ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

নিষ্ঠুরতার রাজনীতি পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ
নঈম নিজাম

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন বেনজির ভুট্টো। আসিফ আলী জারদারি মহাক্ষমতাবান। এ সময় একদিন পুলিশ হামলা করে মুর্তজা ভুট্টোর গাড়িবহরে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে গাড়ির জানালা খুললেন মুর্তজা। নেতার গাড়ি থামতে দেখে বেরিয়ে এলেন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ইয়ার মুহাম্মদ। দাঁড়ালেন পুলিশ ও মুর্তজার মাঝামাঝি। কেউ বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে। পুলিশের মনোভাব কঠিন।  তারা শুরুতে বহরে হালকা গুলি করেছে। সাহসী মুর্তজা নিজের শরীর বের করলেন জানালার কাচ গলিয়ে। বললেন, কেউ গুলি করবা না। কী হয়েছে বল? ইয়ার মুহাম্মদ সিন্ধিতে এ বক্তব্য অনুবাদ করলেন চিৎকার করে। আর তখনই গুলিটি এলো। আঘাত করল ইয়ার মুহাম্মদের কপালে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। হতভম্ব মুর্তজা বিস্মিত হলেন। তিনি আর গাড়িতে বসে থাকলেন না। বের হয়ে এলেন। তার আত্মবিশ্বাস ছিল পুলিশ তাকে গুলি করবে না। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পুত্র। বেনজিরের ভাই। রাজনীতি নিয়ে দুজনের না মিললেও প্রধানমন্ত্রীর ভাই বলে কথা। মুর্তজাকে বের হতে দেখেই একজন পুলিশ চিত্কার করে বললেন, গুলি কর। আশপাশের গাড়িতে অবস্থানকারী সমর্থকরা মুর্তজাকে ঘিরে ফেললেন। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। তার সমর্থক ও দেহরক্ষীরা একে একে গুলিবিদ্ধ হলেন। পাখির মতো টার্গেট গুলিতে মারা হলো তাদের। অনেক বছর পর নিজের বাবার মৃত্যুর কথা এভাবেই বর্ণনা করলেন ফাতিমা ভুট্টো। ফুফির শাসনের সময় বাবার মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি ফাতিমা। তাই হূদয় নিংড়ানো কষ্টকে তুলে ধরেন তার লেখা ‘সংস অব ব্লাড অ্যান্ড সোর্ড’ বইতে। তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন ফুফু বেনজিরের এবং তার স্বামী আসিফ আলী জারদারির। আমি বেনজির ভুট্টোর আত্মজীবনী ‘ডটার অব ইস্ট’ও পড়েছি। দুজন নিজেদের কষ্টকে শেয়ার করেছেন নিজের মতো করে। দুজনেরই কষ্ট বাবাকে নিয়ে। বেনজির লিখেছেন তার বাবাকে কীভাবে জিয়াউল হক ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন সেই আহাজারির কথা। তার মা ও ভাইদের কীভাবে হয়রানি করা হয়েছিল, কীভাবে তাকে আটক করা হতো সেসব কাহিনী। বেনজির তার দুঃসহ কষ্টের জন্য দায়ী করেছেন সামরিক শাসক জিয়াউল হককে। অন্যদিকে ফাতিমা দায়ী করেছেন তার ফুফা আসিফ আলী জারদারিকে।

ক্ষমতার রাজনীতি পরিবার বোঝে না। সম্পর্ক বোঝে না। বাবার জন্য কন্যাদের আকুতি আমাকে আপ্লুত করে। অন্ধকার রাজনীতি মানব জীবনের অনেক কিছুই তছনছ করে দেয়। জটিলতা বাড়ায়। জীবনবোধকে নানামুখী করে। বেনজির দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর জারদারির বাণিজ্য বাড়তে থাকে। শপথের এক সপ্তাহ পর সুইস ব্যাংকে ক্যাপরিকর্ন ট্রেডিং নামের একটি অফশোর কোম্পানি স্থাপন করেন জারদারিকে মালিক হিসেবে। নয় মাস পর সিটি ব্যাংকের দুবাই শাখায় হিসাব খোলা হয়। এক দিনে জমা দেওয়া হয় পাঁচ মিলিয়ন ডলার। এমন অনেক বিতর্ক ছিল। এখনো আছে। ফাতিমা তার বইতে কিছুটা লিখেছেন। বেনজির একজন ডাকসাইটে নেত্রী ছিলেন। এ উপমহাদেশের ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারায় তার অবদান রয়েছে। বেনজির সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর কাছে। দুজনই সহপাঠী ছিলেন অক্সফোর্ডে। আবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, বেনজির ছিলেন সজ্জন ও উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন নারী। একবার অক্সফোর্ডে তারা জুলফিকার আলীর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বেনজির ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তবু বন্ধু ও সহপাঠীদের কাছ থেকে সরেননি। ১৯৯১ সালের সংসদে শেখ হাসিনা ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। একবার বেনজির পাকিস্তানে বিরোধীদলীয় নেতাদের সম্মেলন করেন। বাংলাদেশ থেকে যোগ দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারত থেকে সোনিয়া গান্ধী, শ্রীলঙ্কা থেকে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। মূল চার নেতাই নারী। শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে যান আবুল হাসান চৌধুরী। নিয়ম অনুযায়ী রাতের ডিনারে বিরোধীদলীয় নেতারা ছিলেন এক টেবিলে। আবুল হাসান চৌধুরী আলাদা টেবিলে। বেনজির ভুট্টো সবাইকে চমকে বললেন, সবার অনুমতি নিচ্ছি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুকে এ টেবিলে আনতে। সবাই অনুমতি দিলেন। আবুল হাসান চৌধুরী বসলেন বিরোধীদলীয় নেতাদের টেবিলে। তখন তিনি সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। চৌকস এই এমপি আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগকে সমৃদ্ধ করতে অনেক কাজ করেন শেখ হাসিনার নির্দেশে।

আবুল হাসান চৌধুরী এখন আর রাজনীতিতে নেই। বর্তমানে সংসদে বিরোধী দলও নেই। সবাই এখন সরকারি দল। আমরা বাস করছি তোষামোদী সংস্কৃতির যুগে। বেনজির ভুট্টোও নিষ্ঠুর রাজনীতির শিকার হন। জঙ্গিবাদীরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে হত্যা করে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল পরে। তা না-ই বললাম। সুস্থধারার রাজনীতির অভাব এ উপমহাদেশে অনেক দিন থেকে। রাজনীতিবিদদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ উঠে যাচ্ছে। সংকট কাটাতে পারছে না বড় বড় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্ষমতার রাজনীতিতে থাকতে অথবা যেতে জন্ম নিচ্ছে নিষ্ঠুরতার। আর নিষ্ঠুরতাই জটিলতা বাড়াচ্ছে কম-বেশি। এখানে আপন-পর বলে কিছু নেই। মুর্তজা ভুট্টো চিন্তাও করতে পারেননি বোনের শাসনকালে খুন হবেন। আর এই কারণে ফাতিমার আক্ষেপ তার ফুফাকে নিয়ে। বাংলাদেশে এমন ঘটনা কম ঘটেনি। নিষ্ঠুরভাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাকে হত্যা করা হলো। কী অদ্ভুত জাতি আমরা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুন করা হলো শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মতো নেতাকে। গ্রেনেড হামলা করে খুনের চেষ্টা করা হয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাকে। আইভি রহমানের মতো নেত্রীকে জীবন দিতে হলো। ইতিহাস বড়ই কঠিন। ইন্দিরা গান্ধীর মতো লৌহমানবী খুন হয়েছিলেন উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কবলে পড়ে। এ উপমহাদেশ থেকে সংস্কৃতির বন্ধনগুলো আলগা হতে শুরু করে অনেক বছর আগ থেকে। এখন তা বাড়ছে। অথচ এই রাজনীতি মোটেও কাম্য নয় কারও।

উপমহাদেশজুড়ে এত বিতর্কের পরও আশা ছাড়তে নারাজ আমি। প্রতিহিংসা থেকে সরে আসতে হবে। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখতে হবে সবাইকে। শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। কারণ বোমাবাজির রাজনীতি কারও কল্যাণ বয়ে আনে না। যে রাজনীতি দেশকে অস্থিতিশীল করে, প্রতিহিংসার জন্ম দেয় তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের নানা সংকট ছিল, আছে, থাকবে। তবুও গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বিশ্বের বুকে পাকিস্তান এখন এক ব্যর্থ রাষ্ট্র। জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র। ধর্মের নামে সেখানে মানুষ হত্যা, মসজিদ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। অন্যদিকে উন্নতির ১৫টি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। উন্নতি, সমৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনীতির বিকাশ, দারিদ্র্য বিমোচনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন দৃষ্টান্ত। আমাদের সন্তানরা এখন নাসায় কাজ করছে। জয় করছে অস্কার। কখনো নির্মাণ করছে বিশ্বের উঁচু দালান। নির্বাচন করে জিতছে হাউস অব কমন্স অথবা মার্কিন কংগ্রেসে। ব্রিকলেন অথবা জ্যাকসন হাইটসসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এখন বাংলায় সাইনবোর্ড। বাংলা এখন বিশ্বব্যাপী গৌরবের। এ অর্জন শুধু আমাদের স্বাধীনতার জন্য। আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হবে অসাম্প্রদায়িক, উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। হূদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্যই জাগ্রত করতে হবে মুক্তবিবেককে। আমাদের মধ্যে দলীয় বিভেদ ছিল, থাকবে। কিন্তু ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। তাই ভালোবাসতে হবে দেশকে। মানুষকে। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সহনশীলতার এ ইতিহাস থেকে কেউ সরতে পারবে না। মোগল সাম্রাজ্যের আমল থেকে এ পর্যন্ত কে শিয়া কে সুন্নি— এ বিতর্কে আমরা ছিলাম না। কোনো সহিংসতা চোখে পড়েনি। তার পরও কেন এ জটিলতা? ভাবতে হবে। বের হয়ে আসার পথ রাজনৈতিক দলগুলোকে বের করতে হবে। এখানে কে বিএনপি কে আওয়ামী লীগ, তা বড় কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব মানুষেরই দেশ এটি।

রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ অতীতেও ছিল। বর্তমানেও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বিএনপির মতো এত বড় একটি দল চার বছরে তার মহাসচিবকে ভারমুক্ত করতে পারেনি। এখানে বোঝা যায় দলটির কোনো পরিকল্পনাই নেই রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে। তারা কীভাবে ক্ষমতায় আসবে, প্রতিবেশীর সঙ্গে কী আচরণ করবে, মিডিয়া, ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে সম্পর্ক কোনমুখী হবে— কোনো কিছুই নির্ধারণ করতে পারছে না। এ কারণে দলটির ভিতরে-বাইরে এক ধরনের হতাশা রয়েছে। এ হতাশা থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। মনটা বড় করে বিএনপিকে সামনে যেতে হবে। বুঝতে হবে বিএনপির কোথাও একটা ভুল ছিল। না হলে ক্ষমতাসীনরা বার বার হোঁচট খাওয়ার পরও বিএনপি কেন ভালো করতে পারছে না। ভাবতে হবে। রাজনীতিতে বার বার ভুলের সুযোগ নেই। অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। নিজের ঘরে সরকারের লোক রেখে বিরোধী দল করা যায় না। আগে নিজের ঘর ও অফিস ক্লিন করুন। মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করুন। তারপর জনগণের অধিকারগুলো নিয়ে মাঠে নামুন। অকারণে জটিলতা বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। তিন মাসের আগুনসন্ত্রাসের রাজনীতি বিএনপিকে আজকের অবস্থানে টেনে নামিয়েছে। বুঝতে হবে দেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশ চায়। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন চায়। ভোটাধিকার সংরক্ষণ চায়। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি আগুন দিয়ে হয় না।  সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছুড়ে হয় না।

পাদটীকা : বেলজিয়ামের রানী আমন্ত্রণ জানালেন আইনস্টাইনকে তার দেশ সফরের। রেল স্টেশনে পাঠানো হলো বিশাল গাড়ির বহর। কিন্তু রাজকর্মচারীরা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না আইনস্টাইনকে। তারা ভাবল এত বড় একজন ব্যক্তিত্ব ব্যস্ত থাকেন সব সময়। তাই হয়তো কোনো কারণে আসতে পারেননি। গাড়িবহর ফিরে এলো। রানীর বিশাল আয়োজন নিয়ে সভাসদ চিন্তিত। নানামুখী আলোচনা চলছে। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল একজন লোক সাদাসিধে পোশাক পরে বেহালা বাজাতে বাজাতে প্রবেশ করছেন রাজপ্রাসাদে। সবাই খেয়াল করলেন তিনি আর কেউ নন আলবার্ট আইনস্টাইন। রানী হতবাক হয়ে সব দেখলেন। প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন বিজ্ঞানীর দিকে। আইনস্টাইন হাসতে হাসতে বললেন, গাড়িবহরে এলে এ শহরটা দেখতে পারতাম না।  রাজকীয় বহরে তাই আসিনি। আমার কাছে শহরটা দেখা অনেক জরুরি ছিল।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিডি-প্রতিদিন/ ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা



এই পাতার আরো খবর