার বুঝতে পারলাম। যেমনটি সকাল-সন্ধ্যা জন্ম নদী কালজানিকে অনুভব করি। ওই নদী বেহেশতের স্বাদ এনে দেয়। নদী সব স্বাদের সেরা তা অনুভব করি গ্রন্থ পাঠের পর। এত গ্রহ নক্ষত্ররাজি, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ। যেখানে নদী নেই, সেখানে জীবন নেই, মানুষও নেই। নদীতীর না হলে সৃষ্টি স্তব্ধ। তাই স্রষ্টা দিচ্ছেন নদীর প্রতিশ্রুতি।

নীল নদের কথা পড়েছি, পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী ৪২৫৮ মাইল, এগারটি দেশে প্রবাহিত। দেশগুলো হলো— তানজানিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্দি, কঙ্গো কিনসাসা, কেনিয়া, ইরিত্রিয়া, দক্ষিণ সুদান, সুদান এবং মিসর। একটি সাদা নীল, আরেকটি নীল নদ। নীল নদ না হলে মিসরের শস্য বরবাদ। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা নীল নদকে ঘিরেই। নীলের পাশেই বাস করে মিসরের অর্ধেক মানুষ। সত্তর সালে গড়ে ওঠে বৃহত্তম বাঁধ আসোয়ান। তেমনি গঙ্গা, সিন্ধু, যমুনা। আমাদের যেমন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। এগুলো না হলে আমাদের দেশ মরুভূমি হয়ে যাবে। গঙ্গায় বাঁধ দেওয়ায় আমাদের উত্তরাঞ্চল মরুভূমি প্রায়।

আবার নদীর কথায়। বুড়িগঙ্গা, শীর্ণ থেকে শীর্ণ প্রায়, সবুজ থেকে কালো এ পানির রঙ। এ নদীতে কেউ সাঁতার দেয় না। কারণ এ নদীর পানি মুখে নেওয়া যায় না। দুর্গন্ধে পরিপূর্ণ এই নদীর ধারের আকাশ ও বাতাস। এ নদীকে গলাচিপে হত্যা করেছি। নদীতীরের মানুষের জন্যে খারাপ খবর। এখানে মানুষ বাঁচতে পারবে না। যেমন পরিত্যক্ত হবে দিল্লি। দিল্লির বাতাস ভরে গেছে বিষাক্ত অনুষঙ্গে। তাই দিল্লি নিশ্চয় হবে একটি বিরান জনপদ। ঢাকাও সেদিকে এগুচ্ছে। ক্রমে ক্রমে পৃথিবীও হবে এমন জায়গা যেখানে আর বাস করা যাবে না। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে না, ঘৃণা করে। ভালোবাসা নেই বলে, এই পৃথিবী হবে পরিত্যক্ত। ভালোবাসার পথে অগ্রসরমান হলে নতুন বাড়ি খুঁজতে হবে না, নতুন নদীর প্রয়োজন হবে না। 

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব

ই-মেইল: mabbasi@dhaka.net

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০৫ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা



এই পাতার আরো খবর