ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

লেখকের অন্য চোখ
রবীন্দ্রনাথ এই গাছকে কেন পছন্দ করতেন?
সমরেশ মজুমদার

আমার তিনতলার শোয়ার ঘরের জানালার পাশে উঠে এলো গাছটা। এই উঠে আসার সময়টায় সম্ভবত নাবালক ছিল। তাই প্রচুর পাখি ওর ডালগুলো দখল করে থাকত। এ বছর দেখলাম থোকা থোকা ফুল ফুটেছে। সঙ্গে সঙ্গে কাক ছাড়া অন্য পাখিরা ওর ধারেকাছে আসছে না। আমি বিছানায় শুয়ে পাশ ফিরতেই ফুলগুলো দেখতে পাই। বেশ নয়নভোলানো হলদে ফুলের গুচ্ছ। তারপরেই শুরু হয়ে গেল। ঘরে ঢুকলেই তীব্র গন্ধে নাক জ্বালা করতে লাগল। সেই জ্বালা সহ্য করে ঘরে থাকা বেশ কষ্টকর হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। অথচ ঘর থেকে বের হয়ে গেলে সেগুলো মুহূর্তেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, ওই ফুল বিষফুল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না রবীন্দ্রনাথ এই গাছকে কী কারণে পছন্দ করতেন? না করলে শান্তি নিকেতনের সমাবর্তন উৎসবে কেন ছাতিম ফুলের পাতা উপহার দেওয়া হতো। এক বন্ধু বললেন, ‘আপনার নাকের ডগায় ছাতিম ফুল ফোটে, তাই ওর তীব্র গন্ধ আপনি টের পান। গাছটা যদি একশ গজ দূরে থাকত, তা হলে গন্ধের তীব্রতা কমে যেত, আপনি মিষ্টি গন্ধ পেতেন। বোধহয় রবীন্দ্রনাথ বেশ দূর থেকেই ছাতিম ফুলের গন্ধ পেয়েছিলেন। আর দেখবেন, গাছটা সহজে বড় হয়ে যায়। সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করতে পারে। সেই অর্থে সংগ্রামী গাছ। এই স্বভাবটা বোধহয় রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করেছিলেন।’ তা হয়তো হতে পারে। কিন্তু আমি তো শোয়ার ঘর পাল্টাতে পারছি না। একমাত্র পথ হলো গাছটাকে সরিয়ে ফেলা। কিন্তু তিনতলা সমান গাছটাকে সরিয়ে ফেলার ক্ষমতা আমার একার নেই। তা ছাড়া সরকারি আইনে গাছ কেটে ফেলা দণ্ডযোগ্য অপরাধ। অথচ ওই গাছ এভাবে ফুল ফোটালে আমার মৃত্যুর জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আমি যে পাড়ায় থাকি তা তৃণমূল দলের নিয়ন্ত্রণে হলেও গত করপোরেশন নির্বাচনে একজন বামপন্থি সবাইকে অবাক করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। গাছ কাটার অধিকার নিশ্চয়ই কলকাতা করপোরেশনের আছে ভেবে তাকে টেলিফোন করলাম। সমস্যার কথা জানিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে অনুরোধ করলাম, ‘দয়া করে গাছটাকে কাটিয়ে ফেলুন, নইলে ওর গন্ধে আমি মারা পড়ব।’ কাউন্সিলর বললেন, ‘পুজোর আগে কিছু গাছের ডালপালা ছাঁটা হয়েছিল বটে কিন্তু পুরো গাছ... আচ্ছা, দেখছি।’

কিছুদিন অপেক্ষা করলাম। মনে হচ্ছিল, গাছ কাটার লোকজন হৈচৈ করে এসে ওটাকে কেটে এলাকা গন্ধমুক্ত করে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? শেষ পর্যন্ত একজন রাজনৈতিক নেতার শরণাপন্ন হলাম। তিনি উদাসীন গলায় বললেন, ‘কাউন্সিলর কী করবে? কোনো ক্ষমতা আছে নাকি? আপনি এক কাজ করুন, জয়দেববাবুর সঙ্গে দেখা করুন।’

‘তিনি কে? কোথায় পাব?’ ‘করপোরেশন অফিসের উনিই তো সব। আমাদের লোক। আমার কথা বলবেন। খুব নরম প্রকৃতির মানুষ। লেখার বাতিক আছে, আপনাকে খাতির করবেন।’ অতএব, গেলাম করপোরেশন। খোঁজ করতেই একজন পিওন গোছের লোক বলল, ‘যার টেবিলের সামনে মানুষের ভিড় তিনিই জয়দেববাবু।’ শুনে পুলকিত হলাম। ক্ষমতাবান লোক না হলে ভিড় হবে কেন? মিনিট কুড়ি পরে আমার পালা এলো। জয়দেববাবুর বয়স পঞ্চাশের আশপাশে। গোটা মাথা নিকিয়ে টাক গিয়ে থেমেছে ঘাড়ের দুই ইঞ্চি ওপরে। সেখানে বেশ পুরু কৃষ্ণকেশ। হেসে বললেন, ‘বলুন। বলুন কী করতে পারি?’

‘আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।’ ভূমিকা করলাম।  ‘হ্যাঁ, আমাকে সত্যজিৎ বলেছে। আপনি তো সমরেশ মজুমদার। বেশ নাম হয়েছে এখন। বলুন, সমস্যাটা কী?’ কথা বলার সময়েই জয়দেববাবু চিরুনি বের করে ঘাড়ের ওপরের চুল আঁচড়ে নিলেন।

‘ফুলের গন্ধে...।’

সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিলেন জয়দেববাবু, ‘ঘুম আসে না?’

‘প্রায় তাই।’

‘কার গান মনে আসে?’ বলে নিজেই জবাব দিলেন, ‘প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না তাই তো জেগে রই।’ আহা। কী গান! কী লাইন! ভাবুন, একজন মানুষকে ফুলের গন্ধ ঘিরে রেখেছে বলে সে জেগে আছে। ফার্স্ট লাইনটা মনে আছে? ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই।’ জয়দেববাবু মাথা নাড়লেন, তখন সত্যিকারের গান হতো, কবিতা হতো, সাহিত্য হতো। বলুন, এখন একজন তারাশংকর বা বিভূতিভূষণের মতো লোক আছেন? অ্যা? তা ফুলের গন্ধ নিয়ে কী বলছিলেন? আমার তখন ধৈর্য নড়বড়ে হয়ে গেছে। বললাম, ‘আমার বাড়ির গায়ে একটা ছাতিম গাছ আছে। সেই গাছে ফুল ফোটার পর ভয়ঙ্কর তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। নাক জ্বলছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দয়া করে বলবেন কী করলে রক্ষা পাব?’ খুব অবাক হলেন। চোখ বড় হয়ে গেল জয়দেববাবুর। বললেন, ‘সে কী! আপনি একজন লেখক হয়ে বলছেন ফুল আপনার শত্রু?’ ‘আপনি একদিন থেকে দেখুন।’

‘না না, আপনাকে সহ্য করতে শিখতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই চাইছেন আমি করপোরেশনের কর্মীদের বলি কুঠার-করাত নিয়ে গিয়ে ওই গাছটাকে কেটে ফেলতে? তাই তো? নিরীহ গাছটা তো করপোরেশনে এসে প্রতিবাদ করতে পারবে না। আচ্ছা, ছাতিম গাছটা কী শুধু তার সব তীব্র গন্ধ আপনার দিকে থ্রো করছে? আর কেউ গন্ধটা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে না। তবু, আপনি বলেই বলছি, ভেবে দেখব। আলোচনা করব।’

দুই দিন বাদে পার্ক সার্কাস থেকে সিআইটি রোড ধরে মৌলালির দিকে আসছিলাম। তখন রাত ১০টা। আচমকা গাড়ির ভিতর ওই গন্ধ ঢুকল। নাকে রুমাল চাপলাম। ড্রাইভার বলল, ‘সমস্ত কলকাতাজুড়ে ওই গাছ লাগানো হয়েছে, স্যার। ফুল ফুটতে শুরু করলে ডাক্তারদের রোজগার বেড়ে যাবে।’ খুব ঘাবড়ে গেলাম। কলকাতা কি ‘সিটি অব ছাতিম গাছ’ হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ল, সান্দাকফুতে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা জায়গায় অক্সিজেনের অভাব হয়েছিল। শুনেছিলাম, লাকতি নামের একটা ফুল ফুটলেই অক্সিজেন কমে যায় বাতাসে। কলকাতা কি সেই রকম হয়ে যাবে? জানি না।

আমি এখন ফুল ঝরার অপেক্ষায় রয়েছি। 

লেখক : বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০৬ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা



এই পাতার আরো খবর